১৭১তম অধ্যায়
রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষ হইতে গৌতমের ধনপ্রাপ্তি
ভীষ্ম কহিলেন, “অনন্তর গৌতম রাজভবনে প্রবেশ করিবামাত্র রাক্ষসাধিপতি বিরূপাক্ষ তাঁহাকে যথেষ্ট সমাদর করিয়া আসন প্রদানপূর্ব্বক তাঁহার গোত্র, আচার, বেদাধ্যয়ন ও ব্রহ্মচর্য্যের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন। রাক্ষসরাজ গোত্রাচারাদির [কি গোত্র, কেমন আচার প্রভৃতি] বিষয় জিজ্ঞাসা করাতে গৌতম নিতান্ত ক্ষুব্ধ হইয়া স্বীয় গোত্রের নামমাত্র উল্লেখ করিয়া নিরস্ত হইলেন; অন্যান্য বিষয়ে কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন না। তখন রাক্ষসে সেই স্বাধ্যায়হীন ব্ৰহ্মতেজোবিহীন ব্রাহ্মণকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ভগবন্! আপনার বাসস্থান কোথায় এবং আপনি কোন্ বংশেই বা দারপরিগ্রহ করিয়াছেন, অকুতোভয়ে যথার্থরূপে তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’ তখন গৌতম কহিলেন, ‘রাজ! আমি সত্য কহিতেছি, মধ্যদেশ আমার জন্মভূমি, কিরাতভবন আমার বাসস্থান এবং আমি এক বিধবা শূদ্রার পাণিগ্রহণ করিয়াছি।’
“গৌতম এই কথা কহিলে রাক্ষসাধিপতি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, এক্ষণে কি করা কর্ত্তব্য? ইনি ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, মহাত্মা রাজধৰ্ম্মের সহিত ইঁহার সৌহার্দ্য আছে এবং সেই মহাত্মাই ইঁহাকে আমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। মহাত্মা রাজধৰ্ম্ম আমার ভ্রাতা, বান্ধব ও প্রিয়সখা; অতএব যাহাতে তিনি সন্তুষ্ট হয়েন, আমাকে তাহাই করিতে হইবে। আজ আমাকে সহস্র ব্রাহ্মণভোজন করাইতে হইবে। আমি সেই উপলক্ষে ইঁহাকেও ভোজন করাইয়া প্রভূত ধন দান করিব। ইনি আমার ভাগ্যক্রমেই এই পবিত্রদিনে আমার ভবনে অতিথি হইয়াছেন। আর বিপ্রগণকে যেসমুদয় ধন প্রদান করিতে হইবে, তাহাও প্রস্তুত রহিয়াছে।
“রাক্ষসাধিপতি এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, ইত্যবসরে কৃতস্নান, পট্টবস্ত্রধারী, নানালঙ্কারভূষিত, সহস্র বিদ্বান ব্রাহ্মণ তথায় উপস্থিত হইলেন। রাক্ষসেন্দ্র বিরূপাক্ষ তাঁহাদিগকে দেখিবামাত্র সত্বর গাত্রোখান করিয়া বিধিপূৰ্ব্বক অভ্যর্থনা করিলেন। ভৃত্যগণ তাঁহার আদেশানুসারে ব্রাহ্মণদিগকে দিব্য কুশাসন সমুদয় প্রদান করিতে লাগিল। অনন্তর বিপ্রগণ কুশাসনে উপবিষ্ট হইলে রাক্ষসরাজ বিধানানুসারে তিল, কুশ ও সলিলদ্বারা তাঁহাদের পূজা করিলেন। পিতৃলোক, অগ্নি ও. বিশ্বদেবের প্রতিমূর্ত্তিসমুদয় গন্ধপুষ্প প্রভৃতি বিবিধ উপচারদ্বারা পূজিত হইয়া শশাঙ্কসমূহের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অনন্তর রাক্ষসরাজ সেই ব্রাহ্মণগণকে ঘৃতমধুসংযুক্ত, দিব্যান্নপরিপূর্ণ, হীরকাঙ্কিত সুবর্ণপাত্রসমুদয় প্রদান করিলেন। বিপ্রগণ প্রতি বৎসর আষাঢ়ী ও মাঘী পূর্ণিমাতে ঐ রাক্ষসের ভরনে পরমসমাদরে স্বেচ্ছানুরূপ উৎকৃষ্ট ভোজন-সামগ্রী প্রাপ্ত হইতেন। আর শরৎকাল অতীত হইলে কাৰ্তিকী পূর্ণিমাতে ঐ রাক্ষস ব্রাহ্মণগণকে যথেষ্ট অর্থ প্রদান করিতেন। রাক্ষসরাজ তদনুসারে ঐ দিন দক্ষিণাদানের নিমিত্ত অজিন, রাঙ্কব, সুবর্ণ, রজত, মণি, মুক্তা, প্রবাল ও মহামূল্য হীরক প্রভৃতি বিবিধ রত্নসমুদয় রাশীকৃত করিয়া ব্রাহ্মণগণকে কহিলেন, ‘হে বিপ্রগণ! আপনারা স্বেচ্ছানুসারে এই সমুদয় রত্ন ও স্ব স্ব ভোজনপত্র গ্রহণ করিয়া গৃহে প্রতি গমন করুন।’ মহাত্মা বিরূপাক্ষ এই কথা কহিবামাত্র ব্রাহ্মণগণ স্ব স্ব অভিলাষানুরূপ অর্থ গ্রহণ করিতে লাগিলেন। তখন রাক্ষসাধিপতি নানা দেশ হইতে সমাগত রাক্ষসদিগকে ব্রাহ্মণগণের অনিষ্টসাধনে নিবারণ করিয়া পুনরায় তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দ্বিজগণ! কেবল আজিকার দিবস রাক্ষস হইতে আপনাদিগের কিছুমাত্র শঙ্কা নাই; অতএব আপনারা আর বিলম্ব করিবেন না; অচিরাৎ স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করুন। তখন সেই ব্রাহ্মণগণ যথেষ্ট ধন গ্রহণ করিয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইলেন। ঐ সময় গৌতমও অতিভার সুবর্ণভার গ্রহণপুৰ্ব্বক যারপরনাই পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত্ত হইয়া সেই বৃক্ষমূলে আগমন ও উপবেশন করিলেন।
“কিয়ৎক্ষণ পরে মিত্রবৎসল বকরাজ রাজধৰ্ম্ম তথায় উপস্থিত হইল এবং গৌতমকে সমাগত দেখিয়া স্বাগত প্রশ্নান্তে মহা আহ্লাদে স্বীয় পক্ষপুট বীজনদ্বারা তাঁহার শ্ৰমাপনোদনপূৰ্ব্বক আহার সামগ্রীর আয়োজন করিয়া দিল। তখন গৌতম বিলক্ষণরূপে ভোজন ও বিশ্রাম করিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, ‘আমি লোভপ্রযুক্ত শ্রমোপজীবীর ন্যায় এই ভার সংগ্রহ করিয়াছি। বিশেষতঃ আমাকে দূরপথে গমন করিতে হইবে। কিন্তু পথিমধ্যে ভক্ষণ করিয়া প্রাণধারণ করিতে পারি, এমন কোন খাদ্যদ্রব্যই দেখিতেছি না। অতএব এক্ষণে এই বককেই নিহত করা কর্ত্তব্য। ইহার দেহ মাংসরাশিতে পরিপূর্ণ। ঐ মাংসদ্বারা আমার অনায়াসেই পাথেয় নির্ব্বাহ হইবে।’ দুরাত্মা কৃতঘ্ন গৌতম মনে মনে এইরূপ দুরভিসন্ধি করিয়া রাজধৰ্ম্মের বিনাশসাধনার্থে গাত্রোত্থান করিলেন।”