০৭০.কণ্ব মুনির আশ্রমসমৃদ্ধি

সপ্ততিতম অধ্যায়
কণ্ব মুনির আশ্রমসমৃদ্ধি

বৈশম্পায়ন কহিলেন, এইরূপে রাজা দুষ্মন্ত সৈন্যসমভিব্যাহারে সহস্র সহস্র মৃগের প্রাণবধ করিয়া অন্য এক বনে প্রবেশ করিলেন। মহারাজ দুষ্মন্ত মৃগের অনুসরণক্রমে সেই বনের প্রান্তভাগে এক মহৎ প্রান্তর দেখিতে পাইলেন। অনন্তর সেই প্রান্তর অতিক্রম করিয়া সুশীতল সমীরণভরে সঞ্চালিত, আশ্রম সমাকীর্ণ অন্য এক পরম-রমণীয় মহারণ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। ঐ বন সুপুষ্পিত পাদপসমূহে সমাকীর্ণ, সুকোমল বালতৃণ দ্বারা আচ্ছাদিত ও বৃক্ষগণের শাখাচ্ছায় আবৃত। উহার কোন স্থানে ময়ূর, পুংস্কোকিল প্রভৃতি নানাবিধ পক্ষিগণ সুমধুরস্বরে কলরব করিতেছে; কোন স্থানে ঝিল্লীগণ নিনাদ করিতেছে; কোথাও বা ভ্রমরগণ ঝঙ্কার করিতে করিতে এক পুষ্প হইতে পুষ্পান্তরে বসিতেছে। ঐ বনে কোন বৃক্ষই ফলপুষ্পহীন বা কণ্টকাবৃত ছিল না এবং যে পুষ্পে ভ্রমর নাই, এমন পুষ্পও ছিল না। রাজা বিহগকুলনিনাদিত, বহুবিধ সুগন্ধি কুসুমে সুশোভিত, সর্ব্বত্তুকুসুমকীর্ণ [সকল ঋতুতে সমানভাবে পর্যাপ্ত পুষ্পশোভিত], সুখচ্ছায়া-সমাবৃত, সেই মনোহর বনে প্রবেশ করিবা মাত্র সুপুষ্পিত তরুগণ সমীরণবেগে সঞ্চালিত হইয়া তাঁহার মস্তকোপরি পুনঃ পুনঃ পুষ্পবর্ষণ করিতে লাগিল; বিচিত্র কুসুমযুক্ত অত্যুন্নত বৃক্ষশ্রেণীতে পক্ষিগণ সুমধুরস্বরে গান করিতে লাগিল এবং পুষ্পভারাবনত তরুপল্লবে মধুলুব্ধ মধুকরগণ সুমধুরস্বরে গুন্‌গুন্ ধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। রাজা কুসুমিতলতামণ্ডপে [পুষ্পিত লতাকুঞ্জ] সমাকীর্ণ তত্রত্য পরম-রমণীয় প্রবেশ-সকল অবলোকন করিয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন এবং দেখিলেন, পুষ্পভারাবনত ভিন্ন ভিন্ন বৃক্ষসমূহের শাখাসকল পরস্পর সংশ্লিষ্ট হইয়া ইন্দ্রধ্বজের [ইন্দ্রপ্রীতিরজন্য তদীয় উৎসবার্থ নির্ম্মিত মণ্ডপের পতাকাদণ্ড] শোভা সম্পাদন করিতেছে। সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরাগণ, মত্ত বানরযূথ ও কিন্নরসমূহ তথায় নিরন্তর বাস করিতেছে এবং পুষ্প রেণুবাহী, সুখস্পর্শ, সুশীতল সুগন্ধ গন্ধবহ [বায়ু] সর্ব্বদা বহিতেছে।

এইরূপে রাজা সেই পরম-রমণীয় নদীকচ্ছস্থ [নদীতটস্থিত] বনের শোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন, ইত্যবসরে তন্মধ্যে এক শান্তরসাস্পদ আশ্রমপদ দেখিতে পাইলেন। আশ্রমটি নানাবিধ বৃক্ষে সমাকীর্ণ ও তাহার মধ্যস্থলে আহবনীয় অগ্নি প্রজ্বলিত রহিয়াছে; বালখিল্য প্রভৃতি মুনিগণ চারিদিকে উপবিষ্ট রহিয়াছেন এবং পুষ্পসংস্তরণযুক্ত [যে স্থানে পুষ্পরাশি বিছান থাকে এইরূপ] অগ্নিগৃহসকল শোভা পাইতেছে। ঐ আশ্রমের সমীপে হংস, বক, চক্রবাক প্রভৃতি বহুবিধ জলচর পক্ষিগণে সঙ্কীর্ণা, পুণ্যোদকা [পবিত্র জলযুক্তা], সুখস্পর্শা, মালিনী নদী প্রবাহিত হইতেছে। তথায় সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদগণও শান্তিগুণাবলম্বী। তদ্দর্শনে রাজা সাতিশয় আহ্লাদিত ও চমৎকৃত হইলেন। মহারাজ দুষ্মন্ত অমর লোক-সদৃশ সেই মনোহর আশ্রমের সমীপবর্ত্তিনী, সর্ব্বজীব জননীতুল্যা, পুণ্যতোয়া সেই মালিনী নদীর শোভা অবলোকন করিতে করিতে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাহার পুলিনে চক্রবাক সকল সতত ক্রীড়া করিতেছে; কিন্নরগণ সর্ব্বদা বাস করিতেছে; বানর-ভল্লুকাদি জন্তুগণ অবিরত বিচরণ করিতেছে; তপোধনগণ নিরন্তর বেদধ্বনি করিতেছেন এবং মত্ত হস্তিযূথ শার্দ্দূলযূথ ও ভুজগেন্দ্রগণ অনবরত ক্রীড়া করিতেছে।

ঐ আশ্রম ভগবান্ কাশ্যপের পুণ্যাশ্রম। মালিনী নদী এবং মহর্ষিগণসেবিত সেই পরমরমণীয় আশ্রম দর্শনে রাজা দুষ্মন্ত অত্যন্ত কৌতুকাক্রান্ত হইয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করিতে বাসনা করিলেন। রাজা মালিনী নদী দ্বারা বেষ্টিত, বৈকুণ্ঠধামবৎ সুশোভিত, মত্তময়ুরনাদে নিনাদিত সেই চৈত্ররথ-সদৃশ মহারণ্যের সম্মুখে সমুপস্থিত হইয়া অশেষগুণালঙ্কৃত কশ্যপাত্মজ মহর্ষি কণ্বকে দর্শন করিবার অভিলাষে সেই স্থানে চতুরঙ্গিণী সেনা সংস্থাপন করিলেন এবং কহিলেন, “আমি ভগবান্ কণ্ব তপোধনকে দর্শন করিতে চলিলাম; যতক্ষণ না প্রত্যাগমন করিব, তোমরা এই স্থানেই অবস্থান কর।” তাহাদিগকে এই কথা বলিয়া সমস্ত রাজচিহ্ন পরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল অমাত্য ও পুরোহিত সমভিব্যাহারে তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়া নানা প্রকার আশ্চর্য্য শোভা সন্দর্শনে রাজা ক্ষুৎপিপাসা বিস্মৃত ও সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। আরও দেখিলেন, কোন স্থানে কুসুমিত তরুকলাপে [বৃক্ষশ্রেণীতে] অলিগণ ঝঙ্কার করিতেছে; কোন স্থানে বিহগকুল বৃক্ষশাখায় বসিয়া কলরব করিতেছে; কোন স্থানে ঋগ্বেদী বিপ্রগণ যজ্ঞকার্য্যে উদাত্তাদিস্বরে [বৈদিক স্বর সম্বন্ধীয় উচ্চারণক্রমে] বেদধ্বনি করিতেছেন; কোন স্থানে চতুর্ব্বেদবেত্তা নিয়তব্রত মহর্ষিগণ উপবিষ্ট রহিয়াছেন; স্থানান্তরে যতাত্মা, জিতেন্দ্রিয়, অথর্ব্ববেদবেত্তা ও সামগাতাসকল পদক্রমাদি-সহিত সংহিতা উচ্চারণ করিতেছেন। কোথাও বা শব্দ সংস্কারসম্পন্ন দ্বিজগণ বেদগান দ্বারা সেই ব্রহ্মলোক-সদৃশ আশ্রমকে নিনাদিত করিতেছেন; কোন স্থলে যজ্ঞানুষ্ঠানক্রম, পুরাণ, ন্যায়, তত্ত্ব, আত্মবিবেক, শব্দশাস্ত্র, ছন্দঃ নিরুক্ত ও বেদবেদাঙ্গ প্রভৃতি নানা শাস্ত্রে পারদর্শী, বিশেষ কার্য্যজ্ঞ, মোক্ষধর্ম্মপরায়ণ, উহাপোহ [তর্করহিত] সিদ্ধান্ত-কুশল, দ্রব্য-কর্ম্মের গুণজ্ঞ, কার্য্যকারণবেত্তা, পক্ষী ও বানর প্রভৃতি জীবগণের বাক্যার্থবোদ্ধা মহর্ষিগণ নানাশাস্ত্রের বিচার করিতেছেন এবং বৌদ্ধমতালম্বী লোকেরা নিজ ধর্ম্মের আলোচনা করিতেছেন। শত্রুহন্তা রাজা দুষ্মন্ত জপহোমপরায়ণ সেই সকল একনিষ্ঠ বিপ্রগণকে সন্দর্শন করিতে করিতে আশ্রমসমীপে উত্তীর্ণ হইলেন। মুনিগণ অতি প্রযত্নপূর্ব্বক রাজাকে যে-সকল বিচিত্র আসন প্রদান করিলেন, তদ্দর্শনে তিনি বিস্ময়াপন্ন হইলেন। রাজর্ষি, মহর্ষি কণ্বের সুরক্ষিত ও বিবিধ গুণযুত সেই আশ্রমপদ যতই অবলোকন করিতে লাগিলেন, ততই তাঁহার দর্শনৌৎসুক্য বাড়িতে লাগিল।