৭৬তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের প্রাগজ্যোতিষপুরজয়
বৈশম্পায়ন বলিলেন, এইরূপে তিন দিন বজ্রদত্তের সহিত ধনঞ্জয়ের ঘোরতর সংগ্রাম হইল। পরিশেষে চতুর্থ দিন উপস্থিত হইলে মহাবলপরাক্রান্ত বজ্রদত্ত উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিয়া অৰ্জ্জুনকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “পাণ্ডুনন্দন! আর অধিকক্ষণ তোমাকে জীবিত থাকিতে হইবে না; আমি অবিলম্বেই তোমাকে নিপাতিত করিয়া তোমার শোণিতদ্বারা পিতার যথাবিধি তৰ্পণক্রিয়া সম্পাদন করিব। তুমি আমার বৃদ্ধ পিতা ভগদত্তকে সংহার করিয়াছ, কিন্তু আজ এই বালকের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও।” এই বলিয়া বজ্রদত্ত ক্রোধাবিষ্টচিত্তে অর্জ্জুনের অভিমুখে হস্তিসঞ্চালন করিলেন। গজবর বজ্রদত্তের অঙ্কুশাঘাতে তাড়িত হইয়া দূর হইতে অর্জ্জুনের উপর মদবারি নিক্ষেপ করিতে করিতে মহাবেগে তাহার প্রতি ধাবমান হইল।
মহাবীর ধনঞ্জয় সেই মত্তমাতঙ্গের শুণ্ডাগ্রবিনির্গত সলিলে সমাচ্ছন্ন হইয়া মেঘনির্ম্মুক্ত সলিলশীকরে সমাকীর্ণ নীলপৰ্ব্বতের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। অনন্তর সেই পর্ব্বতাকার গজরাজ মেঘের ন্যায় বারংবার গভীর শব্দ ও নৃত্য করিতে করিতে মহারথ অর্জ্জুনের নিকট সমুপস্থিত হইল। গাণ্ডীবধারী মহাবীর ধনঞ্জয় বজ্রদত্তের ভীষণ হস্তীকে সমাগত দেখিয়া কিছুমাত্র শঙ্কিত হইলেন না। ঐ সময় পূৰ্ব্ববৈর স্মরণ ও কার্য্যের ব্যাঘাত দর্শন করিয়া তাঁহার অন্তঃকরণে অতিশয় ক্রোধের উদয় হওয়াতে তিনি বেলা যেমন সমুদ্রের বেগ নিবারণ করে, তদ্রূপ শরনিকরদ্বারা সেই ভীষণ বারণকে [হস্তীকে] নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন সেই মত্তমাতঙ্গ অর্জ্জুনশরনিকরে সৰ্ব্বগাত্রে বিদ্ধ হইয়া কণ্টকাকীর্ণ শল্লকীর [সজারুর] ন্যায় শোভা ধারণ করিল।
এইরূপে সেই মাতঙ্গ অর্জ্জুনের শরে বিদ্ধ হইয়া নিতান্ত ব্যথিত হইলে মহাবীর বজ্রদত্ত ক্রোধাবিষ্টচিত্তে অর্জ্জুনের প্রতি অনবরত নিশিত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা অৰ্জ্জুনও সুশাণিত শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার বাণসমুদয় ছেদন করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে বহুক্ষণ সেই বীরদ্বয়ের তুমুল সংগ্রাম হইল। পরিশেষে মহাবীর বজ্রদত্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পুনর্ব্বার অর্জ্জুনের প্রতি সেই পৰ্ব্বতোপম হস্তীকে প্রেরণ করিলেন। ধনঞ্জয় ঐ নাগেন্দ্রকে পুনরায় সমীপে সমাগত হইতে দেখিয়া তাঁহার প্রতি এক অগ্নিতুল্য নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। তখন গজরাজ সেই অৰ্জ্জুননিক্ষিপ্ত নারাচের আঘাতে ভিন্নহৃদয় হইয়া বজ্রবিদারিত অচলের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। হস্তী ভূতলশায়ী হইলে মহাবীর বজ্রদত্তও তাঁহার সহিত ভূমিতলে নিপতিত হইলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বজ্রদত্ত! তোমার ভীত হইবার প্রয়োজন নাই। আমার আগমনসময়ে মহারাজ যুধিষ্ঠির আমাকে কহিয়াছিলেন, ভ্রাতঃ! তুমি সংগ্রামে ভূপতিগণ বা যোদ্ধাদিগকে নিপাতিত না করিয়া বিনয়পূৰ্ব্বক তাঁহাদিগকে কহিবে, মহাশয়গণ! মহারাজ যুধিষ্ঠির অশ্বমেধযজ্ঞ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, আপনারা অনুগ্রহপূর্ব্বক ঐ যজ্ঞে গমন করিবেন। হে ভগদত্তকুমার! আমি জ্যেষ্ঠভ্রাতার সেই বাক্যে অঙ্গীকার করিয়াছি বলিয়া এক্ষণে তোমাকে বিনাশ করিব না। তুমি নির্ভয়ে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক নির্ব্বিঘ্নে গৃহে গমন কর। আগামী চৈত্রপূর্ণিমাতে মহারাজ যুধিষ্ঠির যজ্ঞ আরম্ভ করিবেন। তোমাকে ঐ দিবস হস্তিনায় গমনপূর্ব্বক আমোদ-প্রমোদ করিতে হইবে।”
মহাবীর ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে, মহারাজ বজ্রদত্ত তথাস্তু বলিয়া তাঁহার বাক্য স্বীকার করিয়া গৃহে গমন করিলেন।