৬৬. উত্তরা-গর্ভ হইতে মৃতাবস্থায় পরীক্ষিতের জন্ম

৬৬তম অধ্যায়

উত্তরা-গর্ভ হইতে মৃতাবস্থায় পরীক্ষিতের জন্ম

বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! এ দিকে মহাত্মা বাসুদেব অশ্বমেধযজ্ঞের সময় উপস্থিত জানিয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের বাক্য স্মরণপূৰ্ব্বক ঐ যজ্ঞের সাহায্য এবং দ্ৰৌপদী, কুন্তী, উত্তরা ও অন্যান্য অনাথা ক্ষত্রিয়কামিনীগণকে আশ্বাস প্রদান করিবার নিমিত্ত বলদেবকে অগ্রসর করিয়া সুভদ্রা এবং প্রদ্যুম্ন, যুযুধান, চারুদেষ্ণ, শাম্ব, গদ, কৃতবর্ম্মা, সারণ, নিশঠ ও উন্মুক প্রভৃতি বীরগণের সহিত হস্তিনায় সমুপস্থিত হইলেন। তখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, মহাত্মা বিদুর ও যুযুৎসু যদুবীরদিগকে সমাগত দেখিয়া তাঁহাদের যথোচিত সৎকার করিলেন। তাঁহারাও পূজিত হইয়া তথায় উপবিষ্ট হইলেন।

বৃষ্ণিবংশীয় মহাত্মারা উপবেশন করিবামাত্র আপনার পিতা মহারাজ পরীক্ষিৎ নিশ্চেষ্ট শবরূপে উত্তরার গর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইলেন। ঐ সময়ে অন্তঃপুরস্থ লোকসমুদয় উত্তরার পুত্র হইয়াছে দেখিয়া প্রথমতঃ পুলকিতচিত্তে হর্ষসূচক শব্দ করিয়া উঠিল; কিন্তু অবিলম্বেই উহারা সেই পুত্রকে মৃত দেখিয়া নিতান্ত বিষণ্ন হইয়া রোদন করিতে লাগিল। তখন মহাত্মা, বাসুদেব নিতান্ত ব্যথিতচিত্তে যুযুৎসুর সহিত সত্বর অন্তঃপুরে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, মহানুভবা কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্যান্য কুরুবনিতাদিগের সমভিব্যাহারে রোদন করিতে করিতে মহাবেগে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে শীঘ্র আগমন করিতে বারংবার অনুরোধ করিতেছেন।

মহাত্মা বাসুদেব তাঁহাদিগকে তদবস্থ দর্শন করিবামাত্র সত্বর তাঁহাদিগের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন কুন্তী বাসুদেবের সম্মুখবৰ্ত্তিনী হইয়া বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তুমি আমাদিগের পরমগতি; তোমার প্রভাবেই এই কুল প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে, এক্ষণে তোমার ভাগিনেয় অভিমন্যুর পুত্র অশ্বত্থামার অস্ত্রপ্রভাবে গতজীবিত [মৃতাবস্থায়] হইয়া ভূমিষ্ঠ হইয়াছে, ইহাকে জীবিত করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি পূর্ব্বে ইহার জীবনদান করিবে বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে; অতএব সম্প্রতি সেই প্রতিপালন করিয়া আমাকে ও আমার পুত্রগণকে রক্ষা কর। আমরা এই বালকের আশাতেই জীবিত রহিয়াছি, এই বালক আমার পতি ও শ্বশুর এবং তোমার ভাগিনেয় অভিমন্যুর জলপিণ্ডের স্থল। অতএব আজ ইহাকে জীবিত করিয়া অভিমনুর প্রেতত্বমুক্তির উপায়বিধান করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। পূৰ্ব্বে অভিমন্যু উত্তরাকে কহিয়াছিলেন, ‘প্রিয়ে! তোমার গর্ভজাত পুত্র মাতুলালয়ে আগমনপূর্ব্বক বৃষ্ণি ও অন্ধকদিগের নিকট ধনুর্ব্বেদ ও নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া যারপরনাই প্রতাপশালী হইবে, সন্দেহ নাই। তোমার ভাগিনেয়বধূ উত্তরা সৰ্ব্বদা অভিমন্যুর ঐ কথা কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। এক্ষণে আমরা বিনীতভাবে তোমার নিকট প্রার্থনা করিতেছি, তুমি এই বালকের জীবনদান করিয়া কুরুবংশ রক্ষা কর।” এই বলিয়া কুন্তী, ও অন্যান্য কুরুবনিতাগণ শোকাকুলতচিত্তে হাহাকার করিতে করিতে ভূতলে নিপতিত হইয়া পুনঃ পুনঃ তাঁহার নিকট বালকের জীবন। প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব কুন্তীকে ভূমি হইতে উত্থাপিত করিয়া তাঁহাকে বিবিধ প্রবোধবাক্যে সান্ত্বনা করিতে আরম্ভ করিলেন।