০৯৪. ভীমপ্রমুখ বীরগণের ঘটোৎকচসাহায্য

৯৪তম অধ্যায়

ভীমপ্রমুখ বীরগণের ঘটোৎকচসাহায্য

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! রাক্ষসেন্দ্র ঘটোৎকচ এইরূপে কৌরবসৈন্যকে সমরে বিমুখ করিয়া দুৰ্য্যোধনকে নিধন করিবার বাসনায় তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। আপনার পক্ষীয় সৈন্যগণ সেই দুৰ্জয় হিড়িম্বাতনয়কে মহাবেগে দুৰ্য্যোধনাভিমুখে ধাবমান দেখিয়া তালপ্রমাণ শরাসনসমুদয় আকর্ষণ ও সিংহের ন্যায় ধ্বনি করিয়া তাঁহার অভিমুখে গমনপূর্ব্বক শরৎকালে মেঘবৃন্দের পর্ব্বতোপরি বারিবর্ষণের ন্যায় তাঁহার উপর বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমতনয় সৈন্যগণের শরনিকরে অঙ্কুশাহত মাতঙ্গের ন্যায় ব্যথিত হইয়া গরুড়ের ন্যায় ঝটিতি আকাশমার্গে সমুত্থিত হইলেন এবং শরৎকালীন জীমুতের ন্যায় দিগ্বিদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া ঘোরতর নিনাদ করিতে আরম্ভ করেলন।

“মহারাজ যুধিষ্ঠির হিড়িম্বানন্দনের চীৎকার শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে বৃকোদর! ঘটোৎকচের ভীষণ ধ্বনি শ্রুত হইতেছে; অতএব নিশ্চয়ই ঐ বীর মহারথ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের সহিত সংগ্রাম করিতেছে। মহাবীর হিড়িম্বানন্দন অতিভারে আক্রান্ত হইয়াছে; এদিকে পিতামহ ভীষ্ম ক্ৰোধাভরে পাঞ্চালগণকে সংহার করিতে গমন করিয়াছেন। হে ভীম! এক্ষণে এই কাৰ্য্যদ্বয় সমুপস্থিত হইয়াছে। ধনঞ্জয় পাঞ্চালগণের রক্ষার্থ অরতিকুলের সহিত সংগ্রাম করিতেছেন, তুমি সত্বর গমন করিয়া সংশয়াপন্ন হিড়িম্বাতনয়কে রক্ষা কর।”

“মহাবীর বৃকোদর জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে সিংহনাদে সমুদয় ভূপতিগণকে বিত্ৰাসিত করিয়া পার্ব্বণ[পূর্ণিমা-অমাবস্যাকালীন]-সমুদ্রের ন্যায় মহাবেগে ধাবমান হইলেন। রণদুর্ম্মদ সত্যধৃতি, সৌচিত্তি, শ্রেণীমান, বসুদান, কাশীরাজের পুত্র বিভু, দ্রৌপদীতনয়গণ, অভিমন্যু, বিক্রমশালী ক্ষত্রদেব, ক্ষত্রধর্ম্ম ও অনুপাধিপতি নীল ষট্‌সহস্ৰ মাতঙ্গ ও অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে ভীমসেনের অনুসরণক্ৰমে ঘটোৎকচের সমীপে গমন করিয়া শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক ঘটোৎকচকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। রথনেমিনিৰ্ঘোষ ও বীরগণের সিংহনাদে বসুন্ধরা কম্পিত হইয়া উঠিল। কৌরবসৈন্যগণ সেই সমাগত পাণ্ডবসৈন্যের কোলাহল শ্রবণে এবং ভীমসেনের ভয়ে উদ্বিগ্ন ও বিবর্ণমুখ হইয়া ঘটোৎকচকে পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রত্যাবৃত্ত হইল।

“অনন্তর উভয়পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। ঐ ভীরুজনভয়াবহ [স্বাভাবিক ভীতজনের ভয়জনক] সমরে মহারথীগণ পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইয়া নানাবিধ অস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। উভয়পক্ষীয় অশ্বারোহী, গজারোহী, রথী ও পদাতিগণ পরস্পরকে আহ্বানপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিল। ঐ সময়ে রথনেমি এবং পদাতি, গজ ও অশ্বসমুদয়ের পদের সংঘর্ষণে ধূমসদৃশ ধূলিপটল সমুত্থিত হইল। কে আত্মীয়, কে পর, কিছুই বোধগম্য হইল না; পিতা পুত্রকে বা পুত্র পিতাকে অবগত হইতে পারিলেন না। মনুষ্য ও অস্ত্রসমুদয়ের ভীষণ গর্জ্জন প্রেতশব্দের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। অশ্ব, গজ ও মনুষ্যগণের শোণিতে নদী প্রবাহিত হইল; মৃত মনুষ্যগণের কেশকলাপ উহার শৈবাল ও শাদ্বলের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল; মনুষ্যগণের মস্তকসমুদয় দেহ হইতে নিপতিত হওয়াতে প্রস্তরপতনশব্দের ন্যায় ঘোরতর শব্দ হইল, ফলত তৎকালে বসুন্ধরা কেবল মস্তকবিহীন নরকলেবর, ছিন্নগাত্ৰ মাতঙ্গ ও ভিন্নদেহ অশ্বসমুদয়ে সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠিল।

কৌরব সৈন্যগণের পশ্চাৎ অপসরণ

“অশ্বগণ অশ্বারোহীকর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়া বিপক্ষপক্ষীয় হয়ের সহিত মিলিত হইল এবং পরিশেষে উভয়েই পরস্পরের আঘাতে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিল। নরগণ পরস্পরকে আক্রমণপূর্ব্বক ক্ৰোধসংরক্তলোচনে পরস্পর আলিঙ্গনপূর্ব্বক পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। মহামাত্রপ্রেরিত মাতঙ্গগণ, বিপক্ষপক্ষীয় পতাকাসুশোভিত মাতঙ্গ সমূহের অভিমুখীন হইয়া তাহাদিগের উপর দন্তাঘাত করিতে লাগিল। আহত মাতঙ্গগণ রুধিরচৰ্চিত হইয়া সবিদ্যুৎ জলধরের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। কোন কোন বারণ বিপক্ষপক্ষীয় বারণের দন্তাগ্রে ভিন্নগাত্র ও তোমরঘাতে ভিন্নকুম্ভ হইয়া মেঘের ন্যায় ধ্বনি করিয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। কোন কোন ছিন্ন শুণ্ড ও ভিন্নদেহ, গজ ছিন্নপক্ষ পর্ব্বতের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল। কোন কোন বিদারিতাপার্শ্ব [বিদীর্ণ পার্শ্বযুগল] মত্তমাতঙ্গ ধাতুস্ৰাবী ধরাধারের [পর্ব্বতের] ন্যায় রুধিরমোক্ষিণ করিতে আরম্ভ করিল। কোন কোন হস্তী নারাচাহত ও কোন কোন হস্তী তোমরবিদ্ধ হইয়া শৃঙ্গ যুক্ত পর্ব্বতের ন্যায় ধাবমান হইল। কোন কোন মন্দান্ধ মাতঙ্গ ক্ৰোধভরে রথ, অশ্ব, ও পদাতিগণকে মর্দ্দন করিতে লাগিল। অশ্বগণ বিপক্ষপক্ষীয় অশ্বারোহীদিগের প্রাস ও তোমরনিচয়ে তাড়িত হইয়া ইতস্ততঃ পলায়নপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক ব্যাকুলিত করিল। মহাকুলপ্রসূত রথিগণ জীবিতবাসনা পরিত্যাগপূর্ব্বক অসাধারণ শক্তি প্ৰকাশ করিয়া ভয়বিহীনের ন্যায় কাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। যেমন রাজগণ স্বয়ংবরে পরস্পর প্রহার করিয়া থাকেন, তদ্রূপ সমররসপারায়ণ বীরগণ স্বৰ্গ বা যশোলাভ প্রত্যাশায় পরস্পর প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই লোমহর্ষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে কৌরবসৈন্যগণের মধ্যে প্রায় সকলেই সমরবিমুখ হইল।”