৫২. হস্তিনাপ্ৰস্থিত কৃষ্ণার্জ্জুনের প্রিয়ালাপ

৫২ম অধ্যায়

হস্তিনাপ্ৰস্থিত কৃষ্ণার্জ্জুনের প্রিয়ালাপ

বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহামতি ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে ভগবান্ বাসুদেব দারুককে রথ সুসজ্জিত করিতে আদেশ করিলেন। দারুকও অচিরাৎ রথ সংযোজিত করিয়া তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন হস্তিনাগমনের নিমিত্ত অনুযাত্রীদিগকে [অনুগামী—অনুযায়ী লোকজন] সুসজ্জিত হইতে আদেশ করিলে তাঁহারা অবিলম্বে সুসজ্জিত হইয়া তাঁহার নিকট আগমনপূৰ্ব্বক নিবেদন করিল, “মহাশয়! আমরা সকলেই হস্তিনাগমনের নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়াছি।”

তখন কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন উভয়ে রথারোহণ করিয়া মহা আহ্লাদে বিবিধবিষয়ক কথোপকথন করিতে করিতে গমন করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া অৰ্জ্জুন বাসুদেবকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহাত্ম! রাজা যুধিষ্ঠির, তোমারই প্রসাদবলে জয়লাভ করিয়াছেন। তোমারই অনুগ্রহে আমাদের শত্রুসমুদয় নিহত ও রাজ্য নিষ্কন্টক হইয়াছে। তুমিই আমাদের পরম সহায়। আমরা নৌকাস্বরূপ তোমাকেই অবলম্বন করিয়া এই দুস্তর কৌরব-সমুদ্র সমুত্তীর্ণ হইয়াছি। হে বিশ্বকৰ্ম্মন্! হে বিশ্বময়! তুমি আমাকে যেরূপ অবগত আছ, আমিও তোমাকে তদ্রূপ অবগত আছি। তোমার তেজঃপ্রভাবেই সমুদয় জীব সমুৎপন্ন হইয়াছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় তোমারই ক্রীড়া এবং স্বর্গ-মর্ত্ত তোমারই মায়ামাত্র। এই চরাচর বিশ্বসংসার তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। জরায়ুজাদি চারি প্রকার জীব তোমা হইতেই সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। তুমি স্বর্গ, মর্ত্ত ও অন্তরীক্ষের সৃষ্টিকৰ্ত্তা। তোমার হাস্যই নিৰ্ম্মল জ্যোৎস্না, তোমার ইন্দ্রিয়গ্রামই সমুদয় ঋতু, তোমার প্রাণই সমীরণ, তোমার ক্রোধই মৃত্যু এবং তোমার প্রসন্নতাই লক্ষ্মীস্বরূপ৷ রতি, সন্তোষ, ধৈৰ্য্য, ক্ষমা, বুদ্ধি, কান্তি ও চরাচর বিশ্ব তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। কল্পান্তকালে তুমিই নিধন [তিরোভূত—অন্তর্হিত] বলিয়া অভিহিত হইয়া থাক। অতি সুদীর্ঘকালেও তোমার গুণের ইয়ত্তা করা আমার সাধ্যায়ত্ত নহে। তুমি আত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ; তোমাকে নমস্কার। আমি দেবর্ষি নারদ, অসিত দেবল, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ও কুরুপিতামহ ভীষ্মের নিকট তোমার মাহাত্ম্য সবিশেষ অবগত হইয়াছি। তুমিই অদ্বিতীয় ঈশ্বর। তুমি ইতিপূর্ব্বে আমাকে অনুগ্রহপূর্ব্বক যেসমুদয় উপদেশ প্রদান। করিয়াছ, আমি তৎসমুদয়ই প্রতিপালন করিব।

“তুমি আমাদিগের প্রিয়চিকীর্ষু হওয়াতেই দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন নিহত হইয়াছে। তুমি কৌরবসৈন্যগণকে ক্রোধানলে দগ্ধ করাতেই আমি তাহাদিগকে সংহার করিতে সমর্থ হইয়াছি। তোমার কৰ্ম্ম, তোমার বুদ্ধি ও তোমার পরাক্রমপ্রভাবেই আমার সংগ্রামে জয়লাভ হইয়াছে। তুমি দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন, মহাবীর কর্ণ, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ ও ভূরিশ্রবার বধোপায় নির্দ্দেশ করিয়াছ। এক্ষণে তুমি দ্বারকাগমনের নিমিত্ত যে অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে, উহা আমার অভিমত। আমি ধৰ্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিয়া যাহাতে তোমার দ্বারকায় গমন করা হয়, তাহার চেষ্টা করিব। তুমি অচিরাৎ আমার মাতুল বসুদেব এবং বলদেব প্রভৃতি বৃষ্ণিবংশীয়দিগের সহিত সাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ হইবে।”

কৃষ্ণার্জ্জুনের যুধিষ্ঠিরাদির সাক্ষাৎকার

মহাত্মা অর্জ্জুন কৃষ্ণের সহিত এইরূপ কথোপকথন করিতে করিতে হৃষ্টজনসমাকীর্ণ হস্তিনায় গমন করিয়া প্রথমে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের ইন্দ্রালয়তুল্য রম্য ভবনে প্রবেশপূর্ব্বক মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, মহাত্মা বিদুর, অপরাজিত যুযুৎসু, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন, মাদ্রীপুত্ৰ নকুল ও সহদেব এবং পরিচারিকাগণপরিবৃতা পতিপরায়ণা গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী ও সুভদ্রা প্রভৃতি কৌরবকামিনীগণকে অবলোকন করিলেন। অনন্তর সেই মহাপুরুষদ্বয় অন্ধরাজের নিকট গমনপূর্ব্বক আপনাদিগের পরিচয় প্রদান করিয়া তাঁহাকে এবং গান্ধারী, কুন্তী, যুধিষ্ঠির ও ভীমসেনকে অভিবাদন ও বিদুরকে আলিঙ্গনপুরঃসর কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিলেন। ক্রমে রজনী সমুপস্থিত হইল। তখন অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র সমাগত সমুদয় ব্যক্তিকে স্ব স্ব ভবনে গমন করিতে অনুজ্ঞা করিয়া বিদায় করিলেন।

অনন্তর সকলে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলে, মহাত্মা বাসুদেব অৰ্জ্জুনের গৃহে গমন করিয়া পরমসমাদরে পান-ভোজন সমাপনপূৰ্ব্বক তাঁহার সহিত একশয্যায় শয়ন করিয়া রহিলেন। ক্রমে শর্ব্বরী প্রভাত হইল। তখন অৰ্জ্জুন ও বাসুদেব উভয়ে গাত্রোত্থান করিয়া প্রাতঃকৃত্যসমুদয় সমাপনপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের গৃহে গমন করিলেন। ঐ স্থানে ধর্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মনন্দন দেবগণপরিবেষ্টিত দেবরাজের ন্যায় অমাত্যগণপরিবেষ্টিত হইয়া অবস্থান করিতেছিলেন। তিনি তাঁহাদিগকে সমাগত দেখিয়া প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে যথাস্থানে উপবেশন করাইয়া কহিলেন, “হে মহাবীরদ্বয়! আমার বোধ হইতেছে, তোমরা কোন বিশেষ কার্য্যের অনুরোধে আমার নিকট আগমন করিয়াছ। অতএব এক্ষণে অচিরাৎ আপনাদিগের অভিপ্রেত বিষয় ব্যক্ত কর। তোমরা আমাকে যে বিষয়ে অনুরোধ করিবে, আমি অবিচারিত চিত্তে তাহা সম্পাদন করিব।”

ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে, বাক্যবিশারদ মহাত্মা অর্জ্জুন বিনীতবাক্যে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! বহুদিন হইল, আমাদিগের পরমসুহৃদ বাসুদেব দ্বারকা হইতে আগমন করিয়াছেন। এক্ষণে ইঁহার পিতার সহিত সাক্ষাৎকার করিতে নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, অতএব যদি আপনার অনুমতি হয়, তাহা হইলে ইনি স্বীয় আবাসে গমন করেন।”

যুধিষ্ঠিরানুমোদনে কৃষ্ণের দ্বারকাযাত্রা

মহাত্মা অৰ্জ্জুন এইরূপ অনুরোধ করিলে, ধৰ্ম্মনন্দন কৃষ্ণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বাসুদেব! এক্ষণে তুমি পিতৃদর্শনার্থ নিৰ্ব্বিঘ্নে দ্বারকায় গমন কর। মাতুল বসুদেব, মাতুলানী দেবকী ও মহাবীর বলদেবের সহিত আমার বহুদিন সাক্ষাৎকার হয় নাই। তুমি দ্বারকায় গমন করিয়া তাঁহাদিগকে অভিবাদনপূর্ব্বক তাঁহাদিগের নিকট আমার, ভীমসেনের, অর্জ্জুনের ও মাদ্ৰীতনয়দ্বয়ের প্রণাম জানাইবে। আমাকে এবং আমার ভ্রাতৃগণকে যেন একেবারে বিস্মৃত হইও না। তোমার গমনবিষয়ে আমার কিছুমাত্র অমত নাই। কিন্তু যখন আমি অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিব, তখন অবশ্যই তোমাকে এই স্থানে আগমন করিতে হইবে। এক্ষণে তুমি বিবিধ রত্ন এবং স্বীয় মনোনীত বস্তুসমুদয় গ্রহণ করিয়া দ্বারকাভিমুখে যাত্রা কর। আমরা তোমার প্রভাবেই শত্ৰুনিপাত ও পৃথিবী লাভ করিয়াছি।”

ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে মহাত্মা বাসুদেব তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আজ আমি আপনাকে পৃথিবীর অধীশ্বর দেখিয়া যারপরনাই পরিতুষ্ট হইলাম। আপনি আমার গৃহস্থিত রত্নসমুদয়কে আপনার বলিয়া জ্ঞান করিবেন।” মহাত্মা বাসুদেব এইরূপ অনুনয় করিলে, ধৰ্ম্মরাজ তাঁহাকে যথোচিত সৎকারপূর্ব্বক বিদায় করিলেন। তখন মহাত্মা মধুসূদন পিতৃষ্বসা কুন্তী ও বিদুর প্রভৃতি মহাত্মাদিগের অনুজ্ঞা গ্রহণ করিয়া কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞানুসারে ভগিনী সুভদ্রাকে সমভিব্যাহারে লইয়া রথারোহণপূৰ্ব্বক হস্তিনা হইতে বিনির্গত হইলেন। তখন মহাত্মা অর্জ্জুন, সাত্যকি, ভীমসেন, বিদুর, নকুল, সহদেব ও অন্যান্য পুরবাসিগণ তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা কিয়দ্দূর গমন করিলে, মহাত্মা বাসুদেব তাঁহাদিগকে মধুরবাক্যে সম্ভাষণপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইতে আদেশ করিয়া দারুক ও সাত্যকিকে বেগে রথচালন করিতে অনুজ্ঞা করিলেন।