৯১তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরযজ্ঞে নকুলের অশ্রদ্ধার কারণ জিজ্ঞাসা
জনমেজয় কহিলেন, ভগব। ভূপতিগণ যজ্ঞানুষ্ঠান, মহর্ষিগণ তপানুষ্ঠান ও অন্যান্য বিশুদ্ধবুদ্ধি ব্রাহ্মণগণ শান্তিগুণ অবলম্বন করিয়া উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিয়া থাকেন। সুতরাং আমার মতে যজ্ঞানুষ্ঠান দানাদিসমুদয় কার্য্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। পূৰ্ব্বকালে অনেকানেক ভূপতি বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া ইহলোকে কীর্ত্তিসংস্থাপনপূৰ্ব্বক স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। দেবরাজ ইন্দ্র অসংখ্য বহুদক্ষিণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াই সমুদয় দেবরাজ্যের অধিপতি হইয়াছেন। অতএব ইন্দ্রতুল্য প্রভাবশালী মহারাজ যুধিষ্ঠির ভীমার্জ্জুনসমভিব্যাহারে সুসমৃদ্ধ অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলে, নকুল সেই যজ্ঞের নিন্দা করিল কেন, আপনি তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ। যজ্ঞের বিধি ও যজ্ঞফলের বিষয় আপনার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। পূৰ্ব্বকালে দেবরাজ ইন্দ্র মহাসমারোহে যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ঐ যজ্ঞ আরম্ভ হইলে ঋত্বিকগণ স্ব স্ব কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। গুণসমন্বিত হোতারা হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন, দেবগণ আহুত হইতে লাগিলেন এবং অধ্বর্য্যুগণ [যজুর্ব্বেদী পাঠক] উৎকৃষ্টস্বরে, যজুর্ব্বেদপাঠে প্রবৃত্ত হইলেন।
অনন্তর পশুবধের সময় সমুপস্থিত হইলে মহর্ষিগণ পশুদিগকে নিতান্ত কাতর দেখিয়া দয়ার্দ্রচিত্তে ইন্দ্রকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “দেবরাজ! এরূপ যজ্ঞানুষ্ঠান কখনই মঙ্গলকর নহে। পরম ধৰ্মলাভ করিতে বাসনা করিয়া এরূপ কার্য্যে প্ৰবৃত্ত হওয়াতে আপনার অনভিজ্ঞতা প্রকাশ হইতেছে। যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলে আপনাকে নিশ্চয়ই ধর্ম্মভ্রষ্ট হইতে হইবে। ইহাদ্বারা কখনই আপনার ধর্ম্মলাভ হইবে না। অতএব যদি আপনি ধৰ্মলাভ করিতে বাসনা করেন, তাহা হইলে শাস্ত্রানুসারে ত্রৈবার্ষিক বীজদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করুন। ঐরূপে যজ্ঞানুষ্ঠান করিলে পরমধর্ম্ম ও মহৎ ফল লাভ করা যায়।”
যজ্ঞে পশুবধে বাদানুবাদ—চেদিরাজের অবিচার
তত্ত্বদর্শী মহর্ষিগণ এই কথা কহিলে, মহাত্মা শতক্রতু মোহবশতঃ তাঁহাদিগের বাক্যে শ্রদ্ধা করিলেন না। তখন তাপসগণ কেহ কেহ স্থাবর [শস্য] পদার্থদ্বারা ও কেহ কেহ জঙ্গম [পশু] পদার্থদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য বলিয়া ঘোরতর বাদানুবাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর তাঁহারা সকলেই বিবাদভঞ্জনের নিমিত্ত দেবরাজের সহিত চেদিরাজ বসুর নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! শাস্ত্রে যজ্ঞানুষ্ঠানের কিরূপ বিধি নির্দ্দিষ্ট আছে, তাহা আমাদিগের নিকট কীৰ্ত্তন করুন। আমরা কেহ কেহ পশুদ্বারা এবং কেহ কেহ বীজ ও ঘৃতদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য বলিয়া পরস্পর বিবাদ করিয়া আপনার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি।”
মহর্ষিগণ এই কথা কহিলে, চেদিরাজ বসু তাঁহাদিগের বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বিপ্রগণ! যখন যে বস্তু উপস্থিত হইবে, তখন তদ্দারাই যজ্ঞানুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য।”
চেদিরাজ বসু এইরূপ মিথ্যাবাক্য কীৰ্ত্তন করাতে তাঁহাকে অচিরাৎ রসাতলে গমন করিতে হইল। অতএব সৰ্ব্বলোক পিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা ভিন্ন আর কোন ব্যক্তি যেন বহুদর্শী হইয়াও সহসা সংশয়াত্মক কার্য্যের মীমাংসা না করে। যে ব্যক্তি পাপানুষ্ঠাননিরত ও অশুদ্ধচিত্ত হইয়া অনাস্থাপূৰ্ব্বক বিবিধ বস্তু দান করে, তাহার সমুদয় দানফল বিনষ্ট হইয়া যায়। অধার্ম্মিক হিংসাপরায়ণ দুরাত্মারা দান করিয়া কখনও ইহলোক ও পরলোকে কীৰ্ত্তিলাভ করিতে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি অধৰ্ম্মানুসারে দ্রব্যসমুদয় উপার্জ্জনপূর্ব্বক ধর্ম্মলাভে সন্দিহান হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করে, তাহাকে অবশ্যই ধৰ্ম্মফলে বঞ্চিত হইতে হয়। কপট ধার্ম্মিক পাপপরায়ণ নরাধমেরা কেবল লোকের বিশ্বাসের নিমিত্ত ব্রাহ্মণদিগকে দান করিয়া থাকে। যে ব্রাহ্মণ যথেচ্ছাচারী ও মোহসমন্বিত হইয়া পাপকাৰ্য্যদ্বারা অর্থোপার্জ্জন করে, তাহাকে নিঃসন্দেহ নিরয়গামী হইতে হয়। দুরাত্মারা লোভমোহের বশবর্ত্তী হইয়া অর্থসঞ্চয়ের নিমিত্ত পাপাচরণপূৰ্ব্বক প্রাণীগণকে উত্তেজিত করিয়া থাকে।
যে ব্যক্তি মোহাক্রান্ত হইয়া অধৰ্ম্মানুসারে অর্থলাভপূৰ্ব্বক দান বা যজ্ঞানুষ্ঠান করে, সে পরলোকে কখনই তাহার ফলভোগ করিতে সমর্থ হয় না। কিন্তু মহাত্মা মহর্ষিগণ সাধ্যানুসারে উঞ্ছবৃত্তিলব্ধ ফল, মূল, শাক ও জল দান করিয়াই অনায়াসে স্বর্গারোহণ করিতে সমর্থ হয়েন। পণ্ডিতেরা এইরূপ দানকে সনাতন ধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। মহাযোগ, দয়া, ব্রহ্মচর্য্য, সত্য, ধৈৰ্য্য ও ক্ষমা এ সমুদয়ই সনাতন ধর্ম্মের মূল। পূৰ্ব্বে অসংখ্য মহর্ষি এবং বিশ্বামিত্র, অসিত জনক, কক্ষসেন, আর্ষ্টিসেন ও সিন্ধদ্বীপ প্রভৃতি ভূপালগণ ন্যায়লব্ধ বস্তুসমুদয় দান ও সত্য ব্যবহার করিয়া পরমগতি লাভ করিয়াছেন। ফলতঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারিবর্ণই তপস্যায় অনুরক্ত হইয়া বিশুদ্ধচিত্তে ন্যায়লব্ধ বস্তু প্রদান করিলে অনায়াসে স্বর্গলাভে সমর্থ হইতে পারেন, সন্দেহ নাই।