১৯৪তম অধ্যায়
সত্ত্বাদি ত্রিগুণময়ী বুদ্ধি—গুণত্রয়ের বৃত্তি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! অধ্যাত্মযোগধর্ম্মের [আত্মসাক্ষাৎকারসাধক যোগচৰ্য্যার] অনুষ্ঠান মনুষ্যের কর্ত্তব্য বলিয়া শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে। ঐ যোগধৰ্ম্ম কিরূপ এবং এই স্থাবরজঙ্গমপূর্ণ সমুদয় বিশ্বসংসার কোন মহাত্মা হইতে সৃষ্ট হইয়াছে ও প্রলয়কালে কাহাতেই বা লীন হইবে, তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! তুমি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছ, সেই শ্রেয়স্কর সুখস্বরূপ ধর্ম্মতত্ত্ব সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। আচাৰ্য্যগণ এই জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের বিষয় বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। ইহলোকে যে ব্যক্তি উহা পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তাঁহার পরম প্রীতি ও সৰ্ব্বভূতহিতকর উৎকৃষ্ট ফললাভ হয়। পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, সলিল ও তেজ এই পাঁচ মহাভূতপ্রভাবেই সমুদয় প্রাণীর সৃষ্টি ও বিনাশ হইতেছে। ঐ সকল মহাভূত সাগরতরঙ্গের ন্যায় বারংবার যাহা হইতে উৎপন্ন হয়, তাহাতেই বিলীন হইয়া থাকে। কূৰ্ম্ম যেমন অঙ্গসমুদয় বারংবার প্রসারিত ও সঙ্কুচিত করে, তদ্রূপ সৃষ্টিকর্ত্তা বারংবার জগৎ সৃষ্টি ও হরণ করিতেছেন। জগদীশ্বর সমুদয় প্রাণীর শরীরের পাঁচ মহাভূতকে পৃথকরূপে সংস্থাপিত করিয়াছেন। আত্মাভিমানশূন্য হইলে ঐ সকল ভূতের যাথার্থ্য নির্ণয় করা যায় না। শব্দ, শ্ৰোত্র ও ছিদ্রসমুদয় আকাশের; স্পর্শ, চেষ্টা ও ত্বক বায়ুর; রূপ, চক্ষু ও পরিপাক তেজের; রস, ক্লেদ ও জিহ্বা জলের এবং ঘ্রেয় বস্তু, ঘ্রাণেন্দ্রিয় ও শরীর পৃথিবীর গুণ। এইরূপে এই পাঁচ মহাভূত ও মন জীবাত্মার বিষয়বোধের দ্বারস্বরূপ হইয়াছে। ইন্দ্রিয়সকল বিষয় গ্রহণ, মন তদ্বিষয়ে উৎপাদন, বুদ্ধি বিষয়ের যাথার্থ্য নির্ণয় করিয়া থাকে। পরমাত্মা প্রাণীগণের দেহের মধ্যে সাক্ষীর ন্যায় অবস্থানপূর্ব্বক আপাদমস্তক দর্শন করিতেছেন। তিনি এই সমুদয় পরিদৃশ্যমান পদার্থে বিদ্যমান রহিয়াছেন। সত্ত্ব, রজ ও তমঃ এই তিনগুণ ইন্দ্রিয় আশ্রয় করিয়াই রহিয়াছে; অতএব মনুষ্যগণ সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়সমুদয়ের পরীক্ষা করিবে।
“বুদ্ধিপ্রভাবে প্রাণীগণের উৎপত্তি ও লয়স্থান বিদিত হইতে পারিলেই ক্রমে ক্রমে উৎকৃষ্ট শান্তিগুণ লাভ করিতে পারা যায়। তমঃ প্রভৃতি গুণত্রয় বুদ্ধিকে এবং বুদ্ধি পাঁচ ইন্দ্রিয়, পঞ্চভূত ও মনকে বিষয়াসক্ত করিয়া থাকে; অতএব বুদ্ধির অভাবে গুণত্রয় ও ইন্দ্রিয়াদি কোন কার্য্যই সাধন করিতে পারে না। কি স্থাবর, কি জঙ্গম সমুদয় প্রাণী বুদ্ধিসম্পন্ন হইলেই উৎপন্ন ও বুদ্ধিহীন হইলেই। বিলীন হইয়া থাকে। এই নিমিত্তই বেদে প্রাণীগণকে বুদ্ধিময় বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করা হইয়াছে। বুদ্ধিপ্রভাবেই নেত্ৰদ্বারা দর্শন, কর্ণদ্বারা শ্রবণ, নাসিকাদ্বারা ঘ্রাণ, রসনাদ্বারা আস্বাদ, ত্বক্দ্বারা স্পর্শজ্ঞান ও মনদ্বারা চিন্তা জন্মে। চক্ষু, কর্ণ, প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণ, কেবল বুদ্ধির বিষয়জ্ঞানের দ্বারস্বরূপ। চিদাত্মা ঐ সকল ইন্দ্রিয়কে স্ব স্ব কার্য্যে ব্যাপৃত করিতেছে। বুদ্ধি প্রাণীগণের দেহ আশ্রয় করিয়া কখন প্রীতিলাভ, কখন অনুতাপ এবং কখন বা প্রীতি ও অনুতাপ এই উভয়বিহীন হইয়া অবস্থান করিতেছে। ঊর্ম্মিমালাসমাকুল [তরঙ্গসমূহে সমাকুলিত] নদীপতি সমুদ্র যেমন বেলাভূমি অতিক্রম করিতে পারে না, তদ্রূপ বুদ্ধি সুখদুঃখাদি ভাবত্রয় অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় না। বুদ্ধি কখন কখন সুখদুঃখাদির ভাব হইতে বিরত হয় বটে, কিন্তু তাহাকে তৎকালে নিশ্চয়ই মনোমধ্যে অবস্থান করিতে হয় এবং রজোগুণ উপস্থিত হইলেই তাহাকে পুনরায় সেই সুখদুঃখাদির অনুসরণ করিতে হয়। বুদ্ধি রজোগুণসম্পন্ন হইয়া ইন্দ্রিয়জ্ঞান, সত্ত্বগুণসম্পন্ন হইয়া যাথার্থ্যজ্ঞান ও তমোগুণসম্পন্ন হইয়া মোহাদি উৎপাদিত করিয়া থাকে। শম, দম কাম, ক্রোধ, ভয় ও বিষাদ প্রভৃতি সমুদয়ই এই তিনগুণে বিদ্যমান রহিয়াছে। এই আমি তোমার নিকট বুদ্ধির বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।
“বুদ্ধিমান ব্যক্তি প্রযত্নসহকারে সমুদয় ইন্দ্রিয়কে পরাজিত করিবে। সত্ত্ব, রজ, তমঃ এই তিনগুণ সৰ্ব্বদাই প্রাণীগণকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে। সৰ্ব্বজীবেই সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী এই ত্রিবিধ বুদ্ধি লক্ষিত হইয়া থাকে। সত্ত্বগুণপ্রভাবে সুখ ও রজোগুণভাবে দুঃখ উপস্থিত হয়। তমোগুণপ্রভাবে সুখদুঃখ তিরোহিত হয় বটে, কিন্তু ঐ গুণ মোহ উৎপাদনের মূলীভূত। লোকের শরীরে ও মনে যে প্রীতিযুক্ত ভাব উদিত হয়, তাহাকে সাত্ত্বিক ভাব, যে অপ্রীতি ও দুঃখযুক্ত ভাব জন্মে, তাহাকে রাজসিক ভাব এবং যে মোহযুক্ত ভাব উপস্থিত হইয়া লোককে ইতিকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় করে, তাহাকে তামসিক ভাব বলিয়া নির্দেশ করা যায়। রাজসিক ভাব উপস্থিত হইলে উহা নিবারণ করিবার চেষ্টা করাই উচিত; ভয়প্রযুক্ত দুঃখচিন্তা করা কর্ত্তব্য নহে। ফলতঃ সত্ত্বগুণ হইতে প্রহর্ষ, প্রীতি, আনন্দ ও প্রশান্তচিত্ততা; রজোগুণ হইতে অসন্তোষ, পরিতাপ, শোক, লোভ ও অক্ষমা এবং তমোগুণ হইতে অপমান, মোহ, প্রমাদ, স্বপ্ন ও তন্দ্রা সমুপস্থিত হইয়া থাকে; যাঁহার চিত্ত দুর্ল্লভবস্তুলাভে অনাসক্ত, বিবিধ বিষয়ে ব্যাপৃত, প্রার্থনানভিজ্ঞ ও নিয়মিত, তিনি উভয়লোকেই সুখ লাভ করিয়া থাকেন।
বুদ্ধি ও আত্মার সম্বন্ধ
“এক্ষণে সূক্ষ্মস্বরূপ বুদ্ধি ও আত্মার ভেদের বিষয় অনুধাবন কর। বুদ্ধি গুণসমুদয় সৃষ্টি করিতেছে, কিন্তু আত্মা ঐ কাৰ্য্য হইতে নিবৃত্ত রহিয়াছে। মশক ও উড়ম্বর [যজ্ঞডুমুর] যেমন পরস্পর সংলগ্ন হইয়াও এবং সলিল ও মৎস্য যেমন পরস্পর মিলিত থাকিয়াও পরস্পর পৃথক পদার্থ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়, তদ্রূপ বুদ্ধি ও আত্মা পরস্পর একত্র হইলেও উহাদিগকে স্বভাবতঃ স্বতন্ত্র বলিয়া নির্দেশ করা যায়। গুণসমুদয় আত্মাকে অবগত হইতে সমর্থ হয় না; কিন্তু আত্মা গুণসমুদয়কে অনায়াসে অবগত হইতেছে। আত্মা অহঙ্কারাদি গুণের দ্রষ্টা হইয়া উহাদিগকে আপনা হইতে উৎপন্ন বলিয়া বিবেচনা করিয়া থাকে। যেমন ঘটাচ্ছাদিত প্রদীপ ঘটচ্ছিদ্রদ্বারা স্বীয় তেজ প্রকাশপূৰ্ব্বক বস্তু উদ্ভাবন করিয়া দেয়, তদ্রূপ পরমাত্মা চেষ্টাশূন্য আত্মজ্ঞানবিরহিত বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়দ্বারা সমস্ত প্রকাশিত করিতেছেন। বুদ্ধি সমস্ত গুণের সৃষ্টি এবং আত্মা তৎসমুদয় দর্শন করিয়া থাকে। আত্মা ও বুদ্ধির এই দুরপনেয় সম্বন্ধ নিবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। বুদ্ধি ও আত্মার আর কেহই আশ্রয় নাই; উহারা পরস্পর পরস্পরের আশ্রিতও নহে। বুদ্ধি মনকে অভিব্যক্ত করিয়া থাকে, কিন্তু উহা অহঙ্কারাদি গুণসমুদয়কে প্রকাশ করিতে সমর্থ হয় না। যখন আত্মা বুদ্ধির দ্বারস্বরূপ ইন্দ্রিয়সমুদয়কে নিয়ন্ত্রিত করে, তখন ঘটমধ্যস্থিত প্রজ্জ্বলিত দীপশিখার ন্যায় স্বয়ং প্রকাশিত হয়।
মুমুক্ষুর আত্মদর্শনের উপায়
“মনুষ্য সন্ন্যাসধৰ্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক আত্মনিষ্ঠ ও ধ্যাননিরত হইয়া আপনাকে ব্ৰহ্ম জ্ঞান করিলে নিশ্চয়ই উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারে। জলচর পক্ষী যেমন সলিলে সঞ্চরণ করিয়াও উহাদ্বারা লিপ্ত হয় না, তদ্রূপ বুদ্ধিমান ব্যক্তি সংসারে পরিভ্রমণ করিয়াও সাংসারিক কার্য্যে লিপ্ত হয়েন না। যে মহা এইরূপে সংসারে লিপ্ত না হইয়া আপনার বুদ্ধি প্রভাবে শোক, হর্ষ ও মাৎসর্য্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ব্রহ্মনিষ্ঠ ও জীবন্মুক্ত হইতে পারেন, তিনি ঊর্ণনাভ [মাকড়] যেমন সূত্ৰসমুদয়ের সৃষ্টি করিয়া থাকে, তদ্রূপ অনায়াসে গুণ সমুদয়ের সৃষ্টি করিতে সমর্থ হয়েন। কেহ কেহ কহেন, জীবন্মুক্ত ব্যক্তিদিগের গুণসমুদয় এককালে বিনষ্ট হয় না। আর কেহ কেহ কহেন যে, ঐ সমুদয় এককালেই বিনষ্ট হইয়া যায়। যাঁহারা জীবন্মুক্তদিগের গুণসমুদয়ের বিনাশ স্বীকার না করেন, তাঁহারা কহেন যে, শ্রুতিতে ঐ সমুদয়ের বিনাশের কোন প্রমাণ নাই; কেবল স্মৃতিতেই প্রমাণ আছে। অতএব জীবন্মুক্ত ব্যক্তিদিগের গুণসমুদয়ের বিনাশ স্বীকার করা বিধেয় নহে। সুতরাং বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি স্বীয় বুদ্ধি অনুসারে এই দুইটি মতের যাথার্থ্য অবধারণ করিয়া কার্য্যানুষ্ঠান এবং বুদ্ধিভেদোৎপাদক [মনের সঙ্কল্প বিকল্পাত্মক দ্বিবিধ ভাবের উৎপাদক] সুদৃঢ় সংশয়সমুদয় ছেদনপূৰ্ব্বক সুখে অবস্থান করিবেন, কদাচ শোকাকুল হওয়া তাঁহার বিধেয় নহে। মলিনহৃদয় ব্যক্তিরা জ্ঞানরূপ স্রোতস্বতীতে অবগাহন করিলে অনায়াসে বিশুদ্ধি লাভ করিতে পারে। জ্ঞান অপেক্ষা পবিত্র আর কিছুই নাই। অন্যান্য নদীর কেবল পরপার দর্শন করিলেই ফললাভ হয় না; নৌকাদিদ্বারা উহা উত্তীর্ণ হইতে পারিলেই চরিতার্থতা লাভ হইয়া থাকে। কিন্তু জ্ঞাননদী প্রকৃতরূপে অবগত হইতে পারিলেই ফললাভ হয়। উহার অনুষ্ঠানের আর কিছুমাত্র অপেক্ষা থাকে না। যাঁহাদিগের নিৰ্ব্বিষয়ক অধ্যাত্মজ্ঞান জন্মে, তাঁহারাই যথার্থ উত্তম জ্ঞান লাভ করেন; প্রাণীগণের এই প্রকার উৎপত্তি ও লয় বুদ্ধিদ্বারা সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিলে অনন্ত সুখলাভ হইয়া থাকে। যিনি ত্রিবর্গকে ক্ষয়শীল বলিয়া জ্ঞাত হইয়া উহা পরিত্যাগ করেন, তিনিই যথার্থ ধ্যানশীল, তত্ত্বদর্শী ও আত্মদর্শনে পরিতৃপ্ত হইতে পারেন। রূপরসাদি বিষয়ে আসক্ত দুর্নিবার ইন্দ্রিয়সমুদয় সংযত না হইলে উহাদের দ্বারা আত্মদর্শনলাভ হওয়া নিতান্ত সুকঠিন। আত্মজ্ঞান অপেক্ষা উৎকৃষ্ট জ্ঞান আর কিছুই নাই। মনস্বী ব্যক্তি আত্মাকে সবিশেষ জ্ঞাত হইয়া আপনাকে কৃতাৰ্থ বোধ করিয়া থাকেন। জ্ঞানহীন ব্যক্তির যাহাতে অতিশয় ভয়সঞ্চার হইয়া থাকে, জ্ঞানী ব্যক্তির হাতে কিছুমাত্র ভয় উপস্থিত হয় না। মুক্তি সকলেরই এক প্রকার হইয়া থাকে; কেন না, যাঁহারা সগুণ, তাঁহাদিগেরই গুণের তারতম্য হয়, কিন্তু যাঁহারা নির্গুণ, তাঁহাদের কোন বিষয়েরই তারতম্য হইবার সম্ভাবনা নাই। যিনি অভিসন্ধিশূন্য হইয়া কাৰ্য্যানুষ্ঠান করেন, তাঁহার পূৰ্ব্বকৃত কাৰ্য্যদোষসমুদয় সংশোধিত হইয়া যায়। কৰ্ম্মদ্বারা লোকের মোক্ষলাভ হইবার সম্ভাবনা নাই। বিত্ত পরীক্ষক কামক্রোধাদি ব্যসনে আসক্ত ব্যক্তিকে ধিক্কার প্রদান করিয়া থাকেন। সেই গর্হিত কাৰ্য্যানুষ্ঠাতা জীবিতাবস্থায় সকলের নিন্দাভাজন হইয়া কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক অতি নিকৃষ্ট পশ্বাদি যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। পাপাত্মারা পুত্ৰকলাদিবিরহে শোকাকুল হইয়া থাকে এবং বিবেকী লোকেরা পুত্রাদিনাশেও শোকাকুল হয়েন না। অভিনিবেশসহকারে এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধান করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য।