১৪০তম অধ্যায়
যুগোচিত ব্যবস্থা—ভরদ্বাজ-শত্ৰুঞ্জয় সংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যুগক্ষয় নিবন্ধন ধৰ্ম্ম উচ্ছিন্ন এবং লোকসকল বিনষ্টপ্রায় ও দস্যুদল কর্ত্তৃক নিপীড়িত হইলে রাজার কিরূপে অবস্থান করা কর্ত্তব্য?”
ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ! মহীপাল তৎকালে ঘৃণা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক যেরূপ অবস্থান করিবেন, আমি তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি। ভরদ্বাজ-শত্রুঞ্জয় সংবাদ নামক যে এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, তাহা শ্রবণ করিলেই তুমি ঐ বিষয় অবগত হইতে পারিবে। সৌবীরদেশে শত্রুঞ্জয় নামে এক মহারথ মহীপাল ছিলেন। তিনি একদা মহর্ষি ভরদ্বাজের নিকট গমন। করিয়া অর্থনির্ণয় প্রসঙ্গ উত্থাপনপূৰ্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তপোধন! অলব্ধ বস্তু কিরূপে লাভ করা যাইতে পারে এবং বস্তু লব্ধ হইলে কিরূপে তাহার পরিবর্দ্ধন, পরিবর্দ্ধিত হইলে কি উপায়ে তাহার রক্ষাবিধান ও সুরক্ষিত হইলে কিরূপে উহা ব্যয় করা যাইবে?’ রাজা শত্ৰুঞ্জয় মহর্ষি ভরদ্বাজকে এইরূপে অর্থ নির্ণয়-বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে মহর্ষি যুক্তি অনুসারে কহিলেন, ‘মহারাজ! রাজা প্রতিনিয়ত দণ্ড উদ্যত করিয়া রাখিবেন, নিরন্তর পুরুষকার প্রদর্শন ও শত্রুর রান্বেষণ করিবেন এবং যাহাতে তাঁহার রন্ধ্র সতত প্রচ্ছন্ন থাকে, তদ্বিষয়ে সবিশেষ যত্নবান হইবেন। উগ্রতর দণ্ড উদ্যত করিয়া রাখিলে সকলেই ভীত হইয়া থাকে; অতএব দণ্ডদ্বারাই সকলকে শাসন করিতে যত্নশীল হওয়া উচিত। তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতেরা দণ্ডেরই সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকেন; অতএব সাম, দান প্রভৃতি চারিটি উপায়ের মধ্যে দণ্ডই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ।
‘আশ্রম[আশ্রয়]স্থান উন্মূলিত হইলে আশ্রয়ীদিগের জীবন বিনষ্ট হয়; বৃক্ষের মূলোচ্ছেদ হইলে উহার শাখাপ্রশাখা-সকলও নিপতিত হইয়া থাকে; অতএব বুদ্ধিমান নৃপতি অগ্রে শত্রুপক্ষের মূলোচ্ছেদ করিয়া পশ্চাৎ উহার পক্ষ ও সহায় উন্মলনে যত্নবান্ হইবেন। আপৎকাল উপস্থিত হইলে কালবিলম্ব না করিয়া উৎকৃষ্ট উপায় অবধারণপূৰ্ব্বক মন্ত্রণা, বিক্রমপ্রকাশ, যুদ্ধ বা পলায়ন করিবে। হৃদয়কে ক্ষুরের ন্যায় করিয়া বাক্যে বিনয় প্রদর্শন এবং কাম ও ক্রোধকে বশীভূত করিয়া মৃদুভাবে লোকের সহিত সম্ভাষণ করিবে। শত্রুর সহিত কাৰ্য্য সংস্রব উপস্থিত হইলে অগ্রে তাহার সহিত সন্ধি করা কর্ত্তব্য এবং কৃতকার্য্য হইলে অবিলম্বেই তাহার সংসর্গ পরিত্যাগ করা উচিত। বিচক্ষণ ব্যক্তি শত্রুকে মিত্রভাবে সান্ত্বনা করিবেন এবং সসৰ্প [সর্পযুক্ত] গৃহের ন্যায় সতত তাহা হইতে ভীত হইবেন। স্বীয় বুদ্ধিদ্বারা যাহার বুদ্ধি পরাভূত করিতে হইবে, তাহাকে অভয়প্রদানপূর্ব্বক সান্ত্বনা করিবে; পরিণামহিতকারিণী [ভবিষ্যৎ] বুদ্ধি অবলম্বন করিয়া নির্ব্বোধকে এবং প্রত্যুৎপন্নমতি[হঠাৎ উদিত উত্তম বুদ্ধি]দ্বারা পণ্ডিতকে সান্ত্বনা করা উচিত। মঙ্গলার্থী ব্যক্তি লোকের নিকট অঞ্জলিবন্ধন, শপথ, মিষ্টবাক্যপ্রয়োগ, প্রণতি ও অশ্রুমোচন করিয়াও স্বকাৰ্য্যসাধন করিবে। যতদিন সময়ের প্রতিকূলতা থাকিবে, তত দিন শত্রুকে স্কন্ধে বহন এবং সময় অনুকূল হইলে তাহাকে প্রস্তর-নিক্ষিপ্ত [পাথরেব উপর ফেলিয়া দেওয়া] কলসের ন্যায় বিনাশ করিবে। তিন্দুক[গাব]কাষ্ঠের ন্যায় মুহূর্ত্তকালও প্রজ্বলিত হওয়া শ্রেয়স্কর, কিন্তু তুষানলের [তুষের] ন্যায় নিরন্তর প্রধূমিত[ধূমযুক্ত] হওয়া বিধেয় নহে। বহুপ্রয়োজনসম্পন্ন পুরুষ কৃতঘ্নের সহিত অর্থের কোন সংস্রব রাখিবেন না। কৃতঘ্ন তাহাদের কার্য্য হইলেই উপকারীর অবমাননা করিয়া থাকে। অতএব তাহাদের কাৰ্য্য এককালে সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন না করিয়া উহার অবশেষ রাখা আবশ্যক।
“রাজা অন্যদ্বারা পোষ্যবর্গকে পোষণপূর্ব্বক কোকিলের [১],
১। কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, ডিম ফুটিলেও বৰ্ণসাম্যে কাক উহাকে কোকিল বলিয়া বুঝিতে পারে না; নিজের ছানাবোধে খাদ্য দিয়া রক্ষা করে; কিন্তু স্বর ফুটিলে চিনিতে পারিয়া যখন ঠোকরাইতে যায়, তখন কোকিল উড়িয়া পলায়; তাই কোকিলের অপর নাম অন্যপুষ্ট।
শত্রুবর্গের মূলোৎপাটন করিয়া বরাহের [২], অনুলঙ্ঘনীয়তা দ্বারা সুমেরুপৰ্ব্বতের [৩] এবং বিবিধ রূপ ধারণপূৰ্ব্বক নটের অনুকরণ করিবেন।
২। কৃষিকুশল কৃষক জমির মধ্যে স্থানে স্থানে কিছু গভীর গর্ত্ত খুঁড়িয়া কুক্কুরে-আলু বা লতা-আলু পুঁতিয়া দেয়। শূকরেরা সেই আলু খুলিয়া খাইবার জন্য দাঁত দিয়া জমি এইরূপে চষিয়া ফেলে যে, হাল-চাষে তাহা হয় না। বলা বাহুল্য—যে সব জমি বাচাট—যাহাতে অধিক জন-মজুর খরচ করিতে হয়, সেই সব জমিতেই ঐরূপ করা হইয়া থাকে।
৩। অলঙ্ঘনীয়তা—উচ্চ প্রাচীর দুর্গাদিদ্বারা রক্ষিত রাজ্য লঙ্ঘনের অযোগ্য
শূন্যগৃহের ন্যায় আপনার ধনাগমই শ্রেয়স্কর বিবেচনা করা তাঁহার অতীব কর্ত্তব্য। মহীপাল প্রতিনিয়ত উদ্যোগসম্পন্ন হইয়া শত্রুগৃহে গমন এবং উহার কোন অমঙ্গল থাকিলেও উহার মঙ্গল-সংবাদ জিজ্ঞাসা করিবেন। অলস, অভিমানী, উদ্যোগশূন্য, লোকাপবাদভীত ও দীর্ঘসূত্ৰী ব্যক্তি কিছুতেই অর্থলাভে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারে না। শত্রুগণ আপনাদিগের ছিদ্রের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া কেবল পরছিদ্রের অনুসন্ধান করে, অতএব কূৰ্ম্মের ন্যায় আপনার অঙ্গগোপন ও আপনার ছিদ্রসংবরণে যত্নবান হওয়া, সিংহের ন্যায় বিক্ৰম প্রকাশ, বৃকের ন্যায় প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান এবং বাণের ন্যায় শত্রুকে আক্রমণ করা উচিত। সুরাপান, অক্ষক্রীড়া, স্ত্রীসম্ভোগ, মৃগয়া ও গীতবাদ্য এই সমস্ত কাৰ্য্য যুক্তি অনুসারে অনুষ্ঠান করিবে। ঐ সমুদয় কার্য্যে একান্ত অনুরাগ দোষমধ্যে পরিগণিত হইয়া থাকে। সুচতুর ভূপতি বংশাদিদ্বারা কার্ম্মুক প্রস্তুত করিবেন; মৃগের ন্যায় সতর্কচিত্তে শয়ন করিয়া থাকিবেন; সময়ক্রমে অন্ধ ও বধিরের ন্যায় ব্যবহার করিবেন এবং দেশকাল বিবেচনা করিয়া বিক্রমপ্রকাশে প্রবৃত্ত হইবেন। দেশকাল সম্যক্ বিচার করিতে অসমর্থ হইলে বিক্রমও ব্যর্থ হইয়া যায়, সন্দেহ নাই। কালাকাল ও বলাবল অবধারণপূর্ব্বক সন্ধিবিগ্রহাদি কার্য্যে নিযুক্ত হওয়া আবশ্যক।
“যে রাজা শত্রুকে আয়ত্ত করিয়া দণ্ডপ্রদানপূৰ্ব্বক শাসন না করেন, গর্ভবতী অশ্বতরীর [খচ্চরীর] ন্যায় তাঁহাকে অবিলম্বেই বিনষ্ট হইতে হয়। যে রাজা পুষ্পিত হইয়াও অফল, ফলিত হইয়াও একান্ত দুরারোহ এবং অপক্ক হইয়াও পক্কের ন্যায় দৃষ্ট হয়েন, তাঁহাকে কদাচ শীর্ণ হইতে হয় না। রাজা বাক্যদ্বারা অর্থীদিগের আশা বলবতী করিয়া পরে বিশেষ কারণ প্রদর্শনপূর্ব্বক বার বার সেই আশায় বিদ্যানুষ্ঠান করিবেন। যে পৰ্য্যন্ত ভয় উপস্থিত না হয়, তদবধি ভীতের ন্যায় অবস্থান করিবে; কিন্তু ভয় উপস্থিত হইয়াছে। দেখিলে নির্ভীকের ন্যায় তাহার প্রতিকারের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। মনুষ্য সঙ্কটে পতিত না হইলে কদাচ মঙ্গললাভে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি সঙ্কটে পতিত হইয়া মুক্তিলাভ করিতে পারে, তাহারই সমস্ত মঙ্গল হস্তগত হয়। ভয় উপস্থিত হইবার পূর্বে উহা সম্যক্রূপে অবধারণ, উপস্থিত হইলে যে-কোন প্রকারে হউক নিবারণ এবং সম্যক্রূপে নিবৃত্ত হইলেও পুনরায় বর্দ্ধিত হইবার আশঙ্কা করিয়া অনিবৃত্তের ন্যায় বিবেচনা করা আবশ্যক।
“উপস্থিত সুখপরিত্যাগ ও অনুপস্থিত সুখের প্রত্যাশা করা ন্যায়ানুগত নহে। যে ব্যক্তি শত্রুর সহিত সন্ধি করিয়া বিশ্বস্তচিত্তে অবস্থান করে, সে বৃক্ষাগ্রে নিদ্রিত ব্যক্তির ন্যায় নিপতিত হইয়া প্রতিবোধিত [জাগরিত] হয়। যে-কোন উপায়ে হউক, আপনার দুরবস্থা মোচন এবং সমর্থ হইয়া ধর্ম্মাচরণ করিবে। যাহারা শত্রুর বিপক্ষ, সতত তাহাদিগের সম্মান করা কর্ত্তব্য। যাহারা আপনার চর, তাহাদিগকেও শত্ৰুকর্ত্তৃক প্রেরিত আশঙ্কা করিবে এবং আপনার ও শত্রুর চরদিগকে বিলক্ষণ পরিচিত করিয়া রাখিবে। পাষণ্ডতাপস [কপট তপস্বী—অন্তরে কু মতলবকারী, বাহিরে বিশুদ্ধ বেশধারী] প্রভৃতি দুশ্চরিত্র ব্যক্তিদিগকে পররাষ্ট্রে নিয়োগ করা শ্রেয়স্কর। লোকের কন্টকস্বরূপ দুরাত্মা তস্করেরা উদ্যান, বিহারস্থান [বেড়াইবার স্থান], শূন্যসাগর [মদ্যাদি পানের স্থান], পানাগার, বেশ্যাপল্লী, তীর্থ ও দূতসভায় প্রতিনিয়ত গমনাগমন করিয়া থাকে; উহাদিগকে শাসন করিয়া ঐ সকল স্থান হইতে নিষ্কাশিত করা আবশ্যক। অবিশ্বস্তের প্রতি কদাচ বিশ্বাসস্থাপন করিবে না; বিশ্বাসীর প্রতিও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য নহে। সবিশেষ না জানিয়া একজনকে বিশ্বাস করিলে বিলক্ষণ বিপৎপাতের সম্ভাবনা আছে; অতএব যাহাকে বিশ্বাস করিতে হইবে, অগ্রে তাহাকে পরীক্ষা করা কর্ত্তব্য। বিশেষ হেতু প্রদর্শনপূর্ব্বক শত্রুর বিশ্বাস উৎপাদন করিবে এবং তাহার কিছুমাত্র ত্রুটি দেখিলেই সবিশেষ দণ্ডবিধানে প্রবৃত্ত হইবে।
“যাহাদিগের নিকট হইতে আশঙ্কা উপস্থিত হইতে পারে তাহাদিগকে বিলক্ষণ শঙ্কা করিবে; আবার যাহাদিগের নিকট হইতে কোন শঙ্কারই সম্ভাবনা নাই, তাহাদিগকেও শঙ্কা করা আবশ্যক। কারণ, ঐ ব্যক্তি হইতে যদি কোন কারণবশতঃ কোন বিপদ্ উপস্থিত হয়, সেই বিপদ লোককে সমূলে বিনষ্ট করিতে পারে। তপস্বীর ন্যায় কাষায়বস্ত্র পরিধান, জটাজিনধারণ ও মৌনাবলম্বনপূৰ্ব্বক শত্রুর বিশ্বাসোৎপাদন করিয়া বৃকের ন্যায় তাহাকে আক্রমণ করিবে। পুত্র, ভ্রাতা, পিতা বা সুহৃৎ যে কেহ হউক না কেন, অর্থের বিঘ্নানুষ্ঠান করিলেই অবিচারিতচিত্তে তাহার শাসন করা কর্ত্তব্য। অধিক কি, গুরুও অবিবেচক, গর্ব্বিত ও উজ্জ্বল হইলে শাস্ত্রানুসারে তাহার দণ্ডবিধান করা অসঙ্গত নহে। মঙ্গলার্থী ব্যক্তি প্রত্যুত্থান [মান্যব্যক্তি উত্থিত হইলে স্বয়ং উত্থান], অভিবাদন ও দ্রব্যাদিসম্প্রদান। দ্বারা শত্রুকে আয়ত্ত করিয়া তীক্ষ্ণতুণ্ড পতঙ্গ যেমন বৃক্ষের সমুদয় ফল-পুষ্প ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ তাহার সমস্ত পুরুষার্থ বিনষ্ট করিয়া ফেলিবেন। পরের মর্ম্মপীড়ন দারুণ কর্ম্মসাধন ও মৎস্যঘাতীর ন্যায় অনেকের প্রাণবিনাশ না করিলে কদাচ মহতী শ্ৰীলাভে সমর্থ হওয়া যায় না। জাতিনিবন্ধন [নামমাত্রে] কেহ বা শত্রু বা কেহ মিত্র হয় না; লোকে কার্য্যবশতঃই অন্যের শত্রু ও মিত্রপদবাচ্য হইয়া থাকে। শত্রু আক্রান্ত হইয়া অতি করুণস্বরে পরিতাপ করিলেও তাহার বাক্যশ্রবণে দুঃখপ্রকাশ বা তাহাকে পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য নহে। পূৰ্ব্বাপকারীকে যেকোন প্রকারে হউক, বিনাশ করা উচিত। লোকসংগ্রহ ও তাহাদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা বিধেয়। আর যে ব্যক্তি বিপক্ষতাচরণ করিবে, তাহাকে তৎক্ষণাৎ নিগ্রহ করাই শ্রেয়স্কর।
“কাহাকে প্রহার করিবার ইচ্ছা হইলে তাহার প্রতি প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিবে। লোককে প্রহার করিয়া তাহাকে প্রিয়বাক্যে সান্ত্বনা করা উচিত। লোকের শিরচ্ছেদন করিয়াও তাহার নিমিত্ত রোদন ও শোকপ্রকাশ করা বুদ্ধিমানের কার্য্য। যাঁহার সম্পদ্লাভের ইচ্ছা আছে, তিনি সান্ত্ববাদ, সম্মান ও তিতিক্ষা [ক্ষমা] প্রদর্শনপূৰ্ব্বক সকলের সহিত সুব্যবহার করিবেন। উহা অপেক্ষা অন্যের চিত্তরঞ্জনের উৎকৃষ্ট উপায় আর কিছুই নাই। যাহাতে কিছুমাত্র স্বার্থ নাই, সেরূপ বৈরাচরণ কদাচ কৰ্ত্তব্য নহে। বাহুদ্বারা নদী সন্তরণ করা অতি মূঢ়ের কাৰ্য্য। গোবিষাণ [গরু প্রভৃতির শৃঙ্গ কলিকালে গোর শৃঙ্গভক্ষণ কেবল অনর্থক নহে, অত্যন্ত অপবিত্র। এখানে অতিশুষ্ক নীরস শৃঙ্গমাত্র প্রদর্শনই উদ্দেশ্য, গো সামান্যতঃ নির্দ্দেশ।] ভক্ষণ অনর্থক ও আয়ুঃক্ষয়কর, উহাতে কেবল দন্তসকল ক্ষয় হয়, কিন্তু কিছুমাত্র রসের আস্বাদ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। অতএব যাহাতে লাভের সম্ভাবনা নাই, এরূপ কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হওয়া কদাপি বিধেয় নহে। ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম ত্রিবিধ পীড়া আছে। ধৰ্ম্মদ্বারা অর্থের, অর্থদ্বারা ধৰ্ম্মের এবং কামদ্বারা ধৰ্ম্ম, অর্থ উভয়েরই বিঘ্ন উপস্থিত হয়। ক্ষুদ্র লোকেরা ধর্ম্মের অর্থ, অর্থের কাম ও কামের ইন্দ্রিয়প্রীতি এবং মহৎলোকেরা ধৰ্ম্মের চিত্তশুদ্ধি, অর্থের যজ্ঞানুষ্ঠান ও কামের জীবনধারণই মুখ্য ফল বিবেচনা করে। অতএব যাহাতে ত্রিবর্গের কোন পীড়া না জন্মে, তদ্বিষয়ে সতত সাবধান থাকা এবং ঐ পূর্ব্বোক্ত ফলসমুদয়ের বলাবল বিবেচনা করিয়া ত্রিবর্গের সেবা করা সৰ্ব্বতোভাবে উচিত। ঋণ, অগ্নি ও শত্রুর অবশেষ রাখা কর্ত্তব্য নহে। ঐ সমুদয়ের অত্যল্পমাত্র অংশ অবশিষ্ট থাকিলেই উহারা পুনর্ব্বার পরিবর্দ্ধিত হইয়া উঠে। ঋণ, পরাভূত শত্রু ও ব্যাধির প্রতি উপেক্ষা করিলেই উহারা ঘোরতর অনিষ্ট সম্পাদন করিয়া থাকে। কণ্টক সমূলে উন্মলন না করিলে তদ্বারা বিলক্ষণ পীড়া জন্মে সন্দেহ নাই কার্য্যই সম্যকরূপে সম্পাদন করা এবং সতত সাবধান হওয়া আবশ্যক।
“মনুষ্যবিনাশ, মার্গদূষণ [মারণযন্ত্রণাদিদ্বারা পথ অগম্যকরণ] গৃহদাহ প্রভৃতি কার্য্যদ্বারা পররাষ্ট্র বিনষ্ট করা কর্ত্তব্য। বুদ্ধিমান্ লোক গৃধ্রের ন্যায় দূরদর্শী, বকের ন্যায় নিশ্চল, কুক্কুরের ন্যায় জাগরূক, সিংহের ন্যায় বিক্রান্ত ও কাকের ন্যায় ইঙ্গিতজ্ঞ হইরে এবং ভুজঙ্গের ন্যায় নিরুদ্বেগে শত্রুর দুর্গমধ্যে সত্বর প্রবেশ করিবে। বীরকে প্রণতি, ভীরুকে ভয়প্রদর্শন ও লুব্ধকে অর্থদানদ্বারা আয়ত্ত করা কর্ত্তব্য। তুল্য ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ করাই উচিত। শত্রুগণ রাজ্যস্থ প্রধান প্রধান ব্যক্তিদিগের মধ্যে ভেদোৎপাদন ও প্রিয় বয়স্যের নিকট অনুনয় প্রদর্শনপূৰ্ব্বক বশে আনয়ন করিলেও যাহাতে উহারা আমাত্যগণকে ভেদ বা বিনাশ করিতে না পারে, তদ্বিষয়ে সতত সাবধান হওয়া উচিত। মহীপাল মৃদুস্বভাব হইলে সকলেই তাহাকে অবজ্ঞা করে এবং অতিশয় উগ্র হইলে সকলেই তাহা হইতে ভীত হয়; অতএব অবসর বুঝিয়া মৃদুতা বা উগ্রতা অবলম্বন করা রাজার আবশ্যক। মৃদুতাদ্বারা মৃদু ও দারুণ উভয়কেই বিনাশ করা যাইতে পা; মৃদুতার অসাধ্য কিছুই নাই। অতএব মৃদু তীক্ষ্ণ অপেক্ষাও তীক্ষ্ণতর। যে ব্যক্তি সময়ানুসারে মৃদুতা ও তীক্ষ্ণতা অবলম্বন করে, সে নিশ্চয়ই কৃতকাৰ্য্য ও শত্রুবিনাশে সমর্থ হয়।
“পণ্ডিতের সহিত বিরোধ উৎপাদনপূর্ব্বক আপনাকে দূরস্থ জ্ঞান করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিবে না। বুদ্ধিমানের শাহুদ্বয় অতি সুদীর্ঘ; তিনি অপকৃত হইলে সেই বাহুদ্বয়প্রভাবে দুরস্থ শত্রুরও অপকারসাধনে সমর্থ হয়েন। যাহা পার হইবার নিতান্ত অসম্ভব, তাহা পার হইবার নিমিত্ত চেষ্টা করা কর্ত্তব্য নহে। শত্রু যাহা প্রত্যাহরণ করিতে সমর্থ হইবে, তাহা কদাচ অপহরণ করিবে না। যাহার মূল উৎপাটন না করা যায়, তাহার নিমিত্ত খননপ্রয়াস [মাটী খোঁড়ার শ্রম] স্বীকার করা বিধেয় নহে এবং যে শত্রুর মস্তক ছেদন করিতে পারা যায় না, তাহাকে প্রহার করা নিতান্ত অনর্থক।
“এই কয়েকটি উপদেশ আপৎকালের নিমিত্ত কীর্ত্তন করিলাম। অন্য সময়ে ইহার অনুসরণ করা কর্ত্তব্য নহে। শত্ৰুকর্ত্তৃক আক্রান্ত ও ঘোর বিপদে নিপতিত হইলে ইহার অনুষ্ঠান পাপজনক হইতে পারে না। আমি তোমার হিতসাধনোদ্দেশেই এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলাম।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! রাজা শত্ৰুঞ্জয় হিতার্থ মহর্ষি ভরদ্বাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অক্ষুব্ধমনে তদনুরূপ কার্য্যানুষ্ঠানপূর্ব্বক বন্ধুবান্ধবগণসমভিব্যাহারে পরমসুখে রাজশ্রী ভোগ করিতে লাগিলেন।”