১৮২. কল্মাষপাদের ক্ষেত্রজপুত্ররহস্য
দ্ব্যশীত্যধিকততম অধ্যায়।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন, হে গন্ধর্বরাজ! রাজা কল্মাষপাদ কোন কারণ অবলম্বন করিয়া স্বীয় মহিষীকে বশিষ্ঠের নিকট নিয়োগ করিলেন? এবং সেই ধর্মজ্ঞ মহর্ষিই বা গুরু হইয়া কিরূপে সেই অগম্য। শিষ্যাতে রত হইলেন? তিনি কি ইতিপূর্বে কোনপ্রকার অধর্মাচরণ করিয়াছিলেন? আমি এই বিষয়ে অত্যন্ত সন্দিহান হইয়াছি, অতএব হে সখে! অনুপূর্বিক বর্ণনা করিয়া আমার সংশয় নিরাকরণ কর।
গন্ধর্বরাজ কহিলেন, হে ধনঞ্জয়! রাজা কল্মাষপাদ ও বশিষ্ঠের বিষয় যাহা জিজ্ঞাসা করিলে, তৎসমুদায় সবিস্তর বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! পূর্বে কথিত হইয়াছে যে, বশিষ্ঠাত্মজ মহাত্মা শক্তি রাজা কল্মাষপালকে অভিসম্পাত করেন। রাজা শাপগ্রস্ত ও ক্রোধপরবশ হইয়া নগর পরিত্যাগ পূর্বক পত্নী সমভিব্যাহারে এক নিবিড় অরণ্যানী প্রবেশ করিলেন। সেই অরণ্য নানাজাতীয় জগণে সমাকীর্ণ, পাপসমুহে আবৃত ও লতাগুল্মে অঙ্গ। রাজা তথায় ভ্রমণ করিতে করিতে শত সহস্র হিংস্র জন্তুর ভয়ঙ্কর গভীর রব শ্রবণ করিতে লাগিলেন। একদা সেই রাক্ষসরূপী ভূপাল ক্ষুধা শাস্তির নিমিত্ত আহারান্বেষণ করিতেছিলেন, এমত সময়ে দেখিলেন, এক বিপ্ৰদম্পতী কামক্রীড়ায় আসক্ত হইয়াছেন। তাহারা রাজাকে নয়নগোচর করিয়া কৃতকাৰ্য্য না হইতেই ভয়ে পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেন। রাজা পলায়নপর ব্রাহ্মণকে বলপূর্বক ধারণ করিলেন; ব্রাহ্মণী স্বামীকে গৃহীত দেখিয়া কহিলেন, হে রাজন! আমার এক নিবেদন আছে, শ্রবণ করুন। আপনি আদিত্যবংশে প্রসূত, সর্বলোকে সুবিখ্যাত; বিশেষতঃ ধর্মানুষ্ঠান ও গুরুজনশুশ্রুষায় অনুরক্ত, অতএব আপনার পাপাচরণ করা নিতান্ত অবিধেয়। আমি ঋতুকাল উপস্থিত দেখিয়া সন্তানার্থ তার সহিত সঙ্গত হইয়াছিলাম, অধুনাপি কৃতার্থ হইতে পারি নাই, অতএব হে মরনাথ। এক্ষণে প্রসন্ন হইয়া আমার স্বামীকে পরিত্যাগ করুন। রাজা বিক্রোশমানা সেই কামিনীর প্রার্থনাবাক্যে উপেক্ষা প্রদর্শন পূর্বক ব্যাঘ্র যেমন মৃগকে গ্রাস করে সেইরূপে তাহার স্বামীকে ভক্ষণ করিলেন তদ্দর্শনে ক্রোধাভিভূতা ব্রাহ্মণীর যতগুলি অশ্রুবিন্দু ভূতলে পতিত হইল, সমুদায় প্রজ্বলিত হুতাশন হইয়া সেই বনপ্রদেশ দগ্ধ করিতে লাগিল।
অনন্তর ভর্তৃবিয়োগবিধুরা শোকসন্তপ্তা ব্রাহ্মণী ক্রোধভরে রাজর্ষি কল্মাষপাদকে অভিসম্পাত করিলেন,-“রে দুর্বুদ্ধিপরতন্ত্র নৃপাধম! তুমি যেমন মনোরথ পরিপূর্ণ না হইতেই আমার সমক্ষে প্রিয়তমের প্রাণসংহার করিলে, তোমাকেও সেইরূপ ঋতুকালে পত্নীসহযোগ করিবামাত্র পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইতে হইবে। তুমি যাহার পুত্র বিনষ্ট করিয়াছ, সেই মহর্ষি বশিষ্ঠের, ঔরসে তোমার পত্নী পুত্রোৎপন করিবেন। সেই পুত্র তোমর বংশধর হইবে।” মহর্ষি অঙ্গীরার পুত্রী রাজাকে এইরূপে অভিসম্পাত করিয়া তাঁহার সমক্ষে প্রদীপ্ত হুতাশনে প্রবেশ করিলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ সমাধিবলে এই সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিলেন।
অনন্তর বহুকাল অতীত হইলে রাজা শাপবিমুক্ত হইলেন। একদা ভূপাল পত্নীর ঋতুকাল উপস্থিত দেখিয়া শাপবৃত্তান্ত বিস্মরণপূর্বক কমান্ধচিত্তে তদীয় সহবাসে উদ্যত হইলেন। দেবী তাঁহাকে প্রতিষেধ করিলেন। তখন পত্নীবাক্য শ্রবণে শাপবৃত্তান্ত তাহার, স্মৃতিপথে উদিত হওয়াতে তিনি যৎপরোনাস্তি পরিতাপ করিতে লাগিলেন। হে পার্থ! রাজা কল্মাষপাদ শাপগ্রস্ত হওয়াতে কুলগুরু বশিষ্ঠের নিকট স্বীয় পত্নীকে নিয়োগ করিয়াছিলেন।