১৭৬তম অধ্যায়
বাসনাবিহীনের সুখশান্তি—শম্পাকগীত
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যাহারা ধনবান বা নিৰ্দ্ধন হইয়া ধৰ্ম্মশাস্ত্রানুসারে অবস্থান করে, তাহাদিগের সুখদুঃখ কি প্রকার এবং কিরূপেই বা উহা উৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই উপলক্ষে শম্পাকগীত নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কিয়দ্দিন হইল, শম্পাকনামে এক ব্রাহ্মণ দারিদ্রদুঃখনিবন্ধন অন্নবস্ত্রের ক্লেশ এবং স্বীয় পত্নীর কুৎসিত ব্যবহারে নিতান্ত কাতর হইয়া সংসারাশ্রম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমাকে কহিয়াছিলেন যে, ইহলোকে জন্মপরিগ্রহ করিবামাত্র বিবিধ সুখদুঃখ মানবগণকে আশ্রয় করে; কিন্তু মনুষ্য যদি সেই সুখ বা দুঃখ প্রাপ্ত হইবামাত্র উহা দৈবায়ত্ত বলিয়া বোধ করে, তাহা হইলে তাহাকে আর আহ্লাদ বা কাতরতায় অভিভূত হইতে হয় না। তুমি সেই কামবিহীন হইয়াও চিত্তসংযমে অসমর্থ হইয়াছ বলিয়া মোক্ষধৰ্ম্মের অভিমুখীন হইতে সমর্থ হইতেছ না। ধনদারাদি সমুদয় ভোগ্যবস্তু পরিত্যাগপূর্ব্বক ইতস্ততঃ পৰ্য্যটন করিলে অনায়াসে সুখলাভ হইতে পারে। অকিঞ্চন ব্যক্তিই সুখে শয়ন ও দুঃখে গাত্রোত্থান করে। ইহলোকে অকিঞ্চনতাই সৰ্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ সুখলাভের একমাত্র নিদান। কামাত্মা ব্যক্তিদিগের উহা লাভ করা নিতান্ত সুকঠিন, কিন্তু সংসারবিরত ব্যক্তিরা উহা অনায়াসে লাভ করিতে পারে। বিশুদ্ধাত্মা অকিঞ্চন দরিদ্রের সমকক্ষ ব্যক্তি ত্রিলোকমধ্যে নয়নগোচর হয় না। রাজ্য ও অকিঞ্চনতা এই উভয়কে পরিমাণ করিলে অকিঞ্চনতা সর্ব্বাংশে অতিরিক্ত হইয়া থাকে। বিশেষতঃ ঐ উভয়ের এই এক মহৎ বৈলক্ষণ আছে যে, রাজ্যেশ্বর নিরন্তর কালগ্রস্তের ন্যায় নিতান্ত উদ্বিগ্ন থাকেন আর অকিঞ্চন [শিয়রের বালিশ] ব্যক্তি ধনত্যাগনিবন্ধন অগ্নি, অশুভ গ্রহ, মৃত্যু বা দস্যু হইতে কিছুমাত্র ভীত হয় না। যে ব্যক্তি শান্তিগুণ অবলম্বনপূৰ্ব্বক স্বেচ্ছানুসারে বিচরণ ও বাহু উপাধান করিয়া ধূলিতে শয়ন করেন, দেবতারাও সতত তাঁহাকে সাধুবাদ প্রদান করিয়া থাকেন। ধনবান ব্যক্তি ক্রোধ-লোভের বশীভূত হইয়া বক্রভাবে দর্শন, মুখবিকার-প্রদর্শন, ভ্রূকুটি-বন্ধন, অধরোষ্ঠ-দংশন ও দুৰ্ব্বাক্য প্রয়োগপূৰ্ব্বক, পৃথিবীদানে উদ্যত হইলেও কেহ তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিতে অভিলাষী হয় না।
“ঐশ্বৰ্য্যসেবা [বিষয়ভোগ] অবিচক্ষণ ব্যক্তিকে মুগ্ধ করিয়া সমীরণ সঞ্চালিত শরৎকালীন জলধরের ন্যায় বিচলিত করিতে থাকে। তখন ‘আমি কেবল মনুষ্য নহি, রূপবান, ধনবান ও সৎকুলোদ্ভব’, এই বলিয়া তাহার মনোমধ্যে মহা অভিমান জন্মে। ঐ অভিমাননিবন্ধন চিত্তের প্রমাদ উপস্থিত হইলেই লোকে ক্রমে ক্রমে পিতৃসঞ্চিত সমস্ত দ্রব্য নিঃশেষিত করিয়া পরিশেষে চৌর্য্যবৃত্তি অবলম্বন করিতে অভিলাষী হয়। তখন ব্যাধ যেমন শরনিকরে মৃগকে আহত করে, তদ্রূপ নরপতি সেই উন্মার্গপ্রস্থিত [বিপরীত পথে চালিত—উদ্ভ্রান্ত] পরস্বাপহারী দস্যুকে রাজদণ্ডদ্বারা তাড়িত করিতে আরম্ভ করেন। এতদ্ভিন্ন তাহার অগ্নিদাহ ও অস্ত্রবিদারণ প্রভৃতি অন্যান্য বিবিধ ক্লেশও উৎপন্ন হইয়া থাকে। অতএব অনিত্য পুত্ৰাদি-কামনা পরিত্যাগ করিয়া সংসারধৰ্ম্মে অবজ্ঞা প্রদর্শনপূৰ্ব্বক স্বীয় বুদ্ধি সহকারে সেই সমুদয় দুঃখের প্রতিকার চেষ্টা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। সংসারাশ্রম পরিত্যাগ না করিলে নির্ভয়ে শয়ন এবং সঙ্গতি বা সুখলাভের কিছুমাত্র প্রত্যাশা নাই; অতএব আপনি সমস্ত পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সুখী হউন।
“হে মহারাজ! পুৰ্ব্বে হস্তিনানগরে মহাত্মা শম্পাক আমার নিকট এইরূপ কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন; অতএব সংসারধর্ম্ম পরিত্যাগ করাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট কার্য্য।”