২য় অধ্যায়
বলদেবকর্ত্তৃক সন্ধির সমর্থন
বলদেব কহিলেন, “আপনারা সকলেই ধর্ম্মার্থসঙ্গত বাসুদেববাক্য শ্রবণ করিলেন; উহা ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যেরূপ শ্রেয়স্কর, রাজা দুৰ্য্যোধনের পক্ষেও সেইরূপ। পাণ্ডবগণ অৰ্দ্ধরাজ্যমাত্র গ্রহণ করিয়া ক্ষান্ত হইতে সম্মত আছেন; অতএব মহারাজ দুৰ্য্যোধন তাঁহাদিগকে রাজ্যার্দ্ধ প্ৰদানপূর্ব্বক আমাদিগের সহিত পরম সুখী হইয়া স্বচ্ছন্দে কালব্যাপন করুন। শত্ৰুগণ যথানিয়মে কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিলে পাণ্ডবেরা অৰ্দ্ধরাজ্যলাভেও প্রশান্তভাব অবলম্বন করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিবেন, তাহা হইলে প্ৰজাগণের আর কোনপ্রকার অনিষ্টঘটনার সম্ভাবনা থাকিবে না। এক্ষণে আমার মতে একজন উপযুক্ত ব্যক্তি উভয়কুলের শান্তিসাধনাৰ্থ দুৰ্য্যোধনসমীপে গমনপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া, তদ্বিষয়ে তাঁহার কি মত, ইহা অবগত হউন। অনন্তর তিনি মহানুভব ধৃতরাষ্ট্র, কুরুকুলাগ্রগণ্য শান্তনুতনয় ভীষ্ম, মহামতি দ্রোণ, অশ্বত্থামা, বিদুর, কৃপ, শকুনি, কৰ্ণ, সমুদয় ধৃতরাষ্ট্রতনয় ও বহুদর্শী ধাৰ্মিক পুরবাসী বৃদ্ধসমুদয়কে আমন্ত্রণপূর্ব্বক সমবেত করিয়া সবিনয়ে যুধিষ্ঠিরের অর্থকর [হিতকর] বাক্য প্রয়োগ করুন। কৌরবগণ বলপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের ধনসম্পত্তি অপহরণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু সকল অবস্থায় তাঁহাদিগকে কুপিত করা কর্ত্তব্য নহে।
“ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সমধিক সম্পত্তিশালী ছিলেন; কিন্তু দ্যূতে প্ৰমত্ত হইয়াই আপনার সমস্ত রাজ্য পরহস্তগত করিয়াছেন। ইনি অক্ষক্রীড়ায় সুনিপুণ নহেন, সমুদয় সুহৃদগণ তদ্বিষয়ে ইঁহাকে নিষেধও করিয়াছিলেন, তথাপি ইনি দ্যূতক্ৰীড়ায় প্রবৃত্ত হইলেন। দুৰ্য্যোধনের সভামধ্যে এরূপ সহস্ৰ সহস্র অক্ষবেদী [পাশকক্ৰীড়াভিজ্ঞ—পাশাখেলায় পটু] ছিল, যাহাদিগকে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অনায়াসে পরাজয় করিতে পারিতেন, কিন্তু দৈবের কি দুর্ব্বিপাক! ইনি তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া অক্ষপারদর্শী গান্ধাররাজ শকুনিকে দ্যূতে আহ্বান করিলেন। সে তৎক্ষণাৎ ইঁহার সহিত ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হইল এবং ক্ৰমে ক্ৰমে ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া পরাজয়পূর্ব্বক ইঁহার সমুদয় সম্পত্তি অপহরণ করিল, ইহাতে শকুনির কিছুমাত্র অপরাধ নাই। অতএব একজন বাগ্মী পুরুষ ধূতরাষ্ট্রসমীপে সমুপস্থিত হইয়া প্রণিপাতপূর্ব্বক সন্ধিবিষয়ে প্রস্তাব করুন, তাহা হইলে তিনি অবশ্যই সন্ধিবিধানপক্ষে সম্মত হইবেন। কৌরবগণের সহিত সংগ্রাম না করিয়া সন্ধি করাই কর্ত্তব্য; সন্ধিদ্বারা সম্পাদিত অর্থই অর্থকর হইয়া থাকে, কিন্তু যে অর্থ সংগ্ৰাম্যদ্বারা উপার্জিত, তাহা অর্থই নহে।”
সাত্যকির সন্ধিতে অশ্রদ্ধা-সদ্য যুদ্ধানুমোদন
বলভদ্র এই কথা বলিবামাত্ৰ মহাবীর সাত্যকি যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া সহসা গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক বলদেবের বাক্যে দোষারোপ করিয়া কহিতে লাগিলেন, “যাহার যেরূপ প্রকৃতি, সে সেইরূপই কহিয়া থাকে; অতএব তোমার যেরূপ প্রকৃতি, তুমি তদ্রূপই কহিতেছ। দেখ, এই ভূমণ্ডলে শূর ও কাপুরুষ, এই উভয়বিধ লোক দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। যেমন এক বৃক্ষে ফলবান ও ফলহীন শাখা সঞ্জাত হয়, তদ্রূপ এক বংশে ক্লীব ও শূর, এই দুইপ্ৰকার পুরুষ জন্মগ্রহণ করে। হে হলধর! আমি তোমার বাক্যে অসূয়া প্রকাশ করিতেছি না, কিন্তু যাঁহারা স্থিরচিত্তে তোমার এই বাক্য শ্রবণ করিতেছেন, তাঁহাদেরই উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছি। কোন ব্যক্তি অকুতোভয়ে সভামধ্যে নির্দোষ ধৰ্মরাজের প্রতি অণুমাত্র দোষারোপ করিয়াও কি পুনরায় কথা কহিতে সমর্থ হয়? যখন অক্ষবিশারদগণ [পাশকক্ৰীড়াপটু] এই দূতানভিজ্ঞ [পাশাখেলায় অপটু] মহাত্মাকে দ্যূতে আহ্বান করিয়া পরাজয় করিয়াছে, তখন তাঁহাদিগের জয় কিরূপে ধর্ম্মানুগত হইল? যদি মহাত্মা যুধিষ্ঠির আপনি গৃহে ভ্ৰাতৃগণসমভিব্যাহারে ক্রীড়া করিতেন, আর দুৰ্য্যোধনাদি তথায় সমাগত হইয়া ইঁহাকে পরাজয় করিত, তাহা হইলে, ইনি ধর্ম্মতঃ পরাজিত হইতেন। ঐ দূরাত্মাগণ তাহা না করিয়া প্রত্যুত যখন ইঁহাকে আহ্বানপূর্ব্বক কপটদ্যূতে পরাজয় করিয়াছে, তখন তাহাদের মঙ্গল কোথায়? এক্ষণে মহারাজ যুধিষ্ঠির স্বীয় প্রতিজ্ঞাশাপ হইতে মুক্ত হইয়াছেন, ইনি কি নিমিত্ত সেই দুরাত্মাদের নিকট অবনত হইবেন? ইনি বনবাস হইতে মুক্ত হইবামাত্র স্বীয় পৈতামহ [পৈতৃক] পদের অধিকারী হইয়াছেন, কি নিমিত্ত স্বীয় পৈতৃকরাজ্য অধিকারার্থ প্রার্থনা করিবেন? যদি পরের ঐশ্বৰ্য্যগ্রহণেও ইঁহার অভিলাষ জন্মে, তাহাও যাচ্ঞা করিয়া গ্ৰহণ করা উচিত নহে, বলপূর্ব্বক গ্ৰহণ করাই কর্ত্তব্য। আর পাণ্ডবগণ বনবাস ও অজ্ঞাতবাসরূপ প্ৰতিজ্ঞা সম্যক প্রতিপালন করিয়াছেন, তথাপি পাপাত্মা কৌরবগণ সর্ব্বদা কহিয়া থাকে, পাণ্ডুনন্দন ত্ৰয়োদশ বৎসরের মধ্যে পরিজ্ঞাত হইয়াছে। অতএব কিরূপে দুরাত্মাদিগের রাজ্যপহরণবাসনা নাই বলা যাইবে এবং কি প্রকারেই বা উহাদিগকে ধার্মিক বলিয়া বোধ করিব?
“ঐ দুরাত্মারা মহামতি ভীষ্ম ও দ্রোণকর্ত্তৃক অনুনীত হইয়াও পাণ্ডবগণকে তাঁহাদের পৈতৃকরাজ্যদানে সম্মত হইতেছে না। আমি স্বীয় নিশিত শরনিকরে সেই দুরাত্মাদিগকে বশীভূত করিয়া ধর্মীরাজের চরণে পাতিত করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। যদি তাহারা ইহাতে সম্মত না হয়, তবে অবশ্যই তাহাদিগকে অমাত্যগণসমভিব্যাহারে শমনসদনে গমন করিতে হইবে। যেমন মহীধরগণ বজ্রের বেগ সহ্য করিতে পারে না, তদুপ সমরাঙ্গণচারী ক্ৰোধোদ্ধত যুযুধানের প্রতাপ সহ্য করিতে কাহারও শক্তি নাই। কোন ব্যক্তি মহাবীর অর্জ্জুন, গদাপাণি ভীমসেন ও আমাকে সমরে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে? কোন যোদ্ধা স্বীয় জীবনের প্রত্যাশা পরিত্যাগ করিয়া অন্তকোপম নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, পাণ্ডবসম বলবীৰ্য্যশালী পঞ্চ দ্রৌপদীপুত্র, সুভদ্রতনয় অভিমনু, গদ, প্ৰদ্যুম্ন, অনলসঙ্কাশ শাম্বের সম্মুখীন হইতে পারে? অতএব আমরা অনায়াসেই শকুনি, কর্ণ ও দুৰ্য্যোধনকে সংহার করিয়া পুনরায় ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিব। আততায়ী শত্ৰুগণকে বিনাশ করিলে অধর্মের লেশ নাই, প্রত্যুত তাহাদের নিকট যাচ্ঞাই অধর্ম্ম ও অযশস্কর। এক্ষণে তোমরা সতর্ক হইয়া মহারাজ যুধিষ্ঠিরের চিরপ্ররূঢ় [চিরপোষিত] মনোরথ পরিপূর্ণ করা। ইনি ধৃতরাষ্ট্রবিসূষ্টি রাজ্য গ্ৰহণ করুন। হয় আজি কৌরবগণ সম্মানপূর্ব্বক রাজা যুধিষ্ঠিরকে র্ত্তাহার পৈতৃকরাজ্য প্রদান করুক, নতুবা তাহারা আমাদিগের শরজালে সমূলে নির্ম্মূল হইয়া ধরাতলশায়ী হউক।”