০৯৮. পাণ্ডবাবধার্থ কর্ণ শকুনিপ্রভৃতির কুমন্ত্রণা

৯৮তম অধ্যায়

পাণ্ডবাবধার্থ কর্ণ শকুনিপ্রভৃতির কুমন্ত্রণা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! অনন্তর শিবির মধ্যে মহারাজ দুৰ্য্যোধন, শকুনি, দুঃশাসন ও কর্ণ একত্র হইয়া কিরূপে সসৈন্য পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিবেন, তাহার মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধন কর্ণ ও শকুনিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে বীরগণ! দ্রোণ, ভূরিশ্রবা, ভীষ্ম, কৃপ ও শল্য সংগ্রামে পাণ্ডবগণকে নিহত করিতে সমর্থ হইতেছেন না; ইহার কারণ কি, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না। পাণ্ডবগণ জীবিত থাকিয়া অনায়াসে আমাদের সৈন্যগণকে সংহার করিতেছে। আমি বলহীন, শস্ত্ৰবিহীন ও পরাভূত হইতেছি। বোধহয়, পাণ্ডবগণ দেবগণেরও অবধ্য; অতএব তাহাদিগকে কিরূপে সংগ্রামে পরাজয় করিব, আমার এই মহাসংশয় সমুপস্থিত হইয়াছে।”

“মহাবীর কর্ণ দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণানন্তর কহিতে লাগিলেন, “হে ভারতবংশাবতংস! শোক করিবেন না, আমি আপনার প্রিয়ানুষ্ঠান করিব। শান্তনুতনয় ভীষ্ম সত্বর এই মহাসমর হইতে অপসৃত হউন। আমি শপথ করিতেছি যে, শান্তনুতনয় শস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক সমরে নিবৃত্ত হইলে আমি তাঁহার সমক্ষে সমুদয় পাণ্ডব ও সোমকগণকে সংহার করিব। ভীষ্ম সতত পাণ্ডবগণের প্রতি দয়া করিয়া থাকেন; তিনি ঐ মহারথগণকে পরাজয় করিতে সমর্থ নহেন। শান্তনুতনয় কেবল রণাভিমানী ও রণপ্ৰিয়; তাঁহার তাদৃশ ক্ষমতা নাই; সুতরাং তিনি কিরূপে পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিবেন? অতএব আপনি সত্বর ভীষ্মের শিবিরে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অস্ত্র পরিত্যাগ করিতে অনুরোধ করুন। তিনি অস্ত্ৰ পরিত্যাগ করিলে আপনি অতি শীঘ্রই সুহ্যদ্বান্ধবগণসমবেত পাণ্ডুপুত্রদিগকে মৎকর্ত্তৃক নিহত দেখিবেন।”

“হে মহারাজ! কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন কর্ণকর্ত্তৃক এইরূপ অভিভূত হইয়া দুঃশাসনকে কহিলেন, ‘ভ্ৰাতঃ! সত্বর অনুগামিগণকে সুসজ্জীভূত হইতে আদেশ কর; যেন বিলম্ব না হয়।” পরে কর্ণকে কহিলেন, “হে অরতিনিপাতন!! আমি শীঘ্রই ভীষ্মকে অস্ত্ৰ পরিত্যাগ করিতে অনুরোধ করিয়া তোমার নিকট প্রত্যাগমন করিতেছি। ভীষ্ম সংগ্রাম পরিত্যাগ করিলে তুমি অনায়াসে সংগ্রামে পাণ্ডবগণকে সংহার করবে।”

ভীষ্মকে অস্ত্ৰত্যাগে অনুরোধ

“মহারাজ দুৰ্য্যোধন কর্ণকে এই বলিয়া দেবগণপরিবৃত শতক্রতুর ন্যায় ভ্রাতৃগণে পরিবৃত হইয়া সত্বর বহির্গত হইলেন। মহাবীর দুঃশাসন অবিলম্বে তাঁহাকে অশ্বে আরোপিত করিলেন। তখন সিংহগামী মহাবীর দুৰ্য্যোধন অঙ্গদ, মুকুট ও ভাণ্ডীর পুষ্প[ভাঁটিফুল]বর্ণ হস্তাভারণে ভূষিত ও সুবর্ণপ্রভ সুগন্ধি চন্দনে অনুলিপ্তও নির্ম্মলবসনে সংবীত হইয়া বিমলকিরণ দিবাকরের ন্যায় শোভা ধারণপূর্ব্বক ভীষ্মের শিবিরাভিমুখে গমন করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। সর্ব্বলোকধনুৰ্দ্ধর মহাবীরগণ তাঁহার অনুগামী হইলেন। দেবগণ যেমন বাসবের চতুর্দ্দিকে গমন করেন, তদ্রূপ দুৰ্য্যোধনের ভ্রাতৃগণ কেহ অশ্বে, কেহ গজে, কেহ বা রথে আরোহণ করিয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। সুহৃদগণ রক্ষার্থ অস্ত্ৰ গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার সহিত গমন করিলেন।

“মহাবীর দুৰ্য্যোধন কৌরবগণকর্ত্তৃক পূজিত, সৌন্দরগণে পরিবৃত এবং মাগধ ও সূতগণকর্ত্তৃক সংস্তুত হইয়া হস্তিহস্তোপম, সর্ব্বশত্রুনিবহণ পীন দক্ষিণবাহু সংবরণ, অনুগতগণের অঞ্জলিগ্রহণ, নানা দেশবাসী লোকদিগের বাক্যশ্রবণ ও স্তাবকদিগের [তোষামোদকারীদিগের] পুরস্কার করিয়া শান্তনুতনয়ের শিবিরে গমন করিতে লাগিলেন। ভৃত্যগণ গন্ধতৈল পরিপূরিত প্রজ্বলিত কাঞ্চনময় প্রদীপসকল লইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। মহারাজ দুৰ্য্যোধন সেইসমুদয় কাঞ্চনময় প্রদীপে পরিবৃত হইয়া প্ৰদীপ্ত মহাগ্ৰহপরিবেষ্টিত চন্দ্ৰমার ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। কাঞ্চনোষ্ণীষভূষিত [সোণার পাগড়ীতে ভূষিত মস্তক] বেত্ৰধারী পুরুষগণ হস্তস্থিত ঝর্ঝরশব্দে জনতা নিবারণপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে গমন করিতে লাগিল।

“মহারাজ দুৰ্য্যোধন ক্ৰমে ক্ৰমে ভীষ্মের শিবিরে সমুপস্থিত হইয়া অশ্ব হইতে অবতরণপূর্ব্বক ভীষ্মের নিকট গমন করিলেন এবং তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক সর্ব্বতোভদ্র [নীচে পাতিত মহামূল্য আস্তরণের উপর বিন্যস্ত প্ৰসিদ্ধ সর্ব্বশুভাবহ স্বর্ণের ‘সর্ব্বতোভদ্র” নামক আসনে] মহার্হ আস্তরণসমাস্তীৰ্ণ, কাঞ্চনময় আসনে উপবেশন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে সাশ্রুলোচনে বাষ্পগদগদ-স্বরে কহিতে লাগিলেন, ‘হে অরতিনিপাতন! আমরা আপনাকে আশ্রয় করিয়া, সবান্ধব পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, ইন্দ্ৰাদি দেব ও দানবগণকেও সমরে পরাজয় করিতে সাহস করি। অতএব হে গাঙ্গেয়! মহেন্দ্ৰ যেমন দানবগণকে পরাজয় করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আপনি কৃপা করিয়া পাণ্ডবগণকে পরাভব করুন। আমি সমুদয় সোমক, পাঞ্চাল, কেকয় ও করুষগণকে সংহার করিব। আপনি সমরে পাণ্ডব ও সোমকগণকে নিধন করিয়া আপনার সত্য প্রতিপালন করুন। হে মহাত্মন! যদি আপনি পাণ্ডবগণের প্রতি দয়া করিয়া বা আমার প্রতি দ্বেষভাব্যবশতঃ অথবা আমার মন্দভাগ্যপ্রযুক্ত পাণ্ডবগণকে নিধন করিতে পরাঙ্মুখ হন, তবে সমরদুর্ম্মদ কর্ণকে অনুজ্ঞা করুন; তিনি সমরে সবান্ধব পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিবেন।” কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন ভীষণাপরাক্রম ভীষ্মকে এইমাত্র বলিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।”