৭৪. অর্জ্জুনের ত্রিগৰ্ত্তদেশজয়

৭৪তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের ত্রিগৰ্ত্তদেশজয়

বৈশম্পায়ন বলিলেন, পূৰ্ব্বে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় যে সমুদয় বীর নিহত হইয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহাদিগের মহারথ পুত্রপৌত্রগণ আপনাদিগের অধিকারমধ্যে পাণ্ডবগণের যজ্ঞীয় অশ্ব সমাগত হইয়াছে শ্রবণ করিবামাত্র সকলে সুসজ্জিত হইয়া ঐ অশ্বকে পরিবেষ্টনপূৰ্ব্বক গ্রহণ করিবার উপক্রম করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন তাঁহাদিগের অভিপ্রায় অবগত হইয়া বিনয়বাক্যে তাঁহাদিগকে নিবারণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাঁহারা তাঁহার বাক্যে অনাস্থা প্রকাশ করিয়া তাঁহার প্রতি শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

মহাবীর ধনঞ্জয় যখন যজ্ঞীয় অশ্বের সহিত হস্তিনানগর হইতে বহির্গত হয়েন, সেই সময় ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহাকে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে নিহত ভূপতিগণের পুত্রপৌত্রদিগকে বিনাশ করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। এক্ষণে যুধিষ্ঠিরের সেই বাক্য স্মরণ হওয়াতে অৰ্জ্জুন ত্রিগৰ্ত্তদিগের শরবৃষ্টি সহ্য করিয়া হাস্যমুখে তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে অধার্ম্মিক ত্রিগর্ত্তগণ! তোমরা নিবৃত্ত হও; প্রাণরক্ষা করাই তোমাদিগের শ্ৰেয়ংকল্প।” মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপে বারংবার নিবারণ করিলেও ত্রিগর্ত্তগণ তাঁহার বাক্যে সম্মত হইল না। তখন অৰ্জ্জুন শরজালদ্বারা ত্রিগর্ত্তাধিপতি সূর্য্যবৰ্ম্মাকে পরাস্ত করিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। অনন্তর ত্রিগর্ত্তগণ রথচক্রের ঘর্ঘর-ঘোষে দিকসমুদয় প্রতিধ্বনিত করিয়া ধনঞ্জয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। সূর্য্যবৰ্ম্মাও স্বীয় হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক অর্জ্জুনের প্রতি একশত শর নিক্ষেপ করিলেন। ঐ সময় সূর্য্যবর্ম্মার অনুচরগণ অর্জ্জুনের, বিনাশকামনায় তাঁহার প্রতি অনবরত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত শরনিকরদ্বারা সেই সমুদয় শর ছেদনপূৰ্ব্বক তাঁহাদিগকে ভূতলে নিপাতিত করিলেন। অনন্তর সূর্য্যবৰ্ম্মার কনিষ্ঠভ্রাতা মহাবীর কেতুবৰ্ম্মা ভ্রাতার সাহায্যার্থ অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। মহারথ ধনঞ্জয় কেতুবৰ্ম্মাকে সমাগত দেখিয়া শরনিকরদ্বারা তাঁহাকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন।

মহাবীর কেতুবর্ম্মা পার্থশরে নিতান্ত ব্যথিত হইলে মহারথ ধৃতবর্ম্মা রথারূঢ় হইয়া সংগ্রামে প্রবেশপূৰ্ব্বক শরজালদ্বারা অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন মহাত্মা অৰ্জ্জুন ঐ বালকের অসামান্য হস্তলাঘব দর্শন করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। ঐ সময় ধৃতবর্ম্মা যে কোন সময়ে শরগ্রহণ, কোন্ সময়ে শরসন্ধান ও কোন্ সময়ে শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, অর্জ্জুন তাহার কিছুই লক্ষ্য করিতে পারিলেন না। তখন তিনি মনে মনে ধৃতবর্ম্মার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া তাঁহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন; কিন্তু তাহাকে নিতান্ত বালক দেখিয়া দয়া করিয়া উহার প্রাণ সংহার করিলেন না।

অনন্তর মহাবীর ধৃতবর্ম্মা অর্জ্জুনের হস্তে এক সুতীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করিলেন। অর্জ্জুন ঐ শরে বিদ্ধহস্ত ও বিমোহিত হওয়াতে তাঁহার হস্ত হইতে গাণ্ডীবশরাসন ভূতলে নিপতিত হইয়া ইন্দ্রচাপের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তদ্দর্শনে মহাবীর ধৃতবর্ম্মা আহ্লাদে উন্মত্ত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া হস্ত হইতে রুধির মার্জ্জন ও পুনরায় সেই শরাসন গ্রহণপূৰ্ব্বক অনবরত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। সংগ্রামদর্শক লোকসমুদয় তদ্দর্শনে ঘোরতর কোলাহল করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় অন্যান্য বীরগণ অৰ্জ্জুনকে কালান্তক যমের ন্যায় অবলোকন করিয়া ধৃতবর্ম্মার সাহায্যার্থ ধনঞ্জয়ের সম্মুখীন হইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টন করিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় বজ্রতুল্য লৌহনির্ম্মিত শরনিকরদ্বারা তাহাদিগের মধ্যে অষ্টাদশ যোদ্ধাকে নিহত করিলেন। ঐ অষ্টাদশ যোদ্ধা নিহত হইলে অন্যান্য যোধগণ নিতান্ত ভীত হইয়া সংগ্রাম হইতে নানাদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।।

মহাবীর অর্জ্জুন তাঁহাদিগকে পরাঙ্মুখ হইতে দেখিয়া পুনরায় তাঁহাদিগের প্রতি আশীবিষতুল্য শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহারথ ত্রিগৰ্ত্তগণ অর্জ্জুনশরে নিতান্ত নিপীড়িত ও ভগ্নোৎসাহ হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! আজ আমরা আপনার কিঙ্কর হইলাম। এক্ষণে আপনি আমাদিগকে যাহা আজ্ঞা করিবেন, আমরা তাহাই সম্পাদন করিব।”

ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় বীরগণ এইরূপে বিনয় প্রকাশ করিলে মহাবীর অর্জ্জুন তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে ভূপালগণ! তোমরা যখন আমার বশীভূত হইলে, তখন আমি কখনই তোমাদিগকে বিনাশ করিব না। অতঃপর আমাদের আজ্ঞানুসারে তোমাদিগকে কাৰ্য্য করিতে হইবে।” এই বলিয়া পাণ্ডুনন্দন সংগ্রাম হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।