৭৭তম অধ্যায়
ভীমের সারথিসতর্কীরণ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর ভীমসেন সেই তুমুল সংগ্রামস্থলে অসংখ্য অরাতিসৈন্যে সমাবৃত হইয়া সারথিকে কহিলেন, ‘হে সারথে! তুমি বেগে ধৃতরাষ্ট্রসৈন্যমধ্যে রথ সঞ্চালন কর; আমি অবিলম্বে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিব। মহাবীর ভীমসেন এইরূপ কহিলে তাহার সারথি বিশোক দ্রুতবেগে রথসঞ্চালনপূর্ব্বক বৃকোদর যে স্থানে গমন করিতে বাসনা করিয়াছিলেন, অবিলম্বে তাঁহাকে সেই স্থলে উপনীত করিল। তখন অন্যান্য কৌরবগণ চতুর্দ্দিক হইতে হস্তী, অশ্ব ও পদাতিসমভিব্যাহারে বৃকোদরের অভিমুখীন হইয়া তাঁহার বেগগামী রথের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিল। মহাত্মা ভীমসেনও সুবর্ণময় শরনিকরে সেই সমাগত শয়সমুদয় দুই তিনখণ্ডে ছিন্ন করিয়া ভূতলে নিপাতিত করিলেন। ঐ সময় হস্তী, অশ্ব, রথী ও পদাতিসমুদয় ভীমশরে সমাহত হইয়া বজ্রাহত পর্ব্বতের ন্যায় ভীষণ শব্দ করিতে লাগিল। ভূপালগণ ভীমসেনের ভীষণ শরে নির্ভিন্নকলেবর হইয়া, নবজাতপক্ষ বিহঙ্গগণ যেমন বৃক্ষাভিমুখে গমন করে, তদ্রূপ চতুর্দ্দি হইতে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন বীরাগ্রগণ্য বৃকোদর কল্পনাকালীন ভূতসংহারে প্রবৃত্ত দণ্ডধারী অন্তুকের ন্যায় মুখব্যাদানপূর্ব্বক মহাবেগে তাহাদের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। কৌরবসৈন্যগণ ভীমসেনের ভীষণ বেগ সহ্য করিতে অসমর্থ ও তাঁহার শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ভীতচিত্তে অনিহত মেঘমণ্ডলের ন্যায় চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল।
“তখন প্রবলপ্রতাপশালী ধীমান্ ভীমসেন পুনরায় সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া সারথিকে কহিলেন, ‘হে বিশোক! আমি এক্ষণে যুদ্ধে একান্ত আসক্ত হইয়াছি। সমাগত রথসমূহ স্বকীয় বা পরকীয় বুঝিতে পারিতেছি না। অতএব তুমি উহা বিশেষরূপে অবগত হও। আমি যেন সমবোদ্যত হইয়া শরনিকরে স্বীয় সৈন্যগণকে সমাচ্ছন্ন না করি। চতুর্দ্দিকে অসংখ্য শত্রু, রথ ও ধ্বজাগ্ৰসকল দৃষ্টিগোচর হইতেছে, বিশেষতঃ মহারাজ যুধিষ্ঠির অদ্য অতিশয় নিপীড়িত হইয়াছেন এবং অর্জ্জুনও এ কাল পর্যন্ত প্রত্যাগত হয় নাই, এই সমুদয় কারণবশতঃ আমার অধিকতর কষ্ট হইতেছে। হে বিশোক! আজ ধর্ম্মরাজ আমার নিকট হইতে শত্ৰুমণ্ডলীমধ্যে গমন করিয়াছেন; ধর্ম্মাত্মা ধনঞ্জয়কেও অবলোকন করিতেছেন। এক্ষণে উহারা দুইজন জীবিত আছেন কি না, জানিতে না পারিয়া। আমার অতিশয় দুঃখ হইতেছে। যাহা হউক, আজ আমি এই সমরাঙ্গনে সমবেত শত্রুসৈন্যদিগকে বিনাশ করিয়া তোমার সহিত আনন্দানুভব করিব। এক্ষণে তুমি আমার রথস্থিত তূণীরে কোন্ কোন বাণ কি পরিমাণে অবশিষ্ট আছে, তাহা বিশেষরূপে পৰ্যবেক্ষণ করিয়া আমাকে জ্ঞাপিত কর।
“বিশোক কহিলেন, ‘হে বৃকোদর! এক্ষণে আপনার তূণীরে অযুতসংখ্যক শর, অযুতসংখ্যক ক্ষুর, অযুতসংখ্যক ভল্ল, দুইসহস্র নারাচ, তিনসহস্র প্রদর এবং অসংখ্য গদা, অসি, প্রাস, মুদগর, শক্তি ও তোমর বিদ্যমান আছে। যেসকল অস্ত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে, তৎসমুদয় শকটে নিহিত করিলে ছয় বলীবর্দ্দও উহা বহন করিতে পারিবে না। অতএব আপনি স্বীয় বাহুবল প্ৰকাশপূর্ব্বক নিঃশঙ্কচিত্তে অসংখ্য অস্ত্র পরিত্যাগ করুন। অস্ত্র নিঃশেষিত হইবার কিছুমাত্র আশঙ্কা করিবেন না।
“ভীমসেন কহিলেন, ‘হে বিশোক! আজ দেখ, আমার নৃপদেহবিদারণ [ক্ষত্রিয় বীরগণের দেহবিদারণক্ষম] বেগবান্ বাণপ্রভাবে সূর্য্য তিরোহিত হইলে সমরভূমি মৃত্যুলোকসদৃশ দুর্দ্দর্শ হইয়া উঠিবে। আজ ভূপালগণ হয়, ভীমসেনকে সমরে নিহত, না হয় একমাত্র তাহার প্রভাবে কৌরবগণকে পরাজিত জানিতে পারিবেন। আজ আমি সমস্ত কৌরবগণকে নিপাতিত করিলে লোকে আমার শৈশবাবধি সঞ্চিত গুণ কীৰ্ত্তন করিবে। আজ হয় আমি কৌরবগণকে নিহত করিব, নচেৎ তাহারাই আমাকে নিপাতিত করিবে। এক্ষণে মঙ্গলাভিলাষী দেবগণ আমার বিঘ্ন বিনাশ করুন। শত্রুঘাতন ধনঞ্জয় যজ্ঞস্থলে আহত পুরন্দরের ন্যায় অবিলম্বে এই সমরাঙ্গনে সমুপস্থিত হউক।
যুদ্ধে অর্জ্জুনমিলনাশায় ভীমের আনন্দ
‘হে সারথে! ঐ দেখ, ভারতীসেনা ছিন্নভিন্ন হইয়াছে এবং নরপালগণ পলায়ন করিতেছেন, ইহার কারণ কি? আমার বোধ হয়, নরোত্তম ধীমান্ অর্জ্জুন শরনিকরে কৌরবসৈন্যগণকে সমাচ্ছন্ন করিতেছেন। ঐ দেখ, প্রভূত ধ্বজসম্পন্ন চতুরঙ্গ বল অসংখ্য শর ও শক্তির আঘাতে নিপীড়িত হইয়া পলায়ন করিতেছে। অনেক সৈন্য ধনঞ্জয়ের অশনিতুল্য সুবর্ণপুঙ্খ সায়কে সমাহত হইয়া নিরন্তর বিঘূর্ণিত হইতেছে। হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয় পদাতিগণকে বিমর্পিত করিয়া ধাবমান হইয়াছে। কৌরবগণ দাবাগ্নিদহনভীত মাতঙ্গগণের ন্যায় বিমুগ্ধ হইয়া পলায়ন এবং অন্যান্য ভূপতিগণ হাহাকার করিতেছে।
“বিশোক কহিলেন, ‘হে মহাত্মন্! মহাবীর অর্জ্জুনের ঘোরতর গাণ্ডীবনিঃস্বন কি আপনার শ্রবণগোচর হয় নাই মহাবলপরাক্রান্ত অমর্ষপরায়ণ ধনঞ্জয়ের ধনুষ্টঙ্কারে কি আপনার শ্রবণেন্দ্রিয় বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে? হে পাণ্ডব! আজ আপনার সমুদয় মনোরথ সফল হইল। ঐ দেখুন, গজসৈন্যমধ্যে ধনঞ্জয়ের ধ্বজাগ্রস্থিত বানররাজ শত্রুসৈন্যগণকে বিভ্রাসিত করিতেছে। উহাকে দেখিয়া আমিও ভীত হইয়াছি। ঐ দেখুন, মহাবীর অর্জ্জুনের শাসনজ্যা নীলনীরদবিরাজিত চপলার [১] ন্যায় বিস্ফারিত হইতেছে। উহার বিচিত্র কিরীট ও কিরীটমধ্যস্থিত দিবাকরসদৃশ দিব্য-মণি অতিমাত্র শোভা ধারণ করিয়াছে এবং উহার পার্শ্বে পাণ্ডুর [২] মেঘবর্ণ ভীষণনিঃস্বনসম্পন্ন দেবদত্তশঙ্খ বিদ্যমান রহিয়াছে। ঐ দেখুন, রথরশ্মিধারী রথচারী জনার্দ্দনের পার্শ্বে মার্ত্তণ্ডপ্রভ যশোবর্দ্ধন ক্ষুরধার চক্র, শশধরের ন্যায় শুভ্র পাঞ্চজন্যশঙ্খ এবং বক্ষঃস্থলে জাজ্বল্যমান কৌস্তুভমণি ও বিজয়প্রদ মাল্য শোভা পাইতেছে। যদুবংশীয়েরা সর্ব্বদা ঐ চক্রের অর্চনা করিয়া থাকেন।
‘ঐ দেখুন, মহাবীর অর্জ্জুন ক্ষুরাস্ত্রে করিগণের সরল বৃক্ষসদৃশ করসমুদয় ছেদনপূর্ব্বক উহাদিগকে আরোহিগণের সহিত সংহার করাতে উহারা বজ্রবিদারিত পর্ব্বতের ন্যায় নিপতিত হইতেছে। এক্ষণে মহারথাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় বাসুদেবসঞ্চালিত শ্বেতাশ্বযুক্ত রথে আরোহণপূর্ব্বক শত্রুসৈন্যগণকে বিদ্রাবিত করিয়া সমরাঙ্গনে আগমন করিতেছেন, সন্দেহ নাই। ঐ দেখুন, অসংখ রথ, হস্তী ও পদাতি পুরন্দরসদৃশ প্রভাবসম্পন্ন ধনঞ্জয়ের শরনিকরে বিদ্রাবিত হইয়া গরুড়ের পক্ষবায়ুবিপাটিত [পাখার বাতাসে উন্মূলিত] মহাবনের ন্যায় নিপতিত হইতেছে। এক্ষণে অশ্ব ও সারথিসমবেত চারিশত রথ, সাতশত হস্তী এবং অসংখ্য সাদী ও পদাতি নিহত হইয়াছে। ঐ দেখুন, মহাবীর ধনঞ্জয় কৌরবগণকে সংহার করিয়া আপনার সমীপে আগমন করিতেছেন। হে ভীমসেন! এক্ষণে আপনার শত্ৰুসকল বিনষ্ট ও মনোরথ পরিপূর্ণ হইল। আপনার আয়ু ও বলবৃদ্ধি হউক।’ তখন ভীমসেন সারথির বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে বিশোক! তুমি আমাকে অর্জ্জুনের আগমনবার্ত্তা বিজ্ঞাপিত করাতে আমি তোমার প্রতি নিতান্ত প্রসন্ন হইয়াছি; এই প্রিয়সংবাদপ্রদাননিবন্ধন তোমাকে চতুর্দ্দশ গ্রাম, একশত দাসী এবং বিংশতি রথ প্রদান করিব।’ ”