ত্র্যধিকশততম অধ্যায়
ভীষ্মের পুৎত্রোৎপাদন-প্রত্যাখান
বৈশম্পয়ান কহিলেন, সত্যবতী পুৎত্রশোকে কাতর হইয়া পুৎত্রবধুদিগের সহিত সন্তানের প্রেতকার্য্য সম্পাদন করিলেন, স্নুষাদিগকে ও ভ্রাতৃবৎসল ভীষ্মকে নানাপ্রকার প্রবোধ-বাক্যে সান্ত্বনা করিয়া ধর্ম্মরক্ষা ও বংশরক্ষার নিমিত্ত সবিশেষ পর্য্যালোচনাপূর্ব্বক ভীষ্মকে কহিলেন , ”হে মহাভাগ! মহাযশাঃ ধর্ম্মপরায়ণ শান্তনুকে জলপিণ্ড প্রদান করে, এমন লোক তোমা ব্যতীত আর লক্ষ্য হয় না; কেবল তুমিই তাঁহার অদ্বিতীয় আশাভাজন। তোমাতে ধর্ম্ম অবিচলিতরূপে নিত্য বিরাজমান রহিয়াছেন। তুমি ধর্ম্মের যথার্থতত্ত্বজ্ঞ ও নিখিল বেদবেদাঙ্গপারদর্শী। মহর্ষি শুক্র ও অঙ্গিরার ন্যায় তোমার ধর্ম্মনিষ্ঠতা, কুলাচারের অভিজ্ঞতা এবং দুরূহ কার্য্যে মহীয়সী সহিষ্ণুতা আছে; অতএব হে ধর্ম্মাত্মন্! আমি ফলসিদ্ধির আশায় তোমাকে কোন কার্য্যে নিয়োগ করিতে ইচ্ছা করি, অগ্রে শ্রবণ করিয়া তৎসম্পাদানা যত্নবান্ হও। হে পুরুষর্ষভ! তোমার প্রিয়তম ভ্রাতা পুৎত্রবিহীন হইয়া অকালে পরলোকযাত্রা করিয়াছেন। তাঁহার পরমরূপবতী ও সম্পুর্ণ যৌবনবতী মহিষীদ্বয় অতিমাত্র পুৎত্রার্থিনী হইয়াছেন, অতএব আমি অনুমতি করিতেছি, তুমি বংশরক্ষার নিমিত্ত তাঁহাদিগের গর্ভে অপত্যোৎপাদন কর; তাহাতে তোমার পরম ধর্ম্মলাভ হইবে, সন্দেহ নাই; এক্ষণে রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া প্রজাপালনে তৎপর হও এবং দারপরিগ্রহ করিয়া পিতার বংশরক্ষা কর।”
ধর্ম্মাত্মা ভীষ্ম মাতার ও সুহৃদ্বর্গের এবম্প্রকার অনুরোধবাক্য শ্রবণ করিয়া উত্তর প্রদান করিলেন, ” মাতঃ ! আপনি ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিয়াছেন, যথার্থ বটে; কিন্তু অপত্যোৎপাদন বিষয়ে আমি যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহা কি বিস্মৃত হইয়াছেন? আমি দারপরিগ্রহ-বিষয়ে পূর্ব্বে আপনার নিকট যে সংকল্প করিয়াছি, তাহা আপনি পরিজ্ঞাত আছেন, তথাপি আবার এক্ষণেও পুনর্ব্বার সত্যপরায়ণ দৃঢ়তর প্রতিজ্ঞা করিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি ত্রৈলোক্য পরিত্যাগ করিতে পারি , ইন্দ্রত্ব পরিত্যাগ করিতে পারি এবং ইহা অপেক্ষা যদি কিছু অভীষ্টতম বস্তু থাকে, তাহাও পরিত্যাগ করিতে সম্মত আছি; কিন্তু কদাচ সত্য পরিত্যাগ করিতে পারিব না। যদি পৃথিবী গন্ধ পরিত্যাগ করে, জল যদি মধুররস পরিত্যাগ করে, জ্যোতি যদি রূপ পরিত্যাগ করে, বায়ু যদি স্পর্শগুণ পরিত্যাগ করে, আকাশ যদি শব্দগুণ পরিত্যাগ করেন, শীতরশ্মি যদি শীতাংশু পরিত্যাগ করেন, তথাপি আমি সত্য পরিত্যাগ করিব না।”
সত্যবতী মহাতেজাঃ ভীষ্মের এইরূপ কঠোর প্রতিজ্ঞা শুনিয়া কহিলেন, হে সত্যপরাক্রম! সত্যের প্রতি তোমার যে অবিচলিত ভক্তি ও যথার্থ প্রীতি আছে, তাহা আমার অবিদিত নহে এবং তুমি ইচ্ছা করিলে যে স্বীয় তাজঃপ্রভাবে নুতন ত্রিলোকের সৃষ্টি করিতে পার, তাহাও আমি বিলক্ষণ পরিজ্ঞাত আছি, আর তুমি আমার নিমিত্ত পূর্ব্বে যে সত্য করিয়াছ, তাহাও বিস্মৃত হই নাই; কিন্তু বৎস! তোমাকে আপদ্ধর্ম্ম [দেশ, কাল ও পাত্রভেদে ধর্ম্মের কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ] পর্য্যবেক্ষণ করিয়া পৈতৃক ভার গ্রহণ করিতে হইবে। হে পরন্তপ! যাহাতে তোমার বংশপরম্পরা রক্ষা পায়, ধর্ম্মের উচ্ছেদ না হয় এবং বন্ধুবান্ধবগণের সন্তোষ জন্মে , তাহার অনুষ্ঠান কর।” সত্যবতী পুৎত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া এইরূপে নিরন্তর বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছেন এবং পুৎত্রের আকাঙ্ক্ষায় সাধুবিগর্হিত অধর্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠানে পুনঃ পুনঃ প্রবর্ত্তনা করিতেছেন দেখিয়া ধর্ম্মপরায়ণ ভীষ্ম কহিলেন, ”মাতঃ! ধর্ম্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। আমাদিগকে বিনষ্ট করিবেন না, ক্ষৎত্রিয়ের সভ্যভঙ্গ অতীব নিন্দনীয়, অসত্যসন্ধ ক্ষৎত্রিয়ের অধর্ম্মের অবধি থাকে না; অতএব যাহাতে রাজা শান্তনুর বংশপরম্পরা ধরামণ্ডলে অক্ষয়রূপে দেদীপ্যমান থাকে, তাহার উপায়স্বরূপ সনাতন ক্ষৎত্রিয়ধর্ম্ম কীর্ত্তন করিতেছি শ্রবণ করুন; আপদ্ধর্ম্মকুশল প্রাজ্ঞ পুরোহিতগণ সমভিব্যাহারে উক্ত ধর্ম্মানুসারে কার্য্যারম্ভ করিবেন।