১৪০. ধৃতরাষ্ট্রসমীপে কণিকের কূটমন্ত্রণা নকুল-ব্যাঘ্র-শৃগাল-বৃক-মূষিক কথা

১৪০. ধৃতরাষ্ট্রসমীপে কণিকের কূটমন্ত্রণা নকুল-ব্যাঘ্র-শৃগাল-বৃক-মূষিক কথা

চত্বারিংশদধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,-মহারাজ! মহীপাল ধৃতরাষ্ট্র মহাবীর পাণ্ডুপুত্রদিগকে বলমদোন্মাদিত দেখিয়া অত্যন্ত কাতর ও একান্ত চিন্তান্বিত হইলেন। তৎপরে মন্ত্রজ্ঞ নীতিনিপুণ মস্ত্রির কণিককে আহ্বান করিয়া কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! পাণ্ডবেরা নিত্য উৎসিক্ত, এই নিমিত্ত আমি সাতিশয় অসূয়াপরবশ হইতেছি; অতএব তাহাদিগের সহিত সন্ধিবিগ্রহের অন্যতর কি ব্যবহার করিব? তুমি নিশ্চয় করিয়া বল, আমি তোমার কথার অন্যথা করিব না। প্রসন্নমনা নীতিশাস্ত্রবিশারদ মন্ত্রির ভূপালের আদেশ পাইয়া নীতিশাস্ত্রানুসারে কহিলেন, মহারাজ! আমি যাহা কহি, তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন; কিন্তু মহারাজ! আমার বাক্য নিতান্ত অপ্রিয় হইলেও রোষ বা অসন্তোষ প্রকাশ করিবেন না। রাজার নিরবচ্ছিন্ন দণ্ড বা নিয়ত পৌরুষ প্রকাশ করা উচিত নহে। যাহাতে প্রতিপক্ষের কোষকলাদির কোন অনুসন্ধান লইতে না পারে, এমন বিষয়ে তাহার সতত সাবধান থাকা আবশ্যক। তিনি সাধ্যানুসারে বিপক্ষের বন্ধুন্বেষণে তৎপর হইবেন এবং জনগণের ভ্রুণহত্যা প্রভৃতি পাপের নিয়ত অনুসন্ধান করিবেন। রাজা প্রতিনিয়ত উদ্যত জণ্ড হইলে লোকে ভীত হইয়া গহিত কর্মের প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে, এই কারণে তিনি দণ্ডদ্বার সর্বকার্য্যের সমাধা করিবেন। রাজার আত্মছিদ্র গোপন ও পরচ্ছিদ্রের অনুসরণ করা অবশ্য কর্তব্য এবং তাহার সহায়, সাধন ও উপায় প্রভৃতি রাজ্যাঙ্গের গোপন ও আত্বকৃত নিন্দিত ব্যাপারের সম্বরণ করা একান্ত বিধেয়। কোন কাৰ্য্য আরম্ভ করিয়া নিঃশেষে তাহার সমাধা করা রাজার পক্ষে অতীব কৰ্ত্তব্য; কারণ, অসম্যক্ উচ্ছিন্ন সামান্য কন্টকও কালক্রমে ব্ৰণকর হইয়া উঠে। অপকারী শত্রুকে বধ করাই সর্বতোভাবে প্রশংসনীয়। আপৎকাল উপস্থিত হইলে অসংশয়িতচিত্তে যুদ্ধবিক্রম প্রকাশ বা পলায়ন, যাহাতে আপনার সুবিধা হয়, তাহাই করিবেন। শত্রু দুর্বল হইলেও কোন ক্রমে অবজ্ঞেয় নহে। কারণ, সামান্য অগ্নিকণাও সমুদায় বন ভস্মসাৎ করিতে পারে। সময়বিশেষে রাজা শত্রুর অত্যাচারে দৃষ্টিপাত ও কর্ণপাত না করিয়া অন্ধ ও বধির হইয়া থাকিবেন। শরাসন তৃণতুল্য অসার বিবেচনা করিয়া পরিত্যাগ করিবেন এবং মৃগের ন্যায় সাবধান হইয়া আত্মরক্ষা বিষয়ে যত্নশালী হইবেন। তৎপরে সামাদি উপায় দ্বারা শত্রুকে বশে আনিয়া তাহাকে বিনাশ করিবেন। কিন্তু সে যদি শরণাপন্ন হয়, তথা তাহার প্রতি কদাচ অনুকম্পা প্রদর্শন করিবেন না। পরিচারকদিগকে প্রার্থনাধিক অর্থদানপূর্বক পরিতুষ্ট করিয়া শত্রু ও পূৰ্ব্বাপকারীকে বিনষ্ট করিবেন। শত্ৰু সংহার করিতে পারিলে, নির্ভীক ও নিরুদ্বিগ্ন হওয়া যায়। শত্রুপক্ষীয়দিগকে যত বিনষ্ট করিতে পারেন, তদ্বিষয়ে কদাচ ত্রুটি করিবেন না। প্রথমতঃ যাহাতে প্রত্যহ প্রতিপক্ষের মুলোচ্ছেদন হয়, এমন চেষ্টা পাইবেন। পরে তাহার সহায় ও তৎপক্ষদিগকে বিনাশ করিবেন। সমূলোচ্ছেদন হইলে তদুপজীবী সকলে অনায়াসে বিনাশিত হয়। মহারাজ! বনস্পতি সমূলে উনূলিত হইলে তাহার শাখা, পল্লব বা পত্র সকল কি আর পূৰ্বাবস্থায় অবস্থিত থাকিতে পারে? রাজা একাগ্রচিত্তে নিজাভিসন্ধি গোপন করিম! সর্বদা পরচ্ছিদ্র দর্শনে তৎপর হইবেন। নিত্যোদ্বিগ্ন হইয়া শত্রুর প্রতি সম্যক ব্যবহার করিবেন। অগ্ন্যাধনি, যজ্ঞানুষ্ঠান, কষায় বস্ত্র পরিধান ও জটাজিন দ্বারা লোকদিগকে বিশ্বসিত করিয়া পরে বৃকের ন্যায় স্বার্থসাধনে প্রবৃত্ত হইবেন। অর্থসংগ্রহ বিষয়ে শৌচই অঙ্কুশম্বরূপ হয়, তদ্বারা ফলবতী শাখা আনমিত করিয়া সুপক ফল গ্রহণ করিবেন; কারণ, পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, যদবধি সময় আগত না হয়, তৎকাল পর্যন্ত শত্রুকে স্কন্ধে বহুন করিকে। অনন্তর নির্দিষ্ট কাল উপস্থিত হইলে, সাদৃশ মৃন্ময় ঘটকে প্রস্তরোপরি নিক্ষেপ করিলে চূর্ণ করা যায়, তাদৃশ অপকারী শত্রুকে বিনাশ করিবে। বহুভাষী ও কৃপণ শত্রুকেও পরিত্যাগ করিবে না এবং তাহার প্রতি প্ৰসমভাব প্রদর্শন করাও নিতান্ত নিষিদ্ধ; প্রত্যুত যেরূপে হউক, তাহাকে বিনষ্ট করিবে; অধিক কি, সন্ধি, দান, ভেদ ও দণ্ড এই সমস্ত উপায় দ্বারাও শত্রু সংহার করা বিধেয়, তাহা হইলে সকল বিষয়ে শান্তি লাভ হয়।

এই কথা শ্রবণ করিয়া ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে কণিক! সন্ধি, দান, ভেদ ও দণ্ডদ্বারা কি প্রকারে শত্ৰুসংহার করা যাইতে পারে, তুমি আমার নিকটে আনুপূর্বিক সমুদায় বল। কণিক কহিলেন, মহারাজ! পূর্বকালে নীতিশাস্ত্রবিশারদ অরণ্যবাসী জম্বুকের যেরূপ ঘটিয়াছিল,তাহা অনুপুৰ্ব্বিক সমুদায় বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন।

কোন বনে এক শৃগাল, ব্যাঘ্র, উন্দুর, বুক ও নকুল এই চারি বন্ধুর সহিত একত্র বাস করিত। জম্বুক অতিশয় ধূর্ত, বুদ্ধিমান ও স্বার্থপরায়ণ ছিল। তাহারা একদা বনমধ্যে যূথপতি এক মৃগকে লক্ষ্য করিয়া বলপূর্বক আক্ৰমণ করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু মৃগ অতিশয় বলবান, এই নিমিত্ত তাহারা সহসা আপন অভীষ্টসাধনে নিতান্ত অসক্ত হইলে পরিশেষে জন্ধুক কহিল, হে ব্যাঘ্র! এই মৃগ অতিশয় বুদ্ধিশালী, যুব ও বেগবান; সুতরাং তুমি বারম্বার যত্ন করিলেও ইহাকে সহসা আক্রমণ করিতে পারিবে না; অতএব যে সময়ে ঐ মৃগ শয়ন করিয়া থাকিবে, সেই অবসরে মূষিক গিয়া ঐ হরিণের পাদদ্বয় ভক্ষণ করুক, তাহা হইলে ব্যাঘ্র অনায়াসে”উহাকে গ্রহণ করিতে পারিবে। তৎপরে আমরা সকলে সমবেত হইয়া প্রফুল্লমনে ভক্ষণ করিব। তাহারা সকলে একনমনে জম্বুকের পরামর্শে সম্মত হইল। অনন্তর তাহাদিগের আদেশানুসারে মূষিক গিয়া মৃগের পদদ্বয় ভক্ষণ করিলে ব্যাস্ত্র তাহাকে বধ করিল। তখন জমুক, মৃগকলেবর অবনীতলে বিচেষ্টমান দেখিয়া। কহিল, ওহে! তোমরা সকলে স্নান করিয়া আইস, আমিই ইহা রক্ষা করিতেছি। তাহারা শৃগালের বাক্যানুসারে স্নানাৰ্থ নদীতীরে গমন করিল। শৃগালও চিন্তাকুল হইয়া তথায় অবস্থিতি করিতে লাগিল। অনন্তর মহাবল ব্যাঘ্র সর্বাগ্রে স্নান করিয়া আগমন করিল এবং শৃগালকে চিন্তাক্রান্ত দেখিয়া কহিল, হে জন্ধুক! ভাই আমাদিগের মধ্যে তুমিই একমাত্র বুদ্ধিজীবী, তুমি কি কারণে শোক করিতেছ? আইস, আমরা মৃগমাস ভক্ষণ করিয়া বিহার করি। তখন জম্বুক কহিল, হে মহাবাহহ! মূষিক যাহা কহিয়াছে, বলিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি স্নান করিতে গেলে সে অহঙ্কারপরতন্ত্র হইয়া আমাকে কহিল, আমিই অদ্য এই মৃগকে বধ করিয়াছি, ব্যাঘ্রের বলবিক্রমে ধিক্‌! আজ আমারই দুজবলে তোমাদিগের তৃপ্তিসাধন হইবে। বলিতে কি, সে গৰ্বপূর্বক এইরূপ তর্জন গর্জন করিতেছিল; এই কারণে মৃগমাংস ভক্ষণে আমার আর তাদৃশ প্রীতি নাই। তখন ব্যাঘ্র ক্রোধভরে কহিল, হে জম্বুক! যদি সত্যই সে এইরূপ কহিয়া থাকে, ভাল, তুমি যথাকালে আমাকে প্রবোধিত করিয়াছ। আমি অদ্য বাহুবলে বনচরদিগকে বিনাশ করিব। চলিলাম, তুমি তথায় পৰ্যাপ্ত মাংস ভক্ষণ করিবে; এই বলিয়া ব্যাঘ্র বনমধ্যে প্রস্থান করিল।

এই অবসরে মূষিক সহসা উপস্থিত হইল। শৃগাল তাহাকে আগত দেখিয়া কহিল, হে মূষিক! তোমার মঙ্গল ত? বৃক যাহা কহিয়াছে শুন, তুমি স্নান করিতে গেলে সে কহিল, এই মৃগমাংস ভক্ষণ করিতে আমার অভিরুচি নাই; এক্ষণে আমার এই মাংস বিষ বলিয়া বোধ হইতেছে, তোমার মত হইলে আমি এখনই মূষিককে গিয়া ভক্ষণ করি; এই কথা শুনিবামাত্র মূষিক অতিমাত্র ব্যস্তসমস্ত হইয়া প্রাণভয়ে সত্বরে বিবরমধ্যে প্রবেশ করিল। কিছু কাল পরে বৃক স্নান করিয়া তথায় আগত হইল। জহুক তাহাকে দেখিয়া কহিল, ভাই!-ব্যাঘ্র তোমার উপর অতিশয় রোষাবিষ্ট হইয়াছেন, সুতরাং তোমার অনিষ্ট ঘটবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা; তিনি কলত্রসহকারে সত্বরে এখানে আসিতেছেন; এক্ষণে যাহা কর্তব্য হয়, কর। তখন পিশিতাশন বৃক শৃগালের এইরূপ কথা শুনিয়া ভীত ও শঙ্কুচিত হইয়া পলায়ন করিল। এই অবসরে নকুল কৃতস্নান হইয়া তথায় আগমন করিল। জম্বুক তাহাকে আগত দেখিয়া কহিল, অহে নকুল! আমি নিজ ভুবলে সকলকে পরাজয় করিয়াছি। পরাজিত হইয়া তাহারা স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল। এক্ষণে আমার সহিত যদি যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পার, তাহা হইলে তুমি ইচ্ছামত মৃগমাংস ভক্ষণ করিতে পাইবে। তখন নকুল কহিল, হে জম্বুক! ব্যা, বুক ও বুদ্ধিমা মূষিক যখন তোমার নিকটে পরাজিত হইয়াছে, সুতরাং তুমি সর্বাপেক্ষা বলবান, সন্দেহ নাই। অতএব তোমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতে আমার আর উৎসাহ নাই; চলিলাম, এই বলিয়া নকুলও পলায়ন করিল। এইরূপে জম্মুক অসাধারণ বুদ্ধিবলে সকলকে বিদায় করিয়া পরমসুখে মৃগমাংস ভক্ষণ করিয়াছিল। যে রাজা এই প্রকার আচরণ করেন, তিনি চিরকাল সুখভোগ করিয়া থাকেন। ভীত ব্যক্তিকে ভয় প্রদর্শন, বীরের নিকটে বিনয়ভাব, লুব্ধকে অর্থদান, সম বা ন্যূন ব্যক্তিকে বলপ্রকাশ করিয়া বশীভূত করিবে। মহারাজ! আরও কহিতেছি, শ্রবণ করুন; পুত্র, সখা, ভ্রাতা, পিতা এবং গুরুও যদি শত্রুর ন্যায় বিদ্রোহাচরণে প্রবৃত্ত হয়েন, তাহা হইলে তৎক্ষণেই তাহাদিগকে বিনষ্ট করিবে। শত্রুকে শপথ, অর্থদান, বিষপ্রয়োগ বা মায়াপ্রকাশ করিয়া বিনাশ করা বিধেয়; কদাচ উপেক্ষা করিবে না। কিন্তু যদি জিগীষাসম্পন্ন উভয়পক্ষই তুল্য বল ও তুল্য উপায়বশতঃ সন্দিহান হইয়া থাকেন, তাহা হইলে যিনি তন্মধ্যে গাঢ়তর অধ্যবসায়সহকারে জয়শ্রী লাভের প্রত্যাশা করেন, তাহারই অভ্যূদয় জানিবেন। আর যদি গুরুও অবলিপ্ত, কাৰ্যাকাৰ্যজ্ঞানশূন্য, নিতান্ত নিন্দনীয় ও কুপথগামী হন, তাহা হইলে তাহারও শাসন করা ন্যায়বিরুদ্ধ নহে। ক্রোধোদ্রেক হইলেও কদাচ ক্রুদ্ধ হইবে না, সর্বদা সহাস্য আস্যে সকলকে সাদর সম্ভাষণ করিবে। কোপাক্রান্ত হইয়া কখন অন্যের অপকারে প্রবৃত্ত হইবে না।প্রহারোদ্দেশে বা প্রহারকালে লোকের প্রতি প্রতিবাক্য প্রয়োগ করিবে। প্রহার করিয়া কৃপা প্রদর্শন এবং প্রহারবেগে প্রহৃত ব্যক্তি কারোক্তি দ্বারা শোক বা রোদন করিলে বিলাপ ও পরিতাপ করা বিধেয়। শান্তবাক্য, ধর্মোপদেশ ও সদ্ব্যবহার দ্বারা শত্রুকে আশ্বস্ত করিবে। এইরূপ অনুকম্পা প্রদর্শন করিলেও যদি পথিমধ্যে শত্ৰু সদাচারের অন্যথাচরণ করে, তাহা হইলে অবসর বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে প্রহার করিবে; ইহাতে অধর্ম স্পর্শিবেক না। যেমন কৃষ্ণবর্ণ মেঘ উন্নত মহীধরকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, সেইরূপ নিরবচ্ছিন্ন ধর্মানুষ্ঠানকারী ব্যক্তি ধর্মবলে পরিবৃত হইয়া থাকে; ঘোরতর অপরাধী হইলেও দোষী বলিয়া পরিগণিত ও পরিগৃহীত হইতে পারে না। যাহার পক্ষে বধ অবধারিত হইয়াছে, তাহার গৃহে অগ্নি প্রদান করিবে। আর নির্ধন, নাস্তিক ও চৌরগণকে দেশ হইতে নির্বাসিত করিষে। অশঙ্কিত ও শঙ্কিত উভয় হইতেই সর্বদা শঙ্কা করা উচিত, কিন্তু অশঙ্কিত হইতে ভয় উৎপন্ন হইলে মূলপৰ্য্যন্ত উচ্ছিন্ন হইতে পারে। অবিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কদাচ বিশ্বাস করিবে না এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেও অতি বিশ্বাস করিবে না; যেহেতু বিশ্বস্ত হইতে ভয় উৎপন্ন হইলে সুলপৰ্যন্ত উচ্ছিন্ন হইতে পারে। আপনার ও অন্যের বিধানানুসারে চর নিযুক্ত করিবে। পাষণ্ড ও তাপস প্রভৃতিকে বিপক্ষের রাজধানীতে প্রেরণ করা বিধেয়। উদ্যান, বিহারস্থান, দেবতায়তন, পানাগার, পথ, লর্বতীর্থ, চত্বর, কূপ, পৰ্বত, বন, সর্বসমবায় ও নদীতীরে মন্ত্রণা করিবে! হৃদয়ে ক্ষুরধার ভ্রাখিয়া সর্বদা সহাস্যমুখে, মিষ্টবাক্যে, বিনীতভাবে সম্ভাষণ করিবে; কিন্তু কদাচ কোন ভয়াবহ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবে না। যিনি ঐহিক সম্পত্তির প্রত্যাশা করেন, তিনি দানশীল ভূপতির নিকটে করপুটে প্রার্থনা, শপথ, সাবাদ, পদবন্দন ও আশা করিবেন। কেহ কোন বিষয়ে প্রার্থনা করিলে অগ্রে বাক্যেতে তাহাকে নিরাশ করিবে না, কিন্তু প্রদানকালে নানাপ্রকারে বিদ্যানুষ্ঠান করিবে। প্রার্থীকে নানা প্রকারে আশা প্রদান করিবে, কিন্তু কখন প্রার্থনা পরিপূর্ণ করিবে না। যদি কখন তাহার অভীষ্টসিদ্ধ কর, তাহাও সত্বরে করা অবিধেয়। ত্রিবিধ পীড়া ও ফলসিদ্ধি আছে, তন্মধ্যে ফল শুভ ও পীড়া অশুভ; অতএব পীড়া পরিত্যাগ করিবে। ধর্মপরায়ণ পুরুষের অর্থ ও কাম দ্বারা চিত্তবৈকল্য জন্মে, অর্থলোভীর ধর্ম ও কামদ্বারা এবং কামাসক্তের অর্থ ও ধর্মদ্বারা পীড়া জন্মে। নিরহঙ্কার,অভিনিবিষ্ট, বিশুদ্ধস্বভাব ও অসূয়াশূন্য হইয়া সত্ত্ববাদ প্রয়োগ ও সূৰ্ববিষয়ের অনুসন্ধানপূর্বক ব্রাহ্মণগণের সহিত মন্ত্রণা করিবে। যাহা করিলে আপনার দীনভাব মোচন হয়, মৃদুই হউক আর দারুণই হউক, তাহা অবশ্য করিবে এবং সমর্থ হইয়া ধর্মাচরণ করিবে। সংশয়ারূঢ় না হইলে শুভলাভের প্রত্যাশা নাই; সংশয়ারূঢ় হইয়া যদি জীবিত থাকে, তাহা হইলে অবশ্যই শেয়োলা হয়। শোক সুন্তাপ দ্বারা যাহা বুদ্ধিবৃত্তি কলুষিত হইবে, নল ও রামাদির উপাখ্যান কথন দ্বারা তাহাকে সান্ত্বনা করিবে; নিতান্ত নির্বোধ ব্যক্তিকে ভাবী মঙ্গলের প্রত্যাশা প্রদর্শন ও পাগুতকে ধবদানাদিদ্বারা সান্ত্বনা করিবে। যিনি শত্রুর সহিত সন্ধি স্থাপন পূর্বক কৃতকার্য্যের ন্যায় নিতান্ত নিশ্চিন্ত হইয়া থাকেন, তিনি বৃক্ষার্থে প্রস্তু ব্যক্তির ন্যায় পতিত ও প্রতিবুদ্ধ হয়েন। অসূয়াপরবশ না হইয়া যত্নপূর্বক নিজ মন্ত্রণা গোপন করিয়া রাখিবে এবং রোষাবেশ সম্বরণ করিয়া চরদ্বারা সর্ববিষয় অবধারণ করিবে। পরমৰ্ম্মবিদারণ, দারুণ কর্ম সম্পাদন ও শত শত শত্ৰু সংহার না করিয়া মনুষ্য কখনই মহতী শ্রী লাভ করিতে পারে না। শত্রুসৈন্য কর্ষিত, ব্যাধিত, ক্লিন্ন, অন্নপানবিবর্জিত, বিশ্বস্ত ও মন্দ হইলেও প্রহার করিবে। অর্থী অর্থীর নিকটে উপস্থিত হয় না। যদিও তাহাদের অভিলাষ সফল হয়, তথাচ উভয়ের সখ্য সংস্থাপন হওয়া নিতান্ত সুকঠিন। সহায় সংগ্রহ ও শত্রুর সহিত বিগ্ৰহ করিতে যত্ন করিবে। সম্পদ লাভের ইচ্ছা ও তদ্বিষয়ে প্রভূত উৎসাহ প্রদর্শন করা বিধেয়। এইরূপ লোকের কাৰ্য্য কি শত্ৰু, কি মিত্র, কেহই কিছুমাত্র অবধারণ করিতে পারে না, কেবল কার্যের উদ্যোগ ও পৰ্যবসানমাত্র প্রত্যক্ষ করে। যদবধি ভয় উপস্থিত না হয়, তদবধি ভয়কে ভয় করিবে; কিন্তু ভয় আগত হইলে স্থিরচিতে প্রতীকার করিতে চেষ্টা করিবে। দণ্ডায়ত্ত শত্রুকে যে রাজা ধনমানাদি প্রদানপূর্বক অনুগ্রহ করেন, তিনি আপনার মৃত্যু সংগ্রহ করিয়া রাখেন।

অনাগত কাৰ্য্যকেও অচিরাগত বিবেচনা করিয়া বুদ্ধিপূর্বক তাহার অনুসরণ করিবে; কিন্তু বুদ্ধিভ্রংশবশতঃ আপনার উদ্দেশ্য সাধনে কদাচ উপেক্ষা বা অনাদর প্রদর্শন করা বিধেয় নহে। সম্পদ লাভার্থে যত্নপূর্বক স্বীয় উৎসাহ বর্ধন করিবে ও দেশ, কাল বিভাগ করিয়া পারলৌকিক কর্ম এবং ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ পৰ্যায়ক্রমে সেবা করিবে; কারণ, দেশকাল বিবেচনা না করিলে শ্রেয়োলাভ হওয়া দুষ্কর। শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অল্প হইলেও কদাচ উপেক্ষা করিবে না, কারণ, তাহারাই আবার কালক্রমে শত্রুভাব বদ্ধমুল করিতে পারে। যেমন বনমধ্যে বহি নিক্ষিপ্ত হইলে তাহা ক্রমশঃ পরিবর্ধিত হইয়া থাকে; সেইরূপ শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অল্প হইলেও কালসহকারে তাহাদিগের দলপুষ্টি হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। যিনি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় আপনাকে সঙ্কুক্ষিত ও উত্তেজিত করেন, তিনি ক্রমশঃ পরিবর্ধিত হইয়া সমূহ শত্রুকে এককালে বিনাশ করিতে পারেন। প্রথমতঃ অর্থকে বহুকালব্যাপিনী আশা প্রদান করিবে, কাল উপস্থিত হইলে বিয়ের কথা উত্থাপন করিবে; নিমিত্তদ্বারা বিঘ্ন ও হেতুহারা নিমিত্ত প্রকাশ করিবে। শক্ৰসংহারকারী গন্ধানুসারী অতি দারুণ সহায়সংগ্রাহী ছদ্মবেশী রাজা ক্ষুরের ন্যায় শক্রর প্রাণ সংহার করিয়া থাকেন; অতএব মহারাজ! পাণ্ডব বা অন্য যে কেহ হউক না কেন, তাহাদিগের সহিত ন্যায়ানুগত ব্যবহার করিলে আপনি কখনই বিপদে পড়িবেন না এবং নির্বিবাদে আপনার কাৰ্য্য সাধন করিতে পারিবেন। বিশেষতঃ আপনি সর্বকল্যাণসম্পন্ন ও কুলশীলবিশিষ্ট; অতএব পাণ্ডুনন্দন হইতে আপনাকে রক্ষা করুন। এক্ষণে যাহা কর্তব্য তাহা কহিলাম, আপনি পুত্রসমভিব্যাহারে পরামর্শ করিয়া যাহা শ্রেয়ঃকল্প হয়, করুন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে এইরূপ উপদেশ দিয়া কণিক স্বগৃহে প্রত্যাগমন করিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রও তদবধি নিতান্ত শোকাকুল হইলেন।

সম্ভব পর্ববাধ্যায় সমাপ্ত।