৭২তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরনিকটে অর্জ্জুনের অপরাধক্ষমাপণ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ধর্ম্মপরায়ণ বাসুদেব ধর্ম্মরাজের প্রতিযুক্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে প্রসন্ন করিতে ধনঞ্জয়কে অনুরোধ করিলেন এবং মহাত্মা অর্জ্জুনকে জ্যেষ্ঠভ্রাতার প্রতি পরুষবাক্য প্রয়োগনিবন্ধন নিতান্ত বিষণ্ন দেখিয়া কহিলেন, ‘হে পার্থ! যদি তুমি তীক্ষ্ণধার খড়্গদ্বারা ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে বিনাশ করিতে, তাহা হইলে তোমার কি অবস্থা হইত? তুমি রাজাকে দুর্ব্বাক্য বলিয়া এইরূপ দুর্ম্মনায়মান হইয়াছ, আর তাহাকে বিনাশ করিলে না জানি কি করিতে। যথার্থ ধর্ম্ম স্বভাবতঃই নিতান্ত দুর্ব্বোধ্য। বিশেষতঃ অজ্ঞানেরা উহা কখনই সহজে বুঝিতে পারে না। তুমি ধর্ম্মভয়ে জ্যেষ্ঠভ্রাতার প্রাণসংহার করিলে নিশ্চয়ই ঘোর নরকে নিপতিত হইতে। যাহা হউক, এক্ষণে আমার বাক্যানুসারে পরমধার্ম্মিক ধর্ম্মরাজকে প্রসন্ন কর। যুধিষ্ঠির প্রীত হইলে আমরা উভয়ে সত্বর কর্ণের অভিমুখে ধাবমান হইব। আজ তুমি নিশ্চয়ই শরনিকরে কর্ণকে নিপাতিত করিয়া ধর্ম্মরাজের বিপুল প্রীতি সম্পাদন করিবে। এক্ষণে জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে প্রসন্ন করিয়া সংগ্রামক্ষেত্রে গমন করিবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে। অতএব উহা করিলেই তোমার কাৰ্যসিদ্ধি হইবে।
“হে মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া লজ্জিতভাবে ধর্ম্মরাজের চরণে নিপতিত হইয়া বারংবার কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আমি ধর্ম্মরক্ষাৰ্থ আপনাকে যে সমস্ত দুর্ব্বাক্য কহিয়াছি, আপনি প্রসন্ন হইয়া তৎসমুদয় ক্ষমা করুন। তখন ধর্ম্মরাজ ধনঞ্জয়কে পদতলে নিপতিত ও রোরুদ্যমান অবলোকন করিয়া তাহাকে উত্থাপনপূর্ব্বক আলিঙ্গন করিয়া সমেহনয়নে রোদন করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই ভ্রাতৃদ্বয় বহুক্ষণ রোদন করিয়া পরিশেষে পরম প্রীতিযুক্ত হইলেন। অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির প্রীতমনে অর্জ্জুনের মস্তকাঘ্রাণ ও তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! কর্ণ সংগ্ৰামনিপুণ সমুদয় সৈন্যের সমক্ষে শরজালদ্বারা আমার কবচ, ধ্বজ, শরাসন, শক্তি, অশ্ব ও শরনিকর ছেদন করিয়াছে। আমি তাহার প্রভাব জানিয়া ও কার্য্য দেখিয়া বিষাদে নিতান্ত অবসন্ন হইতেছি। আমার জীবনে আর আস্থা নাই। যদি তুমি অদ্য তাহাকে নিপাতিত করিতে না পার, তবে নিশ্চয়ই প্রাণ পরিত্যাগ করিব।
“মহাত্মা ধনঞ্জয় ধর্ম্মরাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আমি সত্য, মহাশয়ের স্বাস্থ্য, ভীমসেন, নকুল ও সহদেবের শপথ করিয়া কহিতেছি যে, অদ্য হয় সমরে কর্ণকে নিপাতিত করিব, নচেৎ স্বয়ং তাহার হস্তে নিহত হইয়া মহীতলে নিপতিত হইব। এক্ষণে এই প্রতিজ্ঞা করিয়া অস্ত্র গ্রহণ করিলাম।
‘মহাবীর ধনঞ্জয় যুধিষ্ঠিরকে এইরূপ কহিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! অদ্য তোমার বুদ্ধিবলে নিশ্চয়ই সূতপুত্রকে সংহার করিব।’ বাসুদেব অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে পার্থ! তুমি মহাবল কর্ণকে বিনাশ করিবার উপযুক্ত পাত্র। ভুমি পরাক্রান্ত সূতপুত্রকে নিহত করিবে, ইহা আমি সতত অভিলাষ করিয়া থাকি।’ অনন্তর মহামতি বাসুদেব পুনরায় ধর্ম্মনন্দনকে কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আপনি অর্জ্জুনকে সান্ত্বনা করিয়া দুরাত্মা কর্ণের বিনাশে অনুজ্ঞা করুন। আমরা আপনাকে কর্ণশরপীড়িত শ্রবণ করিয়া আপনার বৃত্তান্ত অবগত হইবার নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছি। ভাগ্যক্রমে আজ আপনি নিহত বা ধৃত হন নাই। এক্ষণে অর্জ্জুনকে সান্ত্বনা করিয়া বিজয়লাভার্থে আশীৰ্ব্বাদ করুন।’
অর্জ্জুনের কর্ণবিজয়ে যুধিষ্ঠিরের আদেশ
“তখন যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! তুমি আমাকে অবশ্যকর্ত্তব্য হিতকর কথা কহিয়াছ, অতএব উহা পুরুষ হইলেও আমি ক্ষমা করিলাম। এক্ষণে অনুজ্ঞা করিতেছি, তুমি কর্ণকে জয় কর। আমি তোমার প্রতি দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ করিয়াছি বলিয়া ক্রুদ্ধ হইও না।’ হে মহারাজ! মহাত্মা ধনঞ্জয় জ্যেষ্ঠভ্রাতার বাক্যশ্রবণানন্তর প্রণত হইয়া তাঁহার চরণ, ধারণ করিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ অর্জ্জুনকে উত্তোলন ও আলিঙ্গন করিয়া মস্তকাঘ্রাণপূর্ব্বক পুনর্ব্বার কহিলেন, ‘ভ্রাতঃ! তুমি আমাকে বিশেষরূপে সম্মানিত করিয়াছ, অতএব আশীর্ব্বাদ করিতেছি, অচিরাৎ জয় ও মাহাত্ম লাভ কর।’
“অর্জ্জুন কহিলেন, “হে মহারাজ! অদ্য শরনিকরে বলগর্ব্বিত পাপাত্মা কর্ণকে শমনসদনে প্রেরণ করিব। দুরাত্মা সূতপুত্র শরাসন আনত করিয়া শরজালে আপনাকে যে নিপীড়িত করিয়াছে, অবিলম্বে তাহার প্রতিফল প্রাপ্ত হইবে। এক্ষণে এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, কর্ণকে নিপাতিত করিয়া ঘোর সংগ্রামস্থল হইতে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক আপনাকে দর্শন ও আপনার সম্মান করিব। হে মহারাজ! আমি আপনার পদস্পর্শ করিয়া সত্য করিতেছি যে, অদ্য সূতপুত্রকে সংহার না করিয়া কদাচ সংগ্রামস্থল হইতে প্রত্যাগত হইব না।’ তখন মহাত্মা ধর্ম্মরাজ অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! তোমার শোকক্ষয়, অরাতিবিনাশ, আয়ুবৃদ্ধি ও জয়লাভ হউক। দেবগণ তোমার মঙ্গল বৃদ্ধি করুন এবং তোমার নিমিত্ত যাহা ইচ্ছে করি, তুমি তৎসমুদয় লাভ কর। এক্ষণে পুরন্দর যেমন পূর্ব্বে আপনার শ্রীবৃদ্ধির নিমিত্ত বৃত্রাসুরের প্রতি গমন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমিও সূতপুত্রের প্রতি ধাবমান হও।”