৬৩তম অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধ—উভয়পক্ষীয় বহু লোকক্ষয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় শ্বেতাশ্বসংযুক্ত নারায়ণসঞ্চালিত রথে অবস্থানপূর্ব্বক সমীরণ যেমন মহাসাগরকে ক্ষুভিত করিয়া থাকে, তদ্রূপ সেই অশ্ববহুল কৌরবসৈন্যগণকে আলোড়িত করিতে লাগিলেন। ঐ সময় আপনার আত্মজ দুৰ্য্যোধন অর্জ্জুনকে যুধিষ্ঠিরের রক্ষায় অনবহিত দেখিয়া ক্রোধভরে স্বীয় সৈন্যগণের অর্ধাংশ লইয়া সমাগত ধর্ম্মরাজের সমীপে সহসা গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে নিবারণ করিয়া। ত্রিসপ্ততি ক্ষুরপ্রাস্ত্রে বিদ্ধ করিলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অবিলম্বে দুর্য্যোধনের প্রতি ত্রিংশৎ ভল্ল প্রয়োগ করিলেন। ঐ সময় কৌরবগণ ধর্ম্মরাজকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত ধাবমান হইলেন। মহাবীর নকুল, সহদেব ও ধৃষ্টদ্যুম্ন বিপক্ষগণের দুষ্ট অভিপ্রায় অবগত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করিবার অভিলাষে অক্ষৌহিণী-সেনাসমভিব্যাহারে মহাবেগে তাঁহার নিকট গমন করিতে লাগিলেন; মহাবীর ভীমও কৌরবপক্ষীয় মহারথগণকে বিমর্দ্দিত করিয়া শত্ৰুবর্গপরিবৃত ধর্ম্মরাজকে রক্ষা করিবার মানসে ধাবমান হইলেন। তখন মহারথ কর্ণ সেই সর্ব্বশাস্ত্ৰপারগ পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণকে আগমন করিতে দেখিয়া শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক নিবারণ করিতে লাগিলেন; তাঁহারাও অনবরত শরজাল বিসর্জন ও তোমর প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিলেন; কিন্তু কোনক্রমেই সূতপুত্রকে নিবারণ করিতে পারিলেন না।
“অনন্তুর মহাবলপরাক্রান্ত সহদেব সত্বর তথায় আগমন করিয়া অনবরত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক বিংশতিশরে দুৰ্য্যোধনকে বিদ্ধ করিলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন সহদেবনিক্ষিপ্ত শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ ও রুধিরধারায় পরিপ্লুত হইয়া প্রভিন্নগণ্ড অচলসন্নিভ মাতঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে সূতপুত্ৰ একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া মহাবেগে আগমনপূর্ব্বক শরনিকরদ্বারা পাঞ্চাল ও পাণ্ডবসৈন্যগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন যুধিষ্ঠিরের সেই অসংখ্য সৈন্য সূতপুত্রের শরজালে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া সহসা ধাবমান হইল। ঐ সময় সূতপুত্রের পূর্ব্বনিক্ষিপ্ত শরের পুঙ্খ পশ্চাৎনিক্ষিপ্ত শরের ফলকদ্বারা আহত হইতে লাগিল। অন্তরীক্ষে শরনিকরসঙ্ঘর্ষণে হুতাশন প্রাদুর্ভূত হইল এবং দশদিকে সঞ্চালিত শলভসমূহের ন্যায় শরজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। মহাবীর সূতপুত্র রক্তচন্দনচর্চিত মণিহেমসমলঙ্কৃত বাহুযুগল বিক্ষেপ করিয়া মহাস্ত্র প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সূতপুত্র সায়কসমূহে সকলকে বিমোহিত করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন; তখন ধর্ম্মরাজও রোষপরবশ হইয়া কর্ণের প্রতি সুশাণিত পঞ্চাশৎ শর নিক্ষেপ করিলেন। হে মহারাজ! অনন্তর রণস্থল শরান্ধকারে নিতান্ত ঘোরদর্শন হইয়া উঠিল। আপনার পক্ষীয় বীরগণ ধর্ম্মরাজনিক্ষিপ্ত সুতীক্ষ্ণ কক্কপত্রসমলঙ্কৃত সায়ক, ভল্ল এবং বিবিধ শক্তি, ঋষ্টি ও মুষলদ্বারা সৈন্যগণকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া হাহাকার করিতে লাগিল। ফলতঃ তৎকালে ধর্ম্মরাজ যে যে স্থানে ক্রূরদৃষ্টি বিসৰ্জন করিতে লাগিলেন, সেই সেই স্থানে সৈন্যগণ ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল।
“অনন্তর মহাবীর কর্ণ ক্রোধে প্রস্ফুরিতানন হইয়া নারাচ, অর্দ্ধচন্দ্র, বৎসদন্ত প্রভৃতি সায়কসমুদয় বর্ষণপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজের প্রতি ধাবমান হইলেন। যুধিষ্ঠিরও সূতপুত্রের প্রতি সুবর্ণপুঙ্খসম্পন্ন নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ হাস্যমুখে নিশিত তিনভল্লে যুধিষ্ঠিরের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই সূতপুত্রনিক্ষিপ্ত ভল্লের আঘাতে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া রথে উপবেশনপূর্ব্বক সারথিকে অবিলম্বে রথ অপসারিত করিতে আদেশ করিলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ অন্যান্য ভূপালবৰ্গসমভিব্যাহারে ‘ধর্ম্মরাজকে গ্রহণ কর’ বলিয়া বারংবার চীৎকারপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। অনন্তর এক সহস্র সাত শত কৈকয় পাঞ্চালগণ সমভিব্যাহারে কৌরবগণকে নিবারণ করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে সেই লোক্ষয়ের তুমুল যুদ্ধ সমুপস্থিত হইলে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন ও দুর্য্যোধন পরস্পর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন।”