৮৭. অর্জ্জুনের আজন্মভ্রমণক্লেশের কারণকথন

৮৭তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের আজন্মভ্রমণক্লেশের কারণকথন

বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহাত্মা মধুসূদন এই কথা কহিলে, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির আহ্লাদিতচিত্তে সেই বাক্যে সম্মতি প্রকাশপূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বাসুদেব! তোমার অমৃতময় প্রিয়বাক্য-শ্রবণে আমার চিত্ত প্রফুল্লিত হইল। যাহা হউক, এক্ষণে যজ্ঞীয় অশ্ব লইয়া অনেকানেক নরপতির সহিত পুনরায় অর্জ্জুনের যুদ্ধ হইয়াছে, শ্রবণ করিয়া আমার মনে এই চিন্তা জন্মিয়াছে যে, কি নিমিত্ত ধনঞ্জয়কে প্রতিনিয়ত এতাদৃশ দুঃখভোগ করিতে হয়? তাহার সেই সুলক্ষণাক্রান্ত শরীরমধ্যে কি এমন কোন অশুভলক্ষণ। বিদ্যমান আছে যে, তন্নিবন্ধন তাঁহাকে নিয়ত এতাদৃশ কষ্টভোগ করিতে হয়? আমি ত’ একাল পর্য্যন্ত তাহার গাত্রে কোন অশুভ লক্ষণ দর্শন করি নাই। এক্ষণে যে কারণে ধনঞ্জয়কে বারংবার বহুতর কষ্টভোগ করিতে হইতেছে, যদি আমার নিকট উহা ব্যক্ত করিবার কোন বাধা না থাকে তাহা হইল ব্যক্ত কর।”

রাজা যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, ভোজবংশাবতংস মহাত্মা হৃষীকেশ বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! অৰ্জ্জুনের পিণ্ডিকাদ্বয় কিঞ্চিৎ মাংসল, ইহা ব্যতীত আর আমি উহার কোন অশুভ লক্ষণ দেখিতেছি না। ঐ পিণ্ডিকাদ্বয়ের স্থূলতানিবন্ধন অর্জ্জুন নিয়ত পথভ্রমণ করিয়া থাকে।” মহাত্মা মধুসুদন এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহার বাক্যে আস্থা প্রদর্শনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বাসুদেব! তুমি যথার্থ কহিয়াছ। ঐ সময় দ্রৌপদী অসূয়াপ্রকাশপূৰ্ব্বক তির্য্যগভাবে কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। অর্জ্জুনের সখা মহাত্মা হৃষীকেশও প্রফুল্লচিত্তে তাঁহার সেই প্রণয়দৃষ্টিপাত প্রতিগ্ৰহ করিলেন। তখন ভীমসেন প্রভৃতি কৌরব ও তত্ৰত্য যাজকগণও অর্জ্জুনের ঐ কথা লইয়া আন্দোলন করিতে লাগিলেন।

অশ্বসহ অর্জ্জুনের যজ্ঞভূমিতে আগমন

এইরূপে সকলে ধনঞ্জয়ের বিষয়ে কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময়ে মহাত্মা অর্জ্জুনের এক দূত তথায় উপস্থিত হইয়া নমস্কারপূর্ব্বক কহিল, “মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন অশ্ব লইয়া নগর সমীপে সমুপস্থিত হইয়াছেন।” তখন রাজা যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনের আগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিবামাত্র আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইয়া সেই প্রিয় সংবাদদাতা দূতকে প্রভূত অর্থ প্রদান করিতে আদেশ করিলেন। পরদিন প্রভাতে কৌরবধুরন্ধর মহাবীর অর্জ্জুন অশ্ব লইয়া নগরমধ্যে আগমন করিতে আরম্ভ করিলে, উচ্চৈঃশ্রবার ন্যায় সেই যজ্ঞীয় অশ্বের পদরেণু উত্থিত হইয়া পরম শোভা ধারণ করিল। তখন পুরবাসী লোকসমুদয় মহা আহ্লাদিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “ধনঞ্জয়! আমার সৌভাগ্যবশতঃ আজ আপনাকে নির্ব্বিঘ্নে আগমন করিতে দেখিলাম। আজ মহারাজ যুধিষ্ঠির ধন্য হইলেন। আপনি ভিন্ন আর কোন ব্যক্তি পৃথিবীস্থ ভূপাল সমুদয়কে পরাজিত করিয়া, নির্ব্বিঘ্নে অশ্ব লইয়া প্রত্যাগমন করিতে পারে? সগর প্রভৃতি যে সমুদয় মহাত্মা মহীপতি স্বর্গারোহণ করিয়াছেন, তাঁহাদিগেরও এরূপ অদ্ভুত কাৰ্য্য আমাদের শ্রুতিগোচর হয় নাই এবং পরে যেসমুদয় ভূপতি রাজ্যভার গ্রহণ করিবেন, তাঁহারাও আপনার ন্যায় এইরূপ দুষ্কর কার্য্যের অনুষ্ঠানে কদাচ সমর্থ হইবেন না।”

ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা ধনঞ্জয় হস্তিনাবাসী প্রজাগণের মুখে এইরূপে শ্রুতিসুখকর প্রশংসাবাক্য শ্রবণ করিতে করিতে যজ্ঞভূমিতে সমুপস্থিত হইলেন। মহাত্মা যুধিষ্ঠির ও বাসুদেব তাঁহাকে সমাগত দেখিয়া অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রসর করিয়া অমাত্যগণসমভিব্যাহারে প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে আনয়ন করিলেন। তখন ধর্ম্মপরায়ণ ধনঞ্জয় সর্ব্বাগ্রে জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের চরণবন্দনপূৰ্ব্বক পশ্চাৎ যুধিষ্ঠির ও ভীমসেনকে যথাবিধি অভিবাদন এবং বাসুদেব, নকুল ও সহদেবকে আলিঙ্গন করিয়া তাঁহাদিগের সহিত বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মণিপুরাধিপতি মহারাজ বভ্রুবাহন মাতা চিত্রাঙ্গদা ও বিমাতা উলুপীর সহিত হস্তিনায় সমুপস্থিত হইয়া তত্রত্য বৃদ্ধ কৌরব ও অন্যান্য ভূপতিদিগকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক তাঁহাদিগের আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিলেন।