৭১. অশ্বমেধ যজ্ঞে বেদব্যাসের অনুমতি

৭১তম অধ্যায়

অশ্বমেধ যজ্ঞে বেদব্যাসের অনুমতি

বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর শত্রুতাপন বাসুদেব অন্যান্য বৃষিবংশীয় বীরগণের সহিত পাণ্ডবদিগের নিকট সমুপস্থিত হইলে পাণ্ডুতনয়গণ তাঁহাদিগকে যথোচিত সমাদর করিয়া তাঁহাদের সহিত নগরমধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সৈন্যগণের পদশব্দ ও রথচক্রের ঘর্ঘর নির্ঘোষে ভূমণ্ডল, স্বর্গমণ্ডল ও নভোমণ্ডল এককালে সমাচ্ছন্ন হইল। পাণ্ডবগণ এইরূপে মহা আহ্লাদে সেই ধনরাশি লইয়া অমাত্য ও সুহৃদগণের সহিত পুরমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে এবং সৰ্ব্বপ্রথম ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া স্ব স্ব নামোল্লেখপূর্ব্বক তাঁহার চরণ বন্দনা করিয়া পরিশেষে গান্ধারী ও কুন্তীকে অভিবাদন এবং বিদুর ও যুযুৎসুকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করিলেন। অনন্তর অভিমন্যুতনয়ের অদ্ভুত জন্মবৃত্তান্ত তাঁহাদিগের কর্ণগোচর হইল। তখন তাঁহারা বাসুদেবের সেই অলৌকিক আশ্চর্য্য কৰ্ম্ম শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে বারংবার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

কিয়দ্দিন অতীত হইলে সত্যবতীপুত্র মহর্ষি বেদব্যাস হস্তিনানগরে সমুপস্থিত হইলেন। তখন কৌরবগণ ও বৃষ্ণিবংশীয় মহাত্মারা যথানিয়মে পাদ্যঅর্থ্যাদিদ্বারা তাঁহাকে পূজা করিলেন। অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহার সহিত বিবিধবিষয়ক কথোপকথন করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আমি আপনার প্রসাদবলে যে অর্থরাশি আহরণ করিয়াছি, উহা অশ্বমেধ যজ্ঞে পর্য্যবসিত করিতে আমার একান্ত বাসনা হইতেছে। এক্ষণে আপনি ঐ বিষয়ে অনুজ্ঞা করুন। আমরা সকলেই আপনার ও মহাত্মা বাসুদেবের একান্ত অধীন।”

তখন বেদব্যাস কহিলেন, “রাজন্‌! আমি তোমাকে অনুজ্ঞা করিতেছি, তুমি অচিরাৎ প্রভূতদক্ষিণ অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান কর। অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা সমুদয় পাতক বিনষ্ট হইয়া থাকে; অতএব তুমি ঐ যজ্ঞ সমাধান করিলে নিশ্চয়ই নিস্পাপ হইবে।”

কৃষ্ণসহ যজ্ঞবিষয়ক পরামর্শ

মহর্ষি বেদব্যাস এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির যজ্ঞানুষ্ঠানে স্থিরনিশ্চয় হইয়া কৃষ্ণের নিকট গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “কেশব! তুমি জন্মগ্রহণ করাতে দেবকী সুসন্তানজননী বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছেন। আমি তোমাকে যে বিষয় অনুমতি করি, তুমি তাহাই সম্পাদন করিয়া থাক। আমি তোমার প্রভাবেই এই রাজ্যাদি বিবিধ ভোগ্যবস্তু উপভোগ করিতেছি। তুমিই স্বীয় পরাক্রম ও বুদ্ধি-কৌশলে এই পৃথিবী পরাজয় করিয়াছ। অতএব তুমি স্বয়ং যজ্ঞে দীক্ষিত হও। তুমি আমাদিগের পরম গুরু। তুমি যজ্ঞানুষ্ঠান করিলেই আমি নিস্পাপ হইব। তুমিই যজ্ঞ, তুমিই পরব্রহ্ম, তুমিই ধৰ্ম্ম, তুমিই প্রজাপতি এবং তুমিই সমুদয় জীবের একমাত্র গতি, এ বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সংশয় নাই।”

ধর্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মনন্দন এই কথা কহিলে, মহাত্মা বাসুদেব তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “রাজন! আপনি নিতান্ত সৎস্বভাবসম্পন্ন ও বিনয়ী বলিয়াই আমাকে প্রশংসা করিতেছেন। কিন্তু আমার মতে আপনিই সৰ্ব্বভূতের একমাত্র গতি। আপনি ধর্ম্মপ্রভাবেই কৌরবদিগের মধ্যে বিরাজিত হইয়াছেন। আপনার অশেষবিধ গুণ দ্বারাই আমি গুণবান হইয়াছি। আপনি আমাদিগের রাজা ও গুরু। এক্ষণে আপনিই যজ্ঞে দীক্ষিত হইয়া আপনার বিষয়ে অভিরুচি হয় আমাকে নিয়োগ করুন। আমি আপনার নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়া কহিতেছি, আপনি আমাকে যে কার্য্যে নিযুক্ত করিবেন, আমি তাহাই নির্ব্বাহ করিব। আপনি যজ্ঞানুষ্ঠান করিলেই ভীমসেন, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব ইহাদিগের সকলের যজ্ঞানুষ্ঠান করা হইবে।”