২৯তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের সানুনয় সংবাদবার্ত্তা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে নরদেব! আমি আপনাকে আমন্ত্রণ করিয়া প্ৰস্থান করি; আপনি সুখস্বচ্ছন্দে অবস্থান করুন। হে দেব! আমার অন্তঃকরণ অভিভূত হইয়াছিল, তন্নিমিত্ত আমি যথাক্রমে যদি কোন দোষ উল্লেখ করিয়া থাকি, তাহা হইলে এক্ষণে ভীমসেন, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, চেকিতান ও আপনাকে আমন্ত্রণ করিতেছি। আপনারা আমার প্রতি প্ৰসন্ননেত্ৰে দৃষ্টিপাত করুন।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি অনুজ্ঞা করিতেছি, এক্ষণে সুখে গমন কর। হে বিদ্বন! তুমি কদাপি আমাদিগের অপ্রীতিকর বিষয় স্মরণ করিও না; আমরা তোমাকে শুদ্ধাত্মা, মধ্যস্থ [উভয়পক্ষের পক্ষপাতশূন্য বিবাদমীমাংসক] ও সভ্য বলিয়া জানি। তুমি কল্যাণভাষী, সুশীল, সন্তুষ্টচিত্ত, আপ্তদূত [ভ্রমপ্রমদশূন্য—যাঁহার ভুল ভ্রান্তি নাই] ও অত্যন্ত প্রীতির আস্পদ। আমরা জানি, কখন তোমার বুদ্ধিভ্রংশ হয় না, দুর্ব্বাক্য কহিলেও তুমি কুপিত হও না, কদাপি মৰ্মভেদী, রুক্ষ, নীরস, অপ্রকৃত বার্ত্তা প্রকটিত কর না; প্রত্যুত ধর্ম্মার্থসঙ্গত কারুণ্যপূর্ণ বাক্যই ব্যবহার করিয়া থাক। অতএব তুমিই প্রিয়তম দূত অথবা দ্বিতীয় বিদুরস্বরূপ হইয়া আমাদের নিকট আগমন করিয়াছ। তুমি ধনঞ্জয়ের আত্মসম সখা, পূর্ব্বে আমরা পুনঃ পুনঃ তোমাকে নয়নগোচর করিয়াছি।
“হে সঞ্জয়! এক্ষণে এ স্থান হইতে প্ৰস্থান করিয়া বিশুদ্ধবীৰ্য্য, কঠকৌথুম্যাদি চরণসম্পন্ন [ব্ৰহ্মচৰ্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক কঠকৌধুমাদি বেদশাখার অধ্যয়নশীল], কুলীন, সর্ব্বধর্ম্মপরায়ণ, উপাসনার্হ ব্রাহ্মণগণকে উপাসনা করিবে। আর স্বাধ্যায়ী [বেদাধ্যায়ী], ভিক্ষু, তপস্বী ও বনবাসী ব্রাহ্মণ এবং বৃদ্ধগণকে অভিবাদন ও অন্যান্য ব্যক্তিদিগকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুরোহিত, আচাৰ্য্য ও ঋত্বিকগণের সহিত যথাযোগ্য কুশলে মিলিত হইবে। তথায় যে-সকল মহানুভব শীলবলসম্পন্ন বৃদ্ধ অশ্রোত্ৰিয়া [শূদ্ৰাদি] বাস করেন, যাঁহারা আমাদিগের বিষয় কথোপকথন ও আমাদিগকে স্মরণ করিয়া থাকেন, যাঁহারা ধর্মের লেশমাত্রও অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন, যাঁহারা রাজ্যমধ্যে বাণিজ্যাদি দ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া থাকেন এবং যেসকল স্থানাধিকারী [স্ব স্ব রন্তিদ্বারা পুত্রাদির পালনকারী] রাজ্যমধ্যে বাস করেন, তাঁহাদিগকে প্রথমে আমাদের কুশলসংবাদ প্ৰদান করিয়া পশ্চাৎ তাঁহাদিগের অনাময়-জিজ্ঞাসা করিবে। নীতিপরায়ণ, বিনয়গ্রাহী, অভীষ্ট আচাৰ্য্য দ্রোণ বেদলাভার্থ ব্ৰহ্মচৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন এবং অস্ত্ৰকে মন্ত্র, উপচার, প্রয়োগ ও সংহাররূপ পদচতুষ্টয়ে শোভিত করিয়াছেন। তুমি সেই প্রসন্নস্বভাব আচাৰ্য্যকে অভিবাদন করিবে। যিনি অস্ত্রকে পুনর্ব্বার চতুস্পাদসম্পন্ন করিয়াছিলেন, সেই অধীতবিদ্যা কঠকৌথুমাদিচরণোৎপন্ন গন্ধর্ব্বকুমারসদৃশ তপস্বী অশ্বত্থামাকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। মহারথ আত্মতত্ত্ববিৎ কৃপাচাৰ্য্যের আলয়ে প্রবেশ করিয়া পুনঃ পুনঃ আমার নাম কীর্ত্তনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিবে। শৌৰ্য্য, দয়া, তপ, প্রজ্ঞা, শীল, শ্রুতি, সত্ত্ব ও ধূতি-সম্পন্ন কুরুসত্তম ভীষ্মের পাদদ্বয় গ্রহণ করিয়া আমার বৃত্তান্ত নিবেদন করিবে। প্রজ্ঞাচক্ষু [শাস্ত্ৰজ্ঞানসম্পন্ন] কুরুকুলের প্রণেতা, বহুশাস্ত্ৰবিৎ, বৃদ্ধসেবী, মনীষী, স্থবিররাজ [অতি বৃদ্ধ] ধৃতরাষ্ট্রকে অভিবাদনপূর্ব্বক আমার অনাময়সংবাদ প্রদান করিবে। ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র, পাপিষ্ঠ, শঠ, মূর্খ, অখণ্ডভূমণ্ডলের অধিপতি দুৰ্য্যোধন ও তৎসদৃশ শীলাসম্পন্ন মহাধনুৰ্দ্ধর কুরুকুলের শূরতম দুঃশাসনকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। যিনি প্রতিনিয়ত ভরতকুলের সন্ধি কামনা করেন, সেই সাধুশীল মনীষী বাহ্লীকশ্রেষ্ঠকে অভিবাদন করিবে। যিনি অনেকসদ্গুণসম্পন্ন, জ্ঞানবান, সদয়স্বভাব, যিনি স্নেহবশতঃ ক্ৰোধ সংবরণ করিয়া আছেন, আমার মতে সেই সোমদত্ত পূজনীয়। মহাধনুৰ্দ্ধর মহারথ কৌরবকুলের পূজনীয় সৌমদত্তি আমার ভ্রাতা ও সহায়, অতএব তাহাকে ও তাঁহার অমাত্যদিগকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। তদ্ভিন্ন যেসকল কুরুপ্রধান যুবা, আমাদিগের পুত্র, পৌত্র বা ভ্রাতা, তাহাদিগকে যথাযোগ্য অনাময়জিজ্ঞাসা করিবে।
“বশাতি, শাল্লক, কেকয়, অন্বষ্ঠ, ত্রিগর্ত্ত, প্রাচ্য, উদীচ্য, প্রতীচ্য, দাক্ষিণাত্য ও পার্ব্বতীয় প্রভৃতি যেসকল অনুশংস, শীলবৃত্তসম্পন্ন ভূপতি পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক আনীত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের সকলকে কুশল-জিজ্ঞাসা করিবে। অশ্বারোহী, গজারোহী, রথী, পদাতি, অর্থসম্পন্ন অমাত্য দৌবারিক, সেনানায়ক, আয়ব্যয়দর্শী ও অর্থান্বেষীদিগকে আমার কুশলসংবাদ প্ৰদান করিয়া অনাময়জিজ্ঞাসা করিবে। যিনি কুরুকুলের দেবতাস্বরূপ, প্রজ্ঞাবান ও পরমধাৰ্মিক, যুদ্ধ যাহার নিতান্ত অনভিপ্রেত, সেই বৈশ্যাপুত্রকে অনাময়জিজ্ঞাসা করিবে। যিনি শঠতা ও অক্ষত্ৰীড়ায় অদ্বিতীয় ও সংগ্রামে দুৰ্জয়, যিনি গূঢ় রূপে অমাত্যদিগের পরীক্ষা করেন, সেই চিত্ৰসেনকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে।
“রাজা দুৰ্য্যোধনের সম্মানার্থ মিথ্যাবুদ্ধি, অক্ষদেবী, অদ্বিতীয় শঠ, পার্ব্বতরাজ শকুনিকেও কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। যে বীর একরথে দুৰ্দ্ধৰ্ষ পাণ্ডবগণকে জয় করিতে অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়াছেন, যিনি ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের অদ্বিতীয় মোহয়িতা, সেই কৰ্ণকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। আমাদিগের ভক্ত, গুরু, পিতা, মাতা, সুহৃৎ ও মন্ত্রিস্বরূপ অগাধবুদ্ধি দীর্ঘদর্শী বিদুরকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে।
“আমাদিগের মাতৃস্বরূপ তত্রস্থ গুণবতী বৃদ্ধবনিতাগণের সমীপে গমনপূর্ব্বক আমার প্রণাম জানাইবে এবং তাঁহাদিগের অনৃশংস পুত্র-পৌত্ৰগণ সম্যক জীবিকা লাভ করিতেছেন কি না, জিজ্ঞাসা করিয়া পশ্চাৎ কহিবে, রাজা যুধিষ্ঠির পুত্রসমভিব্যাহারে কুশলে আছেন। তদ্ভিন্ন যাঁহাদিগকে আমাদিগের পালনীয়া বোধ করিবে, সেই সকল অনবদ্য রমণীকে জিজ্ঞাসা করিবে, তাঁহারা সুরক্ষিত সুরভিচর্চিত [গন্ধদ্রব্যাদিদ্বারা সৎকৃত] ও অপ্ৰমত্ত হইয়া অবস্থিতি এবং শ্বশুরগণের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতেছেন কি না। আর তাঁহাদিগের স্বামীরা যেরূপ অনুকুল ব্যবহার করিয়া থাকেন, তাঁহারাও তদ্রূপ অনুকূল ব্যবহার করিতেছেন কি না? যেসকল গুণবতী প্রজাবতী [সন্তানবতী] রমণীসম্পর্কে আমাদিগের স্নুষা ও যাঁহারা সৎকুল হইতে সমাগত হইয়াছেন, তাঁহাদিগকে এবং কন্যাগণকে অনাময়জিজ্ঞাসা করিয়া আলিঙ্গনপূর্ব্বক কহিবে, রাজা যুধিষ্ঠির প্ৰসন্ন হইয়া কহিয়াছেন, তোমাদের কল্যাণ হউক; তোমাদিগের স্বামী অনুকূল হউন, তোমরাও অলঙ্কৃত, বস্ত্রাবতী, গন্ধচর্চিতা, অবীভৎসা, অনুকুলা হইয়া পরমসুখে কালব্যাপন কর। যেসকল বনিতা দৃষ্টিপথে আগমন বা সমক্ষে কথোপকথন করেন না, তাঁহাদিগকেও কুশলজিজ্ঞাসা করিবে।
“দাস ও দাসীগণকে আমাদিগের কুশলসংবাদ প্ৰদানপূর্ব্বক অনাময়জিজ্ঞাসা করিবে। তাঁহাদিগের আশ্রিত, কুব্জ, খঞ্জ, অঙ্গ হীন, অতি দীন, বামন, অন্ধ, স্থবির ও গজাজীব [গজের ব্যবসা দ্বারা জীবিকাকারী গজাজীব, যেমন অজাজীব ইত্যাদি; কিন্তু এখানে গজাদির পরিচালন ও গজের সেবাকারী এই অর্থে প্ৰযুক্ত হইয়াছে।] প্রভৃতিকে আমাদিগের কুশলসংবাদ প্রদান করিয়া অনাময়প্রশ্নপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিবে, দুৰ্য্যোধন তাঁহাদিগকে পুরাতন বৃত্তি প্ৰদান করিয়া থাকেন কি না?” পরে কহিবে যে, তোমরা পূর্ব্বজন্মে অবশ্যই পাপানুষ্ঠান করিয়াছ, তন্নিমিত্ত ক্লেশকর কুৎসিত জীবিকায় কালযাপন করিতেছ; কিন্তু কদাচ ভীত হইও না; আমরা কালক্রমে অরাতিগণকে নিগৃহীত ও সুহৃদগণকে অনুগৃহীত করিয়া অন্নাচ্ছাদন প্রদানপূর্ব্বক তোমাদিগকে প্রতিপালন করিব। হে সঞ্জয়! তুমি দুৰ্য্যোধনকে কহিবে যে, যুধিষ্ঠির যেসকল ব্রাহ্মণকে বার্ষিক বৃত্তি প্ৰদান করিতেন, তুমি তাহা অব্যাহত রাখিয়াছ কি না, এই সংবাদ দূতদ্বারা তাহাকে শ্রবণ করাইবে। যেসকল অনাথ, দুর্ব্বল, মূঢ় ব্যক্তি আত্মপ্রতিপালনের নিমিত্ত সতত ব্যস্ত, তুমি সেই সকলকে কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। যেসকল ব্যক্তি নানাদিগদেশ হইতে আগমন করিয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে, তাঁহাদিগকে সবিশেষ পৰ্য্যবেক্ষণপূর্ব্বক কুশলজিজ্ঞাসা করিবে। এইরূপ চতুর্দ্দিক হইতে সমাগত রাজদূতগণকে কুশলজিজ্ঞাসানন্তর আমাদিগের কুশলসংবাদ প্রদান করিবে।
“দুৰ্য্যোধন যেসকল যোদ্ধাকে হস্তগত করিয়াছে, তাদৃশ যোদ্ধা পৃথিবীতে আর দেখি না, আমাদিগের অন্য উপায় নাই, কেবল এক ধর্ম্মই শত্রুজয় করিবার অবিনশ্বর [অমোঘ] উপায়। সে যাহা হউক, পুনরায় এই কথা দুৰ্য্যোধনের কর্ণগোচর করিবে যে, হে বীর! ‘কুরুরাজ্য শাসন করিব’ বলিয়া যে অভিলাষ তোমার হৃদয় ব্যথিত করিতেছে, সেই তোমার শত্ৰু, আমরা এক্ষণে যেরূপে অবস্থান করিতেছি, ইহা তোমার অত্যন্ত প্রীতিজনক, তাহার সন্দেহ নাই; কিন্তু আমরা যে চিরকাল এই অবস্থায় থাকিব, তাহার কোনো প্রমাণ নাই; অতএব হয় আমাকে ইন্দ্ৰপ্ৰস্থাপুরী প্রদান কর, না হয় যুদ্ধে অগ্রসর হও।”