১৭৫. গন্ধর্ববর্ণিত বশিষ্ট-বিশ্বামিত্র উপাখ্যান
পঞ্চসত্যধিকশততম অধ্যায়।
অর্জুন কহিলেন, হে গন্ধৰ্বরাজ! বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠ ইঁহারা দুই জনেই দিব্য আশ্রমে বাস করিতেন, অতএব কি কারণে উভয়ের বৈরভাব জন্মে, তাহা আদ্যোপান্ত সমুদয় বর্ণনা কর। গন্ধর্বরাজ কহিলেন, হে অর্জুন! সৰ্বলোকমধ্যে বশিষ্ঠোপাখ্যান অতি প্রাচীন বলিয়া প্রসিদ্ধ; অতএব আমি ঐ উপাখ্যান সম্যকরূপে বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর।
কান্যকুব্জ দেশে কুশিকতনয় গাধিনামে এক সুবিখ্যাত রাজা ছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম বিশ্বামিত্র। একদা বিশ্বামিত্র অমাত্য সমভিব্যাহারে মৃগয়ার্থ এক নিবিড় অরণ্যানীমধ্যে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া কোন রমণীয় প্রদেশে মৃগ বরাহ শীকারপূর্বক ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর মৃগয়ালোলুপ রাজা মৃগের অনুসরণে একান্ত পরিশ্রান্ত ও পিপাসার্ত হইয়া মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে উপনীত হইলেন। বশিষ্ঠ তাহাকে অভ্যাগত দেখিয়া পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয় ও বন্য হবিঃ প্ৰদান করিয়া স্বাগত প্রশ্নপূর্বক অতিথি সৎকার করিলেন। মহর্ষির এক কামধেনু ছিল। প্রার্থনা করিলেই ঐ ধেনু তৎক্ষণাৎ অভিলষিত সম্পাদন করিতেন। ঐ ধেনু গ্রাম্য ও আরণ্য বিবিধ ওষধি, দুগ্ধ, ষড় বিধ-রসসম্পন্ন অমৃততুল্য অনুভম রসায়ন, চর্ব্য, চোষ্য, লেহ, পেয়, চতুৰ্বিধ মিষ্টান্ন, বহুমূল্য রত্ন ও বিচিত্র বসন প্রভৃতি অপূর্ব দ্রব্য সকল দোহন করিলেন। বশিষ্ঠ সেই সমস্ত ইষ্ট বস্তুদ্বারা রাজার অর্চনা করিলেন। অমাত্যসহিত রাজা আতিথ্যসৎকার গ্রহণপূর্বক সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। মহর্ষির ধেনু পঞ্চহস্ত আয়ত ও ছয়হস্ত উচ্চ, তাহার নেত্রযুগল মণ্ডকের ন্যায় উচ্ছন, পার্শ্ব ও ঊরু মনোহর, পুচ্ছ অতি সুন্দর, পয়োধর স্থূল এবং গ্রীবা ও মস্তক পুষ্ট ও আয়ত। গাধিনন্দন সেই সুচারুশৃঙ্গা ও অনিন্দিতা নন্দিনীকে নেত্রগোচর করিয়া সাতিশয় বিস্মিত হইলেন এবং তাহার বিস্তর প্রশংসা করিয়া কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! অৰ্ব্বদসংখ্যক গো বা আমার সমুদায় রাজ্য লইয়া আপনি এই হোমধেনুটী আমাকে প্রদান করুন। বশিষ্ঠ কহিলেন, মহারাজ! আমি রাজ্যলোভে দেবকাৰ্য্য, পিতৃকাৰ্য্য, অতিথি সৎকার ও যজ্ঞানুষ্ঠান সমাধানের একমাত্র উপায়স্বরূপ পয়স্বিনী নন্দিনীকে প্রদান করিতে পারিব না। তখন বিশ্বামিত্র কহিলেন, আমি ক্ষত্রিয় জাতি,আপনি তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ। প্রশান্তচিত্ত ব্রাহ্মণের বলবীর্য্যের কথা কাহারও অবিরত নাই; অতএব যদি অর্বুদ সংখ্যক গো গ্রহণপূর্বক আমার মনেভিলাষ সফল করিতে পরাঙ্মুখ হয়েন, তাহা হইলে আমি স্বজাতিসুলভ বল প্রকাশ করিয়া আপনার গোপন লইয়া যাইব। বশিষ্ঠ কহিলেন,-মহারাজ! তুমি মহাবল পরাক্রান্ত রাজা এবং ভুঙ্গবীৰ্যসম্পন্ন ক্ষত্রিয়, অতএব এ বিষয়ে কোন বিচার না করিয়া অবিলম্বে যাহা ইচ্ছা হয় কর।
অনন্তর বিশ্বামিত্র বলপূর্বক হংসশশিস-রূপশালিনী সেই নন্দিনীকে অপহরণ করিলেন। নন্দিনী দণ্ড প্রহারে ও কশাঘাতে একান্ত পীড়িত হইলেন এবং ইতস্ততঃ নিরোধ্যমনি হইলেও হরবে ধাবমান হইয়া বশিষ্ঠসম্মুখে আগমনপূর্বক উৰ্দ্ধমুখে দণ্ডায়মান রহিলেন। রাজবল তাহাকে অত্যন্ত তাড়না করিতে লাগিল, তথাপি তিনি মহর্ষির আশ্রম পরিত্যাগ করিলেন না। বশিষ্ঠদেব তাঁহাকে কহিলেন, হে ভদে! আমি তোমার করুণস্বরপূর্ণ হবে বারম্বার কর্ণগোচর করিতেছি, বিশ্বামিত্র তোমাকে বলপূৰ্ক ক হরণ করিতেছেন, আমি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ, কি করি বল? এই কথা শুনিয়া নন্দিনী সৈন্যভয়ে ও বিশ্বামিত্ৰভয়ে একান্ত ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া মহর্ষির সন্নিকৃষ্ট হইলেন এবং কহিলেন, ভগবন্! দুর্দণ্ড রাজবল প্রচণ্ড কশাদণ্ডদ্বারা বারম্বার আমাকে প্রহার করিতেছে। প্রহারবেগে আমি নিতান্ত অশরণ ও অনাথার ন্যায় অতি কাতর স্বরে রোদন করিতেছি; এ সময় আপনি কি নিমিত্ত আমার প্রতি উপেক্ষা করিতেছেন। নন্দিনী প্রধর্ষিত হইয়া এইরূপ ক্রন্দন করিতে লাগিলেন, তথাপি ধুতব্ৰত মহর্ষি ক্ষুব্ধ বা পৈৰ্য্য হইতে বিচলিত হইলেন না, কেবল এইমাত্র বলিলেন, হে কল্যাণি! ক্ষত্রিয়দিগের তেজঃ বল, আর ব্রাহ্মণদিগের ক্ষমা বল হয়। আমি ক্ষমাপরায়ণ ব্রাহ্মণ,কি প্রতীকার করিব, এক্ষণে যদি তোমার ইচ্ছা হয় তবে গমন কর। তখন নন্দিনী কহিলেন, হে ভগবন্! আপনকার এই কথা শুনিয়া বোধ হইতেছে, আপনি আমাকে ত্যাগ করিলেন; কিন্তু যদি পরিত্যাগ না করেন, তাহা হইলে বলপূর্বক কেহই আমাকে লইয়া যাইতে পারিবে না। বশিষ্ঠ কহিলেন, হে নন্দিনি! আমি তোমাকে ত্যাগ করিতে চাহি না, যদি সমর্থ হও, তবে আমার আশ্রমে অবস্থান কর। দেখ, এই অরাতিরা বল প্রকাশপূর্বক তোমার বসকে সুদৃঢ় রজ্জবদ্ধ করিয়া অপহরণ করিতেছে।
তখন সেই পয়স্বিনী আশ্রমে বাস করা যে মহর্ষির অভিপ্রায়, ইহা বুঝিতে পারিলেন এবং তৎক্ষণাৎ ক্রোধে অরিক্তলোচন হইয়া অতি ঘোর রূপ ধারণপূর্বক গ্রীবাদেশ উন্নত করিয়া ঘন ঘন হম্বীরব পরিত্যাগ সহকারে সৈ গাভিমুখে ধাবমান হইলেন। কশাদণ্ডদ্বারা বারংবার আহত ও ইতস্ততঃ নিয়োধ্যমান হইলে তাহার ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি ক্রোধোদ্দীপ্ত হইয়া মধ্যাহুকালীন দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তদীয় বালধি হইতে জ্বলন্ত অঙ্গার বৃষ্টি হইতে লাগিল। পুচ্ছ হইতে পহ্নব, প্রস্নব হইতে দ্রাবিড় ও শক এবং যোনিদেশ হইতে যবনেরা উৎপন্ন হইল। গোময় হইতে কিরাতজাতি, মূত্র হইতে কাঞ্চী ও পার্শ্বদেশ হইতে শরভকুল জন্ম গ্রহণ করল। ফেনপুঞ্জ হইতে পৌণ্ড্র, সিংহল, বৰ্বর, খশ, চিবুক, পুলিন্দ, চীন, হূন, কেরল ও অন্যান্য বহুবিধ ম্লেচ্ছ জাতি উৎপন্ন হইল। দেখিতে দেখিতে নানাবরণসংচ্ছন্ন সেই বিপুল ম্লেচ্ছবল বহুবিধ অস্ত্র শস্ত্র ধারণপূর্বক ক্রোধাতিরেক সহকারে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইল। বিশ্বামিত্রের সমক্ষে তাঁহার বহুসংখ্যক সৈন্য বশিষ্ঠ-সৈন্যমণ্ডলীর সুতীক্ষ্ণ শরজালে আহত ও ভীত হইয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল। বশিষ্ঠসৈন্য ক্রোধে নিতান্ত অধীর হইয়াছিল বটে, কিন্তু রণক্ষেত্রে বিশ্বামিত্রর একটী সৈন্যেরও প্রাণ সংহার করে নাই। ঋষিধেনু বিপক্ষ সৈন্যদিগকে অতি দূরতর প্রদেশ পর্যন্ত অবরোধ করিলেন। রাজসংক্রান্ত সৈন্যেরা ত্রিযোজন অবধি অবরুদ্ধ হইয়া আর্তনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। পরিশেষে প্রাণভয়ে একান্ত ভাত ও উদ্বিগ্ন হইয়া আশ্রয়লাভে কতসঙ্কল্প হইল, কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিল না।
মহারাজ বিশ্বামিত্র ব্রহ্মতেজঃ সম্ভুত এই সুমহৎ ব্যাপার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া সাতিশয় বিস্মিত হইলেন এবং ক্ষত্রিয়ভাবে নিতান্ত বিরাগ প্রদর্শন পূর্বক কহিতে লাগিলেন, ক্ষত্রিয়বলে ধিক্, ব্রহ্মতেজঃ যথার্থ বল। বলাবল নির্ণয়স্থলে তপোবলকেই পরমবল বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে হয়। এইরূপ স্থির সিদ্ধান্ত করিয়া তিনি অতি বিস্তীর্ণ রাজ্য, অসামান্য রাজলক্ষী ও কমনীয় বস্তুর ভোগাভিলাষ এককালে পরিত্যাগপূর্বক তপস্যায় মনোনিবেশ করিলেন। তৎপরে তপঃসিদ্ধিসম্পন্ন হইয়া তিনি তেজঃপ্রভাবে ত্রিলোককে অভিভূত করিতে লাগিলেন। পরিশেষে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়া দেবরাজ ইন্দ্রের সহিত সোমরস পান করিয়াছিলেন।