৬১. অভিমন্যুনিধন-শ্রবণে বসুদেবের বিলাপ

৬১তম অধ্যায়

অভিমন্যুনিধন-শ্রবণে বসুদেবের বিলাপ

বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! মহাত্মা বাসুদেব এইরূপে পিতার নিকট সমুদয় ভারতযুদ্ধবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন; কিন্তু পাছে তিনি দৌহিত্রবধ শ্রবণ করিয়া দুঃখশোকে নিতান্ত অভিভূত হয়েন, এই ভয়ে অভিমন্যুর বধবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন না। ঐ সময় অভিমন্যুজননী সুভদ্রা তথায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি পুত্রের নিধনবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তিত হইল না দেখিয়া কৃষ্ণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি আমার অভিমন্যুর নিধনবিষয় কীৰ্ত্তন করিলে না কেন?” বসুদেবনন্দিনী এই বলিয়া তৎক্ষণাৎ ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন মহাত্মা বসুদেব কন্যাকে ধরাশায়িনী দেখিয়া দৌহিত্রশোকে নিতান্ত কাতর ও মূর্চ্ছিত হইয়া ধরাশয্যা গ্রহণ করিলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে সংজ্ঞালাভ করিয়া কৃষ্ণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তুমি সত্যবাদী হইয়াও কি নিমিত্ত অভিমন্যুর বধ কীৰ্ত্তন করিলে না? যাহা হউক, এক্ষণে সুভদ্রানন্দনের নিধনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিবার নিমিত্ত আমার মন নিতান্ত ব্যাকুল হইয়াছে; অতএব তুমি উহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।

শত্রুগণ আমার দৌহিত্রকে কিরূপে সংহার করিল? হায়! যখন, অভিমন্যুকে নিহত শ্রবণ করিয়া আমার হৃদয় শতধা বিদীর্ণ হইতেছে না, তখন নিশ্চয় বুঝিলাম, কাল পূর্ণ না হইলে কাহারও মৃত্যুগ্রাসে নিপতিত হইবার সম্ভাবনা নাই। আমার প্রিয় অভিমন্যু মৃত্যুসময়ে সংগ্রামমধ্যে তাহার জননী সুভদ্রা এবং আমাকে উদ্দেশ করিয়া কি কথা কহিয়াছিল? সংগ্রামে পরাঙ্মুখ হইয়া ত’ সে শত্ৰুকর্ত্তৃক নিহত হয় নাই? মরণকালে তাহার মুখমণ্ডল কি নিতান্ত বিকৃত হইয়াছিল? যে মহাতেজাঃ অভিমন্যু বিনীতভাবে আমার নিকট আত্মপরাক্রমের শ্লাঘা করিত, যে সৰ্ব্বদাই আমার নিকট ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণকে পরাজিত করিতে পারি বলিয়া স্পর্দ্ধা করিত; দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ প্রভৃতি মহাবীরগণ অন্যায় যুদ্ধে ত’ সেই বালককে বিনাশ করেন নাই?”

কৃষ্ণের বসুদেব-সান্ত্বনা

মহাত্মা বসুদেব দৌহিত্রশোকে এইরূপে নানাপ্রকার বিলাপ করিলে, ভগবান হৃষীকেশ দুঃখিতমনে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “পিতঃ! অভিমন্যু সংগ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কখন পলায়ন করে নাই। তাহার মুখ সততই অবিকৃত ছিল। সেই মহাবীর সংগ্রামে অসংখ্য ভূপতিকে নিপাতিত করিয়াছে। যদি এক এক বীর তাহার সহিত যুদ্ধ করিতেন, তাহা হইলে সে কখনই পরাজিত হইত না। বজ্রধারী ইন্দ্রও একাকী যুদ্ধ করিয়া তাহাকে বিনাশ করিতে সমর্থ নহেন। অর্জ্জুন আমার উপদেশানুসারে সংশপ্তকযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে দ্রোণ প্রভৃতি সপ্তরথী ক্রুদ্ধ হইয়া সেই বালক সুভদ্রানন্দনের চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টনপূৰ্ব্বক এককালে তাহাকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়াছিলেন। তাহাতেই দুঃশাসনতনয় তাহার প্রাণ সংহার করিয়াছে। আপনার সেই প্রিয় দৌহিত্র যখন সমরে অসংখ্য শত্রুকে নিপাতিত করিয়া প্রাণপরিত্যাগ করিয়াছে, তখন নিশ্চয়ই তাহার স্বর্গলাভ হইয়াছে; অতএব তাহার নিমিত্ত শোক করা আপনার কখনই কর্ত্তব্য নহে। মহাত্মারা কদাচ শোক-মোহের বশীভূত হয়েন না। মহাবীর অভিমন্যু মহেন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতি বীরগণের সহিত অনায়াসে যুদ্ধ করিয়াছিল; সুতরাং তাহার যে বীরগতিলাভ হইয়াছে, তদ্বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। এক্ষণে আপনি শোক পরিত্যাগ করিয়া শান্তভাব অবলম্বন করুন।

বসুদেব-শোকলাঘবার্থ সুভদ্রাদির শোক-উল্লেখ

“ঐ মহাবীর সমরশয্যায় শয়ন করিলে ভগিনী সুভদ্রা পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া অন্যান্য কৌরবকুলকামিনীগণের সহিত রণস্থলে গমনপূৰ্ব্বক উহার মৃতদেহ ক্রোড়ে সংস্থাপন করিয়া কুররীর ন্যায়: রোদন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় দ্রুপদনন্দিনী তাহার নিকট সমুপস্থিত হইয়া শোকাকুলিতচিত্তে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “আর্য্যে! এক্ষণে পুত্রগণ কোথায়? তাহাদিগকে দুৰ্শন করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে। দ্রৌপদী এই কথা কহিবামাত্র সমুদয় কুরুবনিতা ভুজদ্বারা তাঁহাকে ধারণপূৰ্ব্বক মুক্তকণ্ঠে রোদন করিতে লাগিলেন। অনন্তর সুভদ্রা উত্তরাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘বৎসে! এক্ষণে তোমার ভর্ত্তা কোথায়? তুমি অবিলম্বে তাহার নিকট আমার আগমনবাৰ্তা কীৰ্ত্তন কর। বৎস অভিমন্যু প্রতিদিন আমার বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র গৃহ হইতে বহির্গত হইত; আজ কি নিমিত্ত আগমন করিতেছে না? হা বৎস! তুমি যুদ্ধার্থী হইয়া এই স্থানে আগমন করিলে তোমার মহারথ মাতুলগণ বারংবার তোমাকে মঙ্গলাশীর্ব্বাদ করিয়াছিলেন। তুমি প্রতিদিন আমার নিকট সমুদয় যুদ্ধবৃত্তান্ত আনুপূৰ্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতে; কিন্তু আজ আমাকে এইরূপ বিলাপ করিতে দেখিয়াও উত্তর প্রদান করিতেছ কেন? এই বলিয়া সুভদ্রা শোকে নিতান্ত কাতর হইলেন।

“তখন পাণ্ডবজননী কুন্তী সুভদ্রাকে আত্তস্বরে রোদন করিতে দেখিয়া সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎসে! বাসুদেব, সাত্যকি ও অর্জ্জুন অভিমন্যুকে জীবিত রাখিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহার আয়ুঃশেষ হইয়াছিল বলিয়া তাহাকে রক্ষা করিতে পারেন নাই। মনুষ্যমাত্রকেই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হয়। অতএব তুমি পুত্রের নিমিত্ত আর শোক করিও না। তোমার পুত্র সংগ্রামে দেহত্যাগ করিয়া পরমগতি লাভ করিয়াছে। মহাত্মা ক্ষত্রিয়াদিগের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া পুত্রশোকে এরূপ ব্যাকুল হওয়া তোমার কখনই কর্ত্তব্য নহে। তোমার বধু উত্তরা গর্ভবতী হইয়াছেন, ইনি অবিলম্বেই এক সুকুমার নবকুমার প্রসব করিবেন।

‘মহানুভবা কুন্তী সুভদ্রাকে এইরূপ আশ্বাস প্রদান করিয়া শোকসংবরণপূর্ব্বক অভিমন্যুর শ্রাদ্ধবিধি সমাপন এবং যুধিষ্ঠির, অর্জ্জুন, ভীম, নকুল ও সহদেবের বাক্যানুসারে ব্রাহ্মণদিগকে বিবিধ রত্ন ও অসংখ্য ধেনুদান করিলেন। তৎপরে তিনি বিরাটদুহিতা উত্তরাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎসে! তুমি পতির নিমিত্ত আর শোক করিও না। এক্ষণে গর্ভস্থ বালককে রক্ষা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য।” যশস্বিনী কুন্তী এই বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন। তৎপরে আমি তাহার আজ্ঞানুসারে সুভদ্রার সহিত এই স্থানে সমুপস্থিত হইয়াছি। এই আমি আপনার নিকট অভিমন্যুর নিধনবৃত্তান্ত সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে আপনি শোক সংবরণ করিয়া মনস্থির করুন।”