৬৮. উত্তরার বিলাপ—পুত্ররক্ষাৰ্থ পুনঃ পুনঃ প্রার্থনা

৬৮তম অধ্যায়

উত্তরার বিলাপ—পুত্ররক্ষাৰ্থ পুনঃ পুনঃ প্রার্থনা

বৈশম্পায়ন বলিলেন, মনস্বিনী সুভদ্রা এইরূপে করুণস্বরে বিলাপ করিলে মহাত্মা বাসুদেব নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ‘অভিমন্যুর মৃতপুত্রকে জীবিত করিব’ বলিয়া অঙ্গীকার করিলেন। তখন তাঁহার সেই অমৃতময় বাক্যশ্রবণে অন্তঃপুরস্থ লোকসমুদয়ের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। তখন মহাত্মা হৃষীকেশ অবিলম্বে অভিমন্যুতনয়ের জন্মভূবনে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, ঐ গৃহ বিবিধ মাল্যদ্বারা যথাবিধি অর্চ্চিত হইয়াছে; উহার চতুর্দ্দিকে পূর্ণকুম্ভ, ঘৃত, তিন্দুক [গাব—গাব কাঠের অগ্নির উগ্র উত্তাপ সদ্যপ্রসূত শিশুর তাপদানে বিশেষ উপযোগী] কাষ্ঠের অঙ্গার, সর্ষপ ও শাণিত অস্ত্র প্রভৃতি রক্ষোঘ্ন দ্রব্যসমুদয় বিকীর্ণ রহিয়াছে, স্থানে স্থানে হুতাশন প্রজ্বলিত হইতেছে এবং বৃদ্ধা নারী ও চিকিৎসানিপুণ বৈদ্যগণ তথায় অবস্থান করিতেছেন।

বাসুদেব ঐ গৃহের ঐরূপ সজ্জা দেখিয়া প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে বারংবার সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় দ্রৌপদী সত্বর বিরাটতনয়া উত্তরার নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎসে! এই দেখ, তোমার শ্বশুর অচিন্তাত্মা অপরাজিত ভগবান্ মধুসূদন তোমার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছেন।” যাজ্ঞসেনী এই কথা কহিবামাত্র বাষ্পকুললোচনা বিরাটনন্দিনী উত্তরা অশ্রুসংবরণ করিয়া, বস্ত্রাবৃত হইয়া ভগবান্ বাসুদেবকে দর্শনপূৰ্ব্বক করুণস্বরে কহিলেন, “ভগবন্! কেবল আমার পতি অভিমন্যু যে কালকবলে নিপাতিত হইয়াছেন, এরূপ নহেন, আজ আমাকেও পুত্রশোকে তাঁহার অবস্থা প্রাপ্ত হইতে হইল। এক্ষণে আমি বারংবার আপনাকে প্রণিপাত করিতেছি, আপনি প্রসন্ন হইয়া আমার এই ব্রহ্মাস্ত্রদগ্ধ কুমারকে জীবিত করুন। যদি পূৰ্ব্বে ধর্ম্মরাজ, ভীমসেন বা আপনি অশ্বত্থামাকে কহিতেন যে, এই ইষীকাদ্বারা উত্তরার প্রাণনাশ হউক, তাহা হইলে আমার প্রাণবিয়োগই হইত। কিন্তু আমাকে কখনই এরূপ যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইত না।

“হায়! ব্রহ্মাস্ত্রদ্বারা আমার এই গর্ভস্থ বালককে নিপাতিত করিয়া ব্রাহ্মণাধম দুর্ব্বুদ্ধি অশ্বত্থামার কি ফললাভ হইল? যাহা হউক, এক্ষণে আমি আপনার শরণাপন্ন হইলাম। যদি আপনি আমার পুত্রকে পুনর্জ্জীবিত না করেন, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই আপনার সমক্ষে প্রাণ পরিত্যাগ করিব। আমি এই কুমারে যাহা যাহা প্রত্যাশা করিয়াছিলাম, দ্রোণপুত্র তৎসমুদয়ই উচ্ছিন্ন করিয়াছেন, সুতরাং এক্ষণে আমার আর জীবনধারণে প্রয়োজন কি! আমি মনে করিয়াছিলাম যে, পুত্রকে ক্রোড়ে করিয়া তাহাকে আপনার চরণে প্রণিপাত করাইব, কিন্তু আমার ভাগ্যে তাহা ঘটিয়া উঠিল না। ফলতঃ আমার মনে যেসমুদয় আশা ছিল, মৃতপুত্রনিরীক্ষণে তৎসমুদয়ই এককালে উচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে আপনি একবার আমার এই ব্রহ্মাস্ত্র-নিপাতিত পুত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। এই পুত্র ইহার পিতার ন্যায় নৃশংস ও কৃতঘ্ন। তাহা না হইলে আজ এই পাণ্ডবকুলের বিপুল সম্পত্তি পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরলোকে প্রস্থান করিল কেন? হায়! আমার তুল্য জীবিতপ্রিয় নৃশংস রমণী আর কেহই নাই। আমার পতি অভিমন্যু সংগ্রামশায়ী হইলে আমি অচিরাৎ তাঁহার অনুগামিনী হইব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া তাহা পূর্ণ করিলাম না। এক্ষণে আমি দেহত্যাগ করিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে তিনি আমাকে কি বলিবেন?”