৭৭. দেবগণ-সাহায্যে অর্জ্জুনের সিন্ধুযুদ্ধজয়

৭৭তম অধ্যায়

দেবগণ-সাহায্যে অর্জ্জুনের সিন্ধুযুদ্ধজয়

বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! অতঃপর হতাবশিষ্ট সিন্ধুদেশীয় যোধগণের সহিত অর্জ্জুনের যেরূপ ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যজ্ঞীয় অশ্ব সিন্ধুদেশে প্রবিষ্ট হইলে মহাবীর অর্জ্জুনও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ তথায় সমুপস্থিত হইলেন। তখন সিন্ধুদেশীয় ভূপালগণ অর্জ্জুনকে আপনাদিগের অধিকারমধ্যে সমাগত দেখিয়া তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিবার মানসে নির্ভয়চিত্তে নগর হইতে বহির্গমনপূৰ্ব্বক সেই যজ্ঞীয় অশ্বকে ধারণ করিলেন। ঐ সময় অশ্বরক্ষক মহাবীর ধনঞ্জয় তাঁহাদিগের অবিদূরে [নিকটে] ভূতলে দণ্ডায়মান ছিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত রথারূঢ় সৈন্ধবগণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের নিধন ও আপনাদিগের পরাজয় বৃত্তান্ত স্মরণপূর্ব্বক জিগীষু [জয়াভিলাষী] হইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া স্ব স্ব নাম, গোত্র ও কাৰ্য্যসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতে করিতে তাহার প্রতি শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু মহাবীর ধনঞ্জয় তৎকালে তাহাদের একটিও শরনিক্ষেপ করিলেন না।

অৰ্জ্জুন এইরূপে যুদ্ধে অনাস্থা প্রদর্শন করিলেও সৈন্ধবগণ [সিন্ধুদেশবাসীরা] রণে ক্ষান্ত হইলেন না; প্রত্যুত এককালে সহস্র রথ ও অযুত অশ্বদ্বারা পাণ্ডুতনয়কে পরিবেষ্টনপূৰ্ব্বক মহাহ্লাদে তাঁহার প্রতি শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় ঐ বীরগণের শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া মেঘপরিবৃত সূৰ্য্য ও পিঞ্জর মধ্যগত পক্ষীর ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। ঐ সময় তাঁহার গাত্রে অসংখ্য বাণ বিদ্ধ হওয়াতে তাঁহার কষ্টের পরিসীমা রহিল না। মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপে বাণবিদ্ধ ও নিতান্ত নিপীড়িত হইলে ত্রিলোকমধ্যে হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। দিবাকর প্রভাশূন্য হইলেন। বায়ু প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল। রাহু এককালে চন্দ্র ও সূৰ্য্য উভয়কেই গ্রাস করিল। উল্কাসমুদয় চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইয়া সূৰ্য্যকে নিপীড়িত করিতে লাগিল। কৈলাসপর্ব্বত কম্পিত হইয়া উঠিল। সপ্তর্ষিমণ্ডল ও দেবর্ষিগণ দুঃখশোকসমন্বিত ও ভীত হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। চন্দ্রমণ্ডল আকাশ ভেদ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। দিকসমুদয় ধূমাচ্ছন্ন হইয়া বিপরীত ভাব ধারণ করিল এবং নভোমণ্ডল অকস্মাৎ বিদ্যুৎ ও ইন্দ্রায়ুধ-সম্বলিত অরুণবর্ণ মেঘজাল উদিত হইয়া মাংস ও শোণিত বর্ষণ করিতে লাগিল।

এইরূপে বিবিধ দুর্নিমিত্ত প্রাদুর্ভূত হইলে মহাত্মা অর্জ্জুন নিতান্ত মোহাক্রান্ত হইলেন এবং তাঁহার হস্ত হইতে গাণ্ডীবশরাসন ও বলয় ভূমিতলে নিপতিত হইল। তদ্দর্শনে সিন্ধুদেশীয় মহারথগণ যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া তাঁহার প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন দেবগণ অর্জ্জুনকে নিতান্ত দুর্দ্দশাগ্রস্ত দেখিয়া ব্যাকুলচিত্তে তাঁহার শান্তিকার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন এবং ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি ও সপ্তর্ষিগণ তাঁহার বিজয়লাভের নিমিত্ত মন্ত্রজপ করিতে লাগিলেন।

এইরূপে দেবগণ অর্জ্জুনের বলাধানবিষয়ে [বলবৃদ্ধির জন্য] যত্নবান্ হইলে অচিরাৎ তাঁহার মোহ দূরীভূত হইল। তখন তিনি সেই গাণ্ডীবধনু গ্রহণ ও আকর্ষণপূর্ব্বক বারংবার ভীষণ জ্যাশব্দ করিয়া, পুরন্দর যেমন বারিবর্ষণ করেন, তদ্রূপ বীরগণের প্রতি অনবরত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। বীরগণ সেই অৰ্জ্জুননিক্ষিপ্ত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া শলভনিচয়সমাকীর্ণ পাদপসমূহের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলে এবং অচিরাৎ তাঁহার জ্যাশব্দে নিতান্ত ভীত ও শরাঘাতে একান্ত ব্যথিত হইয়া অশ্রু পরিত্যাগপূৰ্ব্বক শোকাকুলিতচিত্তে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন শরনিকরদ্বারা তাঁহাদিগকে নিপীড়িত করিয়া সংগ্রামমধ্যে অলাতচক্রের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় তাঁহার শরনিকরে দিক্‌মুদয় সমাচ্ছন্ন হইল এবং তিনি শরজালদ্বারা সেই মেঘজালসদৃশ সৈন্যসমুদয়কে বিদারণপূৰ্ব্বক শরৎকালীন সূর্য্যের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন।