০৯০. ধৃতরাষ্ট্রের সখেদোক্তি-সঞ্জয়ের কটাক্ষ

৯০তম অধ্যায়

ধৃতরাষ্ট্রের সখেদোক্তি-সঞ্জয়ের কটাক্ষ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ আমার এইসকল পুত্রকে একমাত্র ভীমসেনের হস্তে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া কিরূপ অনুষ্ঠান করিলেন? আমারই পুত্ৰগণ প্রতিদিন পরাজিত ও বিনষ্ট হইতেছে, এক্ষণে বোধহয়, দৈব তাহাদের প্রতিকূল হইয়াছে। দেখ, আমার পুত্রেরা সকলেই পরাজিত হইতেছে, কোন প্রকারেই তাহাদের জয় হইতেছে না; বিশেষতঃ যখন তাহারা মহাবীর দ্রোণ, ভীষ্ম, কৃপ, ভূরিশ্রবা, ভগদত্ত, অশ্বত্থামা ও অন্যান্য মহাবীরগণের মধ্যবর্ত্তী হইয়াও বিনষ্ট হইতেছে, তখন দূরদৃষ্ট ভিন্ন আর অন্য কারণ কিছুই নাই। পূর্ব্বে আমি, ভীষ্ম, বিদুর ও গান্ধারী—আমরা সকলেই হিতবাসনাপরবশ হইয়া মূঢ়মতি দুৰ্য্যোধনকে বারংবার নিবারণ করিয়াছিলাম; কিন্তু সে অজ্ঞানতাপ্রভাবে তখন কিছুই অবধারণ করে নাই। এক্ষণে তাহারই ফলভোগ করিতেছে; ভীমসেন রোষাবিষ্ট হইয়া প্রতিদিনই আমার পুত্ৰগণকে বিনাশ করিয়া থাকে।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! বিদুর আপনাকে কহিয়াছিলেন, আপনি পুত্ৰগণকে দূতক্রীড়া হইতে নিবারণ করুন; পাণ্ডবগণের কদাচ অপকার করিবেন না; কিন্তু তৎকালে আপনি সেই হিতকর বাক্য হৃদয়ঙ্গম করেন নাই, এক্ষণে তাঁহারই কথা সপ্রমাণ হইতেছে। যেমন মনুষ্য হিতজনক ঔষধে অশ্রদ্ধা করিয়া থাকে, তদ্রূপ আপনিও প্রিয়কারী বন্ধুবান্ধবগণের বাক্যে কৰ্ণপাত করেন নাই। এক্ষণে সেইসমস্ত হিতজনক বাক্য আপনার পক্ষে ঘটিতেছে। কৌরবগণ বিদুর, দ্রোণ, ভীষ্ম ও অন্যান্য হিতাভিলাষী ব্যক্তিদিগের বাক্য শ্রবণ না করিয়াই বিনাশপ্ৰাপ্ত হইতেছে। এক্ষণে যেরূপে যুদ্ধ হইতেছে, তাহা শ্রবণ করুন।

সঙ্কুলযুদ্ধে উভয়পক্ষীয় বহুসৈন্যসংহার

“মধ্যাহ্নকালে লোকক্ষয়কর ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে, সৈন্যগণ ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে ভীষ্মবিনাশার্থ ক্ৰোধভরে ধাবমান হইল। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও সাত্যকি সৈন্যগণসমভিব্যাহারে; বিরাট ও দ্রুপদ সোমকদিগের সহিত এবং কুস্তিভোজ, ধৃষ্টকেতু ও কৈকেয়গণ ভীষ্মের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন; অর্জ্জুন, চেকিতান ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্ৰ দুৰ্য্যোধনের আজ্ঞানুবর্ত্তী পার্থিবদিগের প্রতি এবং অভিমন্যু, হৈড়ম্ব ও ভীমসেন ক্ৰোধাবিষ্ট হইয়া কৌরবদিগের প্রতি মহাবেগে ধাবমান হইলেন; এইরূপে পাণ্ডবেরা দুইভাগে বিভক্ত হইয়া কৌরবগণকে বধ করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে, কৌরবেরাও তাঁহাদিগকে বধ করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। মহারথ দ্রোণ রোষপরবশ হইয়া সৃঞ্জয়দিগের সহিত সোমাকদিগকে যমালয়ে প্রেরণ করিবার নিমিত্ত ধাবমান হইলেন। কৌরবেরা ‘মার মার’ বলিয়া সৃঞ্জয়দিগকে বধ করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহাদিগের মধ্যে সাতিশয় কোলাহল সমুপস্থিত হইল। অনন্তর দ্রোণশরনিহত বহুসংখ্যক ক্ষত্ৰিয় ব্যাধিনিপীড়িত ব্যক্তির ন্যায় ইতস্ততঃ বিচেষ্টমান দৃষ্ট হইল। ক্ষুধার্ত্ত ব্যক্তির ন্যায় তাহাদের আর্ত্তনাদ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল ।

“এদিকে মহাবলপরাক্রান্ত ভীম দ্বিতীয় অন্তকের ন্যায় ক্ৰোধে অধীর হইয়া কৌরবগণের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। পরস্পর নিহত সৈন্যগণের রুধিরবাহিনী ভীষণদর্শনা নদী প্রবাহিত হইতে লাগিল। তখন কৌরব ও পাণ্ডবগণের যমরাজ্যবিবৰ্দ্ধন সংগ্রাম অতিশয় ঘোরতর হইয়া উঠিল। অনন্তর মহাবীর ভীষ্ম রোষাবিষ্ট হইয়া মহাবেগে গজসৈন্য আক্রমণ করিয়া শমনসদনে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। ভীমসেনের নারাচদ্বারা অভিহিত করিনিকর ভূতলে নিপতিত, বিষণ্ন ও চারিদিকে ধাবমান হইল এবং কতকগুলি আর্ত্তনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। কতকগুলি হস্তী ছিন্নশুণ্ড ও ছিন্নকলেবর হইয়া ক্রৌঞ্চের ন্যায় আর্ত্তনাদ করিতে করিতে ধরাতালে শয়ন করিল। মহাবীর নকুল এবং সহদেবও করিসৈন্যের প্রতি ধাবমান হইয়া কাঞ্চনশিরোভূষণসম্পন্ন কাঞ্চন-অলঙ্কারে অলঙ্কৃত শতসহস্ৰ মাতঙ্গ নিহত করিতে লাগিলেন। কতকগুলির জিহ্বা ছিন্ন হইয়াছে; কতকগুলির নিশ্বাস অতিকষ্টে নির্গত হইতেছে; কতকগুলি এককালে জীবন পরিত্যাগ করিয়াছে এবং কতকগুলি আর্ত্তনাদ করিতেছে। সমরভূমি এইরূপে নানা রূপধারী করিনিকরে ও অর্জ্জুনশরে নিহত ভূপালগণে পরিপূর্ণ হইয়া পরামশোভা ধারণ করিল। বসন্তকালীন কুসুমের ন্যায় ভগ্নরথ, ভিন্ন ধ্বজদণ্ড, ছিন্ন চামর, মহাপ্রভা ছত্ৰ, খণ্ড খণ্ড আয়ুধ, হার, নিষ্ক, কেয়ুর কুণ্ডলাকৃত মুণ্ড, স্বলিত উষ্ণীষ, পতাকা, অনুকর্ষ [রথচক্রের উপরিস্থিত কাঠ] ও রশ্মিসহকৃত যোক্ত্র[জোয়াল]দ্বারা সমরভূমি সমাচ্ছন্ন হইয়া সাতিশয় শোভমান হইয়া উঠিল। অনন্তর মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, কৃতবর্ম্মা ও অন্যান্য বীরপুরুষেরা ক্রোধাবিষ্ট হইলে পাণ্ডবগণেরও এইরূপ ক্ষয় হইতে লাগিল।”