৫৬ম অধ্যায়
উতঙ্কের তপোবল বৃত্তান্ত
জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! মহর্ষি উতঙ্ক এমন কি তপানুষ্ঠান করিয়াছিলেন যে, তিনি গৰ্ব্বিত হইয়া জগদ্গুরু বিষ্ণুকেও শাপপ্রদানে উদ্যত হইলেন?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহর্ষি উতঙ্ক ঘোরতর তপস্যায় আসক্ত ও একান্ত গুরুভক্তিপরায়ণ ছিলেন। তিনি গুরুভিন্ন আর কাহারও অর্চ্চনা করিতেন না। ঐ মহাত্মার গুরুগৃহে বাসের সময় অন্যান্য ঋষিপুত্রগণ তাঁহার গুরুভক্তির পরকাষ্ঠাদর্শনে তাঁহার ন্যায় গুরুভক্তিপরায়ণ হইতে সতত বাসনা করিতেন। মহর্ষি গৌতম সমুদয় শিষ্য অপেক্ষা উতঙ্কের প্রতি সমধিক প্রীতি ও স্নেহ প্রকাশ করিতেন। তিনি উতঙ্কের দমগুণ, পবিত্রতা, সাহসিক কার্য্য ও পূজাদ্বারা যারপরনাই প্রীত হইয়াছিলেন। ঐ মহর্ষির সহস্র সহস্র শিষ্য ছিল। তিনি ক্রমে ক্রমে তাঁহাদের সকলকে কৃতবিদ্য দেখিয়া গৃহে গমন করিতে আদেশ করিলেন; কিন্তু স্নেহপ্রযুক্ত উতঙ্ককে গৃহগমনে অনুমতি করিলেন না। ক্রমে উতঙ্কের বৃদ্ধাবস্থা সমুপস্থিত হইল, কিন্তু একান্ত গুরুভক্তিপ্রভাবে উতঙ্ক উহা অবগত হইতে পারিলেন না।
অনন্তর একদা ঐ মহাত্মা কাষ্ঠানয়নার্থ গমন করিয়া অনতিবিলম্বে মস্তকে এক বৃহৎ কাষ্ঠভার গ্রহণপূর্ব্বক আশ্রমে প্রত্যাগত হইলেন। ঐ কাষ্ঠভারবহননিবন্ধন তিনি একান্ত ক্লান্ত এ নিতান্ত ক্ষুধার্ত্ত হইয়াছিলেন; সুতরাং আশ্রমে প্রত্যাগমন করিয়া অতি সত্বর উহা ভূতলে নিক্ষেপ করিলেন। ঐ সময় তাঁহার রৌপ্যশলাকাসদৃশ একটি জটা সেই মস্তকস্থিত কাষ্ঠের সহিত দৃঢ়রূপে সংলগ্ন হইয়াছিল। তিনি ব্যগ্রতাসহকারে কাষ্ঠভার
নিক্ষেপ করাতে উহা সেই কাষ্ঠের সহিত ভূতলে নিপতিত হইল। তখন মহাত্মা উতঙ্ক সেই জটার শুক্লতা দর্শনে আপনাকে নিতান্ত বৃদ্ধ বিবেচনা করিয়া আক্তস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহর্ষি গৌতমের কন্যা স্বীয় পিতার আদেশানুসারে দ্রুতবেগে আগমনপূৰ্ব্বক নতমস্তক হইয়া অঞ্জলিদ্বারা তাঁহার নয়নজল ধারণ করাতে অচিরাৎ উহা তাঁহার করযুগল দগ্ধ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তখন পৃথিবী অতিকষ্টে উতঙ্কের সেই নয়নবারি ধারণ করিতে লাগিলেন।
এইরূপে উতঙ্কের অসাধারণ তেজঃ প্রকটিত হইলে মহর্ষি গৌতম যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! আজ তুমি কি নিমিত্ত শোকাকুল হইলে?” তখন উতঙ্ক কহিলেন, “ভগবন্! আমি আপনার প্রিয়চিকীর্ষা, আপনার প্রতি একান্ত ভক্তি ও একাগ্রচিত্ততানিবন্ধন আমার যে, বার্দ্ধক্য উপস্থিত হইয়াছে, তাহাও অনুধাবন করিতে সমর্থ হই নাই। আমি অদ্যাপি সুখের লেশমাত্রও অনুভব করিতে পারিলাম না। আপনার নিকট আমার একশত বৎসর অতিবাহিত হইল। ইহার মধ্যে আপনি আমার বয়ঃকনিষ্ঠ কত শত শিষ্যকে গৃহে গমন করিতে অনুমতি প্রদান করিয়াছেন, কিন্তু এতকাল পর্য্যন্ত আমাকে গৃহে গমন করিতে অনুমতি প্রদান করিলেন না। এই নিমিত্ত আমি অতিশয় দুঃখিত হইয়াছি।”
উতঙ্কের সমাবর্ত্তন—গুরুদক্ষিণাদানে প্রবৃত্তি
মহাত্মা উতঙ্ক এইরূপ আক্ষেপ করিলে মহর্ষি গৌতম তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! আমি তোমার শুশ্রূষায় একান্ত প্রীত হইয়াছিলাম বলিয়া এত দীর্ঘকাল যে অতিবাহিত হইয়াছে, তাহা অবগত হইতে পারি নাই। যাহা হউক, এক্ষণে যদি তোমার গৃহে গমনের বাসনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমি অনুজ্ঞা করিতেছি, তুমি অচিরাৎ গৃহে গমন কর আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই।”
উতঙ্ক কহিলেন, “ভগবন্! আমি গুরুদক্ষিণাস্বরূপ আপনাকে কি প্রদান করিব, তাহা আদেশ করুন। আমি আপনার আদেশানুসারে অচিরাৎ উহা আহরণপূর্ব্বক আপনাকে অর্পণ করিয়া গৃহে প্রতিগমন করিব।”
তখন গৌতম কহিলেন, “বৎস! সাধুব্যক্তিরা গুরুর সন্তোষসাধনকেই গুরুদক্ষিণা বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। আমি তোমার আচার-ব্যবহারে পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি। সুতরাং তোমাকে আর কোন প্রকার দক্ষিণা প্রদান করিতে হইবে না। আজ তোমার বার্দ্ধক্য অপনীত ও তুমি যোড়শবর্ষীয় যুবার ন্যায়, রূপবান্ হইবে। আমি এই স্বীয় কন্যাটিকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিলাম, তুমি ইহাকে বিবাহ কর। এই কন্যা ব্যতীত আর কেহই তোমার তেজঃ ধারণ করিতে সমর্থ হইবে না।”
মহর্ষি গৌতম এই কথা কহিলে, মহাত্মা উতঙ্ক তৎক্ষণাৎ যৌবনাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া সেই যশস্বিনী গৌতমকন্যাকে পত্নীরূপে গ্রহণপূৰ্ব্বক পুনরায় গৌতমকে কহিলেন, “ভগবন্! আপনি কিঞ্চিৎ দক্ষিণা গ্রহণপূর্ব্বক আমাকে চরিতার্থ করুন।” তখন গৌতম কহিলেন, “বৎস! তুমি তোমার গুরুপত্নীর নিকট গমনপূর্ব্বক তাহাকে অভিলষিত অর্থ প্রদান কর।” গৌতম এইরূপ আদেশ করিলে, উতঙ্ক অহল্যার নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মাতঃ! আমি ধন ও প্রাণ, পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াও আপনার হিতানুষ্ঠান করিতে সম্মত আছি; অতএব গুরুদক্ষিণাস্বরূপ আপনাকে কি প্রদান করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন। আপনি আজ্ঞা করিলে ইহলোকে যে রত্ন একান্ত দুর্ল্লভ, আমি স্বীয় তপঃপ্রভাবে তাহাও আনয়ন করিব।”
তখন অহল্যা কহিলেন, “বৎস! তোমার অকপট ভক্তিদ্বারা আমি একান্ত পরিতুষ্ট হইয়াছি; অতএব আর তোমার অন্য দক্ষিণা-প্রদানের প্রয়োজন নাই। এক্ষণে তুমি স্বচ্ছন্দে অভিলষিত স্থানে গমন কর।”
অহল্যা এই কথা কহিলে, উতঙ্ক তাহাতে প্রীত না হইয়া পুনরায় তাহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মাতঃ! যথাসাধ্য আপনার হিতসাধন করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। অতএব আমাকে কি প্রদান করিতে হইবে আপনি তাহা আদেশ করুন।”
গুরুদক্ষিণার্থ উতঙ্কের সৌদাসসমীপে গমন
উতঙ্ক এইরূপে বারংবার দক্ষিণা প্রদান করিবার বাসনা প্রকাশ করিলে অহল্যা তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তবে যদি একান্তই আমাকে ধনদান করিতে তোমার ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে তুমি অবিলম্বে সৌদাসরাজমহিষীর কর্ণে যে মণিময় কুণ্ডলদ্বয় আছে, তাহা আনয়ন কর।” গৌতমপত্নী অহল্যা এই কথা কহিবামাত্র উতঙ্ক তাঁহার বাক্যে স্বীকার করিয়া সেই. কুণ্ডলদ্বয় আনয়নার্থ রাক্ষসরূপী সৌদাসরাজার নিকট গমন করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহর্ষি গৌতম উতঙ্ককে দেখিতে না পাইয়া পত্নীকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “প্রিয়ে! উতঙ্ককে দেখিতেছি না কেন?” তখন অহল্যা কহিলেন, “ভগবন্! উতঙ্ক আমার আজ্ঞানুসারে সৌদাসরাজমহিষীর কুণ্ডল আনয়নার্থ গমন করিয়াছে।” অহল্যা এই কথা কহিলে মহর্ষি গৌতম নিতান্ত দুঃখিত হইয়া কহিলেন, “প্রিয়ে! সৌদাসরাজা বশিষ্ঠদেবের শাপে রাক্ষসরূপ ধারণ করিয়াছে, অতএব তাহার নিকটে উতঙ্ককে প্রেরণ করা কর্ত্তব্য হয় নাই। আমার বোধ হয়, এই রাক্ষসরূপী ভূপাল উতঙ্ককে বিনাশ করিবে।” অহল্যা কহিলেন, “ভগবন্! আমি না জানিয়াই তাহাকে প্রেরণ করিয়াছি। যাহা হউক, আপনার প্রসাদবলে তাহার কোন বিঘ্ন ঘটিবার আশঙ্কা নাই।” তখন গৌতম কহিলেন, “জগদীশ্বর করুন, যেন উতঙ্কের কোন বিঘ্ন না হয়।”