পঞ্চনবতিতম অধ্যায়
বিস্তৃত পুরুবংশ
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! উদারচরিত পূর্ব্বপুরুষদিগের সংক্ষেপ-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া শ্রবণেন্দ্রিয় পরিতৃপ্ত হইল না; অতএব অনুগ্রহ করিয়া পুনর্ব্বার মনু অবধি রাজর্ষিগণের বিশুদ্ধ বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত সবিস্তর বর্ণন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূর্ব্বে দ্বৈপায়নের নিকট যেরূপ শ্রবণ করিয়াছিলাম, অবিকল বর্ণন করিতেছি, মনোনিবেশপূর্ব্বক শ্রবণ করুন। দক্ষের পুৎত্র অদিতি, অদিতির পুৎত্র বিবস্বান্, বিবস্বানের পুৎত্র মনু, মনুর পুৎত্র ইলা, ইলার পুৎত্র পুরূরবাঃ, পুরূরবার পুৎত্র আয়ু, আয়ুর পুৎত্র নহুষ, নহুষের পুৎত্র যযাতি। যযাতির দুই ভার্য্যা;- শুক্রের কন্যা দেবযানী ও বৃষপর্ব্বার কন্যা শর্ম্মিষ্ঠা। দেবযানীর গর্ভে দুই পুৎত্র হয়;- যদু এবং তুর্ব্বসু। শর্ম্মিষ্ঠার তিন সন্তান;- দ্রুহ্যু, অনু এবং পুরু। যদু হইতে যদুবংশ এবং পুরু হইতে পুরুবংশ বিস্তৃত হইয়াছে। এই পুরু তিনবার অশ্বমেধযজ্ঞ করিয়াছেন এবং পরিশেষে বিশ্বজিৎ-যজ্ঞ করিয়া অরণ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। পুরুর মহিষী কৌশল্যা;- তাঁহার গর্ভে জনমেজয়ের জন্ম হয়। জনমেজয় মাধবী নামে এক কামিনীর পাণিগ্রহণ করেন। মাধবীর গর্ভে জনমেজয়ের প্রাচিন্বান্ নামে এক পুৎত্র জন্মে। তিনি সূর্য্যোদয়ের মধ্যে পূর্ব্বদিক্ জয় করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার নাম প্রাচিন্বান্ হইয়াছিল। তিনি যদুকুলসমুদ্ভুতা অশ্মকীর পাণিগ্রহণ করেন। অশ্মকীর গর্ভে প্রাচিন্বানের সংযাতি নামে এক পুৎত্র হয়। দৃষদ্ধতের দুহিতা বরাঙ্গী সংযাতির সহধর্ম্মিণী। তিনি এক সন্তান প্রসব করেন, তাঁহার নাম অহংযাতি। তিনি কৃতবীর্য্যনন্দিনী ভানুমতীকে বিবাহ করেন। ভানুমতীর গর্ভে তাঁহার এক পুৎত্র হয়, তাঁহার নাম সার্ব্বভৌম। সার্ব্বভৌম জয়লব্ধা কেকয়রাজদুহিতা সুনন্দাকে বিবাহ করিয়া এক পুৎত্র উৎপাদন করেন, তাঁহার নাম জয়ৎসেন। জয়ৎসেন বিদর্ভরাজদুহিতা সুশ্রবার পাণিপীড়ন করেন। সুশ্রবার গর্ভে অবাচীনের জন্ম হয়। তিনিও বিদর্ভদেশীয় মর্য্যদানাম্নী এক কামিনীর পাণিগ্রহণ করিয়া অরিহ নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। অরিহ অঙ্গরাজকন্যার পাণিগ্রহণ করিয়া তাঁহার গর্ভে মহাভৌম নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। মহাভৌমের ধর্ম্মপত্নী সুযজ্ঞা। তিনি অযুতনায়ী নামে এক পুৎত্র প্রসব করেন। যিনি অযুত-সংখ্যক পুরুষমেধ যজ্ঞ করিয়া অযুতনায়ী এই নাম লাভ করিয়াছিলেন। অযুতনায়ী পৃথুশ্রবার দুহিতা কামার পাণিগ্রহণ করিয়া অক্রোধন কলিঙ্গদেশ-সম্ভূতা করাম্ভাকে বিবাহ করেন। করম্ভার গর্ভে দেবাতিথির জন্ম হয়। দেবাতিথি বিদেহদেশোদ্ভবা মর্য্যাদানাম্নী কন্যার পাণিপীড়ন করিয়া অরিহ নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। অরিহ সুদেবাকে বিবাহ করেন। ঋক্ষ নামে তাঁহার এক পুৎত্র হয়। ঋক্ষ তক্ষকদুহিতা জ্বালার পাণিগ্রহণ করিয়া মতিনার নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। মতিনার সরস্বতীকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত দ্বাদশ বার্ষিক এক যজ্ঞ আরম্ভ করেন। সেই যজ্ঞ সমাপন হইলে সরস্বতী অভিগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে পতিত্বে বরণ করেন। অনন্তর সরস্বতীর গর্ভে মতিনারের এক পুৎত্র হইল; তাঁহার নাম তংসু। তংসু কলিঙ্গীর গর্ভে ঈলিন নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। ঈলিনের দুষ্মন্ত প্রভৃতি পাঁচ পুৎত্র হয়। দুষ্মন্ত বিশ্বামিত্রদুহিতা শকুন্তলাকে বিবাহ করেন। তাঁহার গর্ভে সুবিখ্যাত ভরতের জন্ম হয়।
ভরতজন্ম
শকুন্তলার প্রত্যাখ্যানকালে রাজা দুষ্মন্তের প্রতি এই দৈববাণী হইয়াছিল, “মহারাজ! শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করিবেন না, ইনি যাহা কহিতেছেন, সমুদয়ই সত্য; বালকটি আপনার ঔরসজাত; ইহা দ্বারা আপনার চরমে পরমফল স্বর্গফললাভ হইবে; অতএব যত্নপূর্ব্বক আত্মজের ভরণপোষণ করুন।” ভরণ করুন, এই দৈববাণী হইয়াছিল বলিয়া কুমারের নাম ভরত রহিল। ভরত-ভার্য্যা সুনন্দা ভূমন্যু নামে এক পুৎত্র প্রসব করেন। ভূমন্যুজায়া বিজয়া সুহোত্রের প্রসূতি। সুহোত্র ইক্ষ্বাকুবংশীয়া সুবর্ণার গর্ভে সুহোত্রের এক পুৎত্র হয়, তাঁহার নাম হস্তী। তিনি এক নগর স্থাপন করেন। সেই নগর প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে হস্তিনাপুর নামে বিখ্যাত হইল। হস্তী যশোধরার পাণিগ্রহণ করিয়া তাঁহার গর্ভে বিকুণ্ঠন নামক এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। বিকুণ্ঠনের পত্নীর নাম সুদেবা এবং পুৎত্রের নাম অজমীঢ়। অজমীঢ়ের চারি মহিষী;- কৈকেয়ী, গান্ধারী, বিশালা ও ঋক্ষা। তাঁহাদিগের গর্ভে রাজার চতুর্বিংশতিতম পুৎত্র হয়, তাঁহাদিগের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন বংশের উৎপত্তি হইল। কেবল সংবরণ হইতে পিতৃকুলের শ্রীবৃদ্ধি হইতে লাগিল। তিনি তপতীর পাণিগ্রহণ করিয়া কুরু নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। যদুবংশোদ্ভবা শুভাঙ্গী কুরুর মহিষী। তিনি বিদুরথ নামে এক পুৎত্র প্রসব করেন। বিদুরথের পত্নী সুপ্রিয়ার গর্ভে অনশ্বার জন্ম হয়। অনশ্বা অমৃতার গর্ভে পরীক্ষিৎকে উৎপাদন করেন। পরীক্ষিতের পত্নী সুযশা। তাঁহার গর্ভে ভীমসেনের জন্ম হয়। ভীমসেনের পত্নী কুমারী। তৎপুৎত্র প্রতীশ্রবা। প্রতীশ্রবার পুৎত্র প্রতীপ। প্রতীপের তিন পুৎত্র;-দেবাপি, শান্তনু এবং বাহ্লীক। তৃন্মধ্যে দেবাপি শৈশবাবস্থাতেই বনপ্রয়াণ করেন।
কৌরব-পাণ্ডব বংশ
শান্তনু প্রজাপালন করিতে লাগিলেন। তিনি জরাজীর্ণ ব্যক্তিকে স্পর্শ করিবামাত্র সে তৎক্ষণাৎ যুবার ন্যায় সবল হইয়া উঠিত, এই নিমিত্তে তাঁহার নাম শান্তনু হইল। শান্তনু গঙ্গাকে বিবাহ করেন। জাহ্নবীর গর্ভে দেবব্রত নামে তাঁহার এক পুৎত্র হয়-যাহাকে লোকে ভীষ্ম বলিয়া সম্বোধন করিত। ভীষ্ম পিতার প্রিয়চিকীর্ষু হইয়া সত্যবতীর সহিত তাঁহার বিবাহ দিলেন। পূর্ব্বে অনুঢ়াবস্থায় পরাশর-সহযোগে সত্যবতী গর্ভবতী হয়েন। তাহাতেই দ্বৈপায়নের জন্ম হয়। অধুনা সেই সত্যবতীর গর্ভে রাজা শান্তনুর দুই পুৎত্র হইল; একের নাম বিচিত্রবীর্য্য, অপরের নাম চিত্রাঙ্গদা। তন্মধ্যে চিত্রাঙ্গদ যৌবন-সীমায় উত্তীর্ণ না হইতেই গন্ধর্ব্ব-হস্তে নিহত হইলেন। বিচিত্রবীর্য্য রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎকাল পরে রাজা আত্মজের বদননিরীক্ষণসুখে বঞ্চিত হইয়া লোকান্তর গমনকরিলেন। অনন্তর সত্যবতী বংশরক্ষার নিমিত্ত চিন্তাকুল হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, “মাতঃ! কি নিমিত্ত স্মরণ করিয়াছেন, আজ্ঞা করুন।” সত্যবতী কহিলেন, “বৎস! তোমার ভ্রাতা বিচিত্রবার্য্য পুৎত্রবিহীন হইয়া সুরলোকে গমন করিয়াছেন; এক্ষণে তুমি তাঁহার উত্তম পুৎত্র উৎপাদন করিয়া বংশ-রক্ষা কর।” দ্বৈপায়ন মাতার আজ্ঞায় বিচিত্রবীর্য্যের ক্ষেত্রে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর এই তিন পুৎত্র উৎপাদন করিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুৎত্র হইবে বলিয়া বরদান করিলেন।
অনন্তর দ্বৈপায়নের বর-প্রভাবে গান্ধারীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুৎত্র হইল। তন্মধ্যে দুর্য্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ এবং চিত্রসেন এই চারিজন সর্ব্বপ্রধান। পাণ্ডুর দুই ভার্য্যা;- কুন্তী ও মাদ্রী। কুন্তীর আর একটি নাম পৃথা। একদিবস পাণ্ডুরাজ মৃগয়ার্থ গমন করিতে করিতে দেখিলেন, এক মহর্ষি কন্দর্পশরে বিদ্ধ হইয়া মৃগরূপ ধারণপূর্ব্বক এক মৃগীতে আসক্ত হইয়াছেন। রাজা সেই অদৃষ্টপূর্ব্ব অদ্ভুত ব্যাপার নয়নগোচর করিয়া বিস্মিত ও চমৎকৃত হইলেন এবং ঋষির কামক্রীড়ার সমাপ্তি ও পরিতৃপ্তি না হইতেই তাঁহাকে শরাঘাত করিলেন। ঋষি বাণাহত হইয়া পাণ্ডুকে অভিসম্পাত করিলেন, “তুমি অভিজ্ঞ হইয়াও আমাকে কামরসাস্বাদে বঞ্চিত ও বিনষ্ট করিলে, এই অপরাধে অচিরকালমধ্যে তোমাকেও এই অবস্থায় পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইতে হইবে।” রাজা শাপভয়ে ভীত ও বিবর্ণ হইয়া ভবনে প্রত্যাগমন করিলেন এবং তদবধি মহিষীদিগের সহবাস পরিত্যাগ করিলেন। অনন্তর একদিবস কুন্তীর নিকট সমস্ত মৃগয়াবৃত্তান্ত ও আপনার অবিমৃষ্যকারিত্ব১ সবিস্তর বর্ণন করিয়া কহিলেন, “রাজ্ঞি! আমি শুনিয়াছি, অপুৎত্র ব্যক্তি নিরয়গামী হয়; অতত্রব তুমি অপত্যোৎপাদন করিয়া আমার আয়তির শুভ-বিবাহ কর।”
কুন্তী স্বামীর আজ্ঞা পাইয়া ধর্ম্ম, মরুৎ এবং ইন্দ্রএই তিনজন দ্বারা যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জ্জুন এই তিন পুৎত্র উৎপাদন করিলেন। রাজা পুৎত্রদর্শনে পরম-প্রীত হইয়া কুন্তীকে কহিলেন, “তোমার সপত্নীও অপত্যবিহীনা, অতত্রব যাহাতে তাঁহার সন্তান হয়, তদ্বিষয়েও যত্ন করা কর্ত্তব্য।” কুন্তী ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া তৎক্ষণাৎ মাদ্রীকে আকর্ষণ-বিদ্যা প্রদান করিলেন। মাদ্রী সপত্নীদত্ত বিদ্যাবলে অশ্বিনীকুমার নামক দুই দেবতাকে স্মরণ করিবামাত্র তাঁহারা উপনীত হইয়া তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। অনন্তর মাদ্রী নকুল ও সহদেব এই দুই পুৎত্র লাভ করিলেন। একদা পাণ্ডু স্বীয় মহিষী মাদ্রীর রূপলাবণ্যে মোহিত এবং শাপবাক্য বিস্মৃত হইয়া মদনানল নির্ব্বাণ করিবার নিমিত্ত যেমন তাঁহাকে স্পর্শ করিলেন, অমনি পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন। তদ্দর্শনে মাদ্রী অত্যন্ত শোকার্ত্ত ও দুঃখিত হইয়া স্বামীর সহগমনে সঙ্কল্প করিলেন। তিনি চিতাগ্নিতে আরোহণ করিবার সময় নকুল ও সহদেবকে কুন্তীর হস্তে সমর্পণ করিয়া কহিলেন, “ইঁহাদিগের প্রতি অযত্ন না করিয়া যত্নপূর্ব্বক প্রতিপালন করিবেন; আমি এ জন্মের মত বিদায় হইলাম।” তদনন্তর কতিপয় তাপস পাণ্ডবদিগকে কুন্তী সমাভিব্যাহারে হস্তিনাপুরে লইয়া গিয়া ভীষ্ম ও বিদুরের সমীপে তাঁহাদের পরিচয় প্রদানপূর্ব্বক অন্তর্হিত হইলেন। এই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া দেবতারা দুন্দুভিধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন।
পাণ্ডবেরা সাদরে পরিগৃহীত হইয়া ভীষ্মাদির নিকট পিতার নিধনবৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন এবং তাঁহার ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া যথাবিধি সমাপন করিয়া তথায় স্বচ্ছন্দে কালযাপন করিতে লাগিলেন। তৎকালে দুর্য্যোধন তাঁহাদিগের কোন প্রকার অনিষ্ট চেষ্টা করিত না। এইরূপে পাণ্ডবগণের শৈশবাবস্থা অতীত হইল। পরে দুরাত্মা দুর্য্যোধন দুর্ব্বুদ্ধিপরতন্ত্র হইয়া তাঁহাদিগের অনিষ্ট করিবার নিমিত্ত নানাপ্রকার কৌশল করিতে লাগিল, কিন্তু নিরপরাধ পাণ্ডবদিগের সৌভাগ্যক্রমে সেই দুর্ব্বৃত্তের সমুদায় আশয় নিষ্ফল হইল। অনন্তর ধৃতরাষ্ট্র ছলনা করিয়া তাঁহাদিগকে বারণাবত নগরে প্রেরণ করিলেন। পাপিষ্ঠ দুর্য্যোধন তথাপি ক্ষান্ত হইল না। সে পাণ্ডবগণকে জতুগৃহে দগ্ধ করিবার নিমিত্ত অশেষবিধ চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু বিদুরের মন্ত্রণাবলে নৃশংসের অসদভিসন্ধি সমুদয় বিফল হইল। পাণ্ডবগণ নিরন্তর অনিষ্টাশঙ্কায় ভীত হইয়া বারণাবত নগর পরিত্যাগপূর্ব্বক একচক্রার্ভিমুখে প্রস্থান করিলেন। পথিমধ্যে হিড়িম্বের প্রাণসংহার করিয়া একচক্রায় উত্তীর্ণ হইলেন। তথায় বক-নামক এক দুর্দ্দান্ত নিশাচরের প্রাণসংহার করিয়া পাঞ্চাল-নগরে গমন করিলেন এবং দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক প্রত্যেকে এক একটি সর্ব্বলক্ষণাক্রান্ত পুৎত্র উৎপাদন করিলেন। যুধিষ্ঠিরের পুৎত্র প্রতিবিন্ধ্য, বৃকোদরের পুৎত্র সুতসোম, অর্জ্জুনের পুৎত্র শ্রুতকীর্ত্তি, নকুলের পুৎত্র শতানীক, সহদেবের পুৎত্র শ্রুতকর্ম্মা। পরে যুধিষ্ঠির গোবাসনের দুহিতা দেবিকাকে স্বয়ংবরে লাভ করিয়া তাঁহার গর্ভে যৌধেয় নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। ভীমসেন কাশীশ্বরকুমারী বলন্ধরার পালণণিপীড়ন করিয়া তদ্গর্ভে সর্ব্বগ নামে পুৎত্র উৎপাদন করেন। অর্জ্জুন দ্বারাবতীতে গমন করিয়া প্রিয়বাদিনী বাসুদেবভগিনী সুভদ্রার পাণিগ্রহণ করিয়া নির্ব্বিঘ্নে স্বদেশ প্রত্যাগমনপূর্ব্বক অভিমন্যু নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। অভিমন্যু কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। নকুল করেণুমতীর পাণিগ্রহণ করিয়া নিরমিত্র নামে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। সহদেব মদ্রাধিপতির কন্যা বিজয়াকে স্বয়ংবরে লাভ করিয়া তাহার গর্ভে এক পুৎত্র উৎপাদন করেন, তাঁহার নাম সুহোত্র। ভীমসেন পূর্ব্বে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচ নামে অপর পুৎত্র উৎপাদন করিয়াছিলেন। এইরূপে পাণ্ডবগণের একাদশ পুৎত্র হইল। তন্মধ্যে অভিমন্যু বংশধর হইয়াছেন। তিনি বিরাটের দুহিতা উত্তরার পাণিগ্রহন করেন। কিছুদিন পরে অভিমন্যুর সহযোগে উত্তরার গর্ভসঞ্চার হইল, কিন্তু তিনি দুর্ভাগ্যক্ক্রমে ষণ্মাসেই এক মৃতসন্তান প্রসব করিলেন। ভগবান্ বাসুদেব পৃথাকে আদেশ করিলেন, “তুমি এই পুৎত্রকে ক্রোড়ে ধারণ কর, আমি উহাকে জীবিত করিতেছি।” বাসুদেবের তেজঃপ্রভাবে সেই মৃতপুৎত্র পুনর্জ্জীবিত ও তৎপ্রদত্ত বল, বীর্য্য ও পরাক্রমে প্রবলপরাক্রান্ত হইয়া উঠিলেন। ফলতঃ বাসুদেবের অনুগ্রহে তাঁহার অকালজন্ম-নিবন্ধন বলবীর্য্য প্রভৃতি কোন বিষয়েই ন্যুনতা রহিল না। সেই পুৎত্র কুলের ক্ষীণাবস্থায় জন্মিয়াছিলেন বলিয়া বাসুদেব তাঁহার নাম পরীক্ষিৎ রাখিলেন। পরীক্ষিৎ মাদ্রীকে বিবাহ করেন। মহারাজ! আপনি সেই পরীক্ষিতের ঔরসে মাদ্রীগর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। আপনার ভার্য্যা বপুষ্টমা শতানীক ও শঙ্কুকর্ণ নামে দুইটি পুৎত্র প্রসব করিয়াছেন। বৈদেহীর গর্ভে শতানীকের এক পুৎত্র জন্মে, তাঁহার নাম অশ্বমেধদত্ত। মহারাজ! পরমধন্য ও পরমপবিত্র কুকু ও পাণ্ডবদিগের বংশের ইতিবৃত্ত আপনার নিকট কীর্ত্তন করিলাম। নিয়মবিশিষ্ট হইয়া ব্রাহ্মণদিগের ইহা শ্রবণ করা কর্ত্তব্য, স্বধর্ম্মনিরত প্রজাপালনতৎপর রাজাদিগের শ্রোতব্য, বৈশ্যদিগের শ্রোতব্য, বোদ্ধব্য এবং ত্রিবর্ণ- শুশ্রূষু১ শূদ্রদিগেরও শ্রদ্ধাপূর্ব্বক শ্রবণ করা কর্ত্তব্য। যাহারা পরস্পর নির্মৎসর২ মিত্রভাবাপন্ন হইয়া এই পরমপবিত্র ইতিহাস সমস্ত শ্রবণ করান কিংবা করেন, তাঁহারা স্বর্গধামে গমন করেন এবং দেবতা, ব্রাহ্মণ ও মনুষ্যগণের পরম-পূজনীয় ও মাননীয় হন, সন্দেহ নাই। ভগবান্ ব্যাসদেব কহিয়াছেন, ব্রাহ্মণাদি বর্ণ-সকল পরস্পর নির্মৎসর ও শ্রশ্রূষান্বিত হইয়া এই পরম-পবিত্র ভারত শ্রবণ করিলে সুকৃতিলাভপূর্ব্বক সুরলোকে গমন করিতে পারিবেন। এই মহাভারত পরমপবিত্র, পরমোৎকৃষ্ট, পরমরমণীয় ও বেদস্বরূপ; ইহা আয়ুষ্কর ও যশস্কর; অতত্রব ইহা অবশ্যই শ্রোতব্য।