২২২. প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেককথা—ইন্দ্র-প্রহ্লাদসংবাদ

২২২তম অধ্যায়

প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেককথা—ইন্দ্র-প্রহ্লাদসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ইহলোকে যে শুভ ও অশুভ কৰ্ম্মসমুদয় পুরুষকে ফলপ্রদান করে, পুরুষ সেই কর্ম্মসমুদয়ের কৰ্ত্তা কি না, তাহা যথার্থরূপে কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই স্থলে ইন্দ্র-প্রহ্লাদসংবাদ নামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, শ্রবণ কর। একদা দেবরাজ ইন্দ্র মহাকুলসমুৎপন্ন শূন্যাগায়ে সমাসীন বহুশাস্ত্রজ্ঞ প্রহ্লাদের নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহার ধৰ্ম্মবুদ্ধি অবগত হইবার নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘দানবরাজ! লোকের যেসমস্ত গুণ অভীষ্ট, তৎসমুদয়ই তোমাতে লক্ষিত হইয়া থাকে। এক্ষণে তোমার বুদ্ধি বালকের ন্যায় রাগদ্বেষাদিবিরহিত বলিয়া অনুভূত হইতেছে। তুমি এই জীবলোকে কোন্ বস্তুকে আত্মজ্ঞানলাভের শ্রেয়স্করসাধন বিবেচনা কর? তুমি বিপক্ষের হস্তগত, পাশবদ্ধ, রাজ্যচ্যুত ও শ্রীহীন হইয়াও কিছুমাত্র শোকপ্রকাশ করিতেছ না। তুমি আপনার এইরূপ অনিষ্টপাত দর্শন করিয়াও যে প্রকৃতিস্থ আছ, ইহা কি তোমার প্রজ্ঞার ফল অথবা ধৈৰ্য্যই ইহার কারণ?

‘দানবরাজ প্রহ্লাদ কাৰ্য্যকলাভিলাষশূন্য, আলস্য ও অহঙ্কার বিরহিত, সত্ত্বগুণাবলম্বী, শমদমাদিনিরত, চরাচর ভূতগণের সৃষ্টিসংহারবেত্তা, আত্মজ্ঞানে স্থিরনিশ্চয়, সৰ্ব্বজ্ঞ ও সৰ্ব্বভূতে সমদৃষ্টি ছিলেন এবং কি স্তুতি, কি নিন্দা, কি প্রিয়, কি অপ্রিয়, কি কাঞ্চন, কি লোষ্ট্র সকলই সমান জ্ঞান করিতেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া স্বীয় ধৰ্ম্মবুদ্ধি অনুসারে মধুরবাক্যে কহিলেন, “সুরেশ্বর! যে ব্যক্তি প্রাণীগণের উৎপত্তি ও প্রলয়ের বিষয় অনুধাবন করিতে সমর্থ হয় না, সে অজ্ঞানবশতঃ বিমুগ্ধ হইয়া থাকে; আর যে ব্যক্তি তাহা অবগত হইতে পারে, তাহাকে আর বিমোহিত হইতে হয় না। স্থূল ও সূক্ষ্ম সমুদয় পদার্থই প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন ও বিনষ্ট হইতেছে; সুতরাং পুরুষ স্বয়ং কোন কার্য্যেরই কৰ্ত্তা নহেন। কিন্তু পুরুষ ভিন্ন কোন কার্য্যেরই অনুষ্ঠান হইতে পারে না। প্রকৃতি জড়ময়ী। লৌহ যেমন অয়স্কান্তমণির সান্নিধ্যে সচেষ্ট হয়, তদ্রূপ প্রকৃতি পুরুষের সান্নিধ্যবশতঃ সচেষ্ট হইয়া সমুদয় পদার্থকে পরিচালিত করিতেছে। পুরুষ যদিও কোন কার্য্যে ব্যাপৃত নহেন, তথাপি অবিদ্যাপ্রভাবে সমুদয় কার্য্যেই তাঁহার অভিমান থাকে। যাহা হউক, যিনি আত্মার কর্ত্তৃত্ব স্বীকার করেন, তাঁহার বুদ্ধি নিতান্ত দূষিত, কখনই তত্ত্বজ্ঞাননিষ্ঠ নহে। যদি জ্ঞানস্বরূপ পুরুষ কর্ত্তা হইতেন, তাহা হইলে তিনি কাৰ্য্য আরম্ভ করিলেই তাহা সফল হইত, কখনই বিফল হইত না। যখন প্রাণীগণের মধ্যে কেহ কেহ যত্নবান হইয়াও অনিষ্টপাত ও ইষ্টবিয়োগজনিত দুঃখ সহ্য করিতেছে এবং কেহ কেহ বিনা যত্নেও ইষ্টসম্ভোগ ও অনিষ্টের নিরাকরণার্থে সমর্থ হইতেছে এবং যখন বুদ্ধিমান ব্যক্তিদিগকে অতি সামান্য অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে ধনপ্রত্যাশা করিতে দেখা যাইতেছে, তখন আমার মতে কি মোক্ষলাভ, কি আত্মজ্ঞান সমুদয়ই প্রকৃতি হইতে সদ্ভূত হইয়া থাকে। আর যদি সমুদয় বিষয়ই প্রকৃতি হইতে সমুৎপন্ন হইল, তবে লোকের কোন বিষয়ে অভিমান করা নিতান্ত নিরর্থক।

‘ইহলোকে কৰ্ম্মপ্রভাবে লোকের শুভাশুভ ফলাফল হইয়া থাকে। এক্ষণে আমি আপনার নিকট কৰ্ম্মবিষয়সমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। বায়স যেমন অন্নভোজনকালে স্বজাতীয়দিগকে সম্বোধন করিয়া তত্ৰত্য অন্নের বিষয় প্রকাশ করিয়া দেয়, তদ্রূপ কাৰ্য্যসমুদয় প্রকৃতিকে প্রকাশিত করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি প্রকৃতিকে অবগত হইতে অসমর্থ হইয়া কেবল প্রকৃতির কাৰ্য্যসমুদয় অবগত হয়, সে অজ্ঞাননিবন্ধন নিতান্ত বিমুগ্ধ হইয়া থাকে। আর যিনি প্রকৃতিকে উত্তমরূপে অবগত হইতে সমর্থ হয়েন, তাঁহাকে আর বিমোহিত হইতে হয় না। যিনি এই জগতীতলস্থ সমুদয় পদার্থ প্রকৃতি হইতে সদ্ভূত বলিয়া স্থিরসিদ্ধান্ত করিতে পারেন, তাঁহার দর্প বা অভিমান কিছুই থাকে না।

‘যখন আমি ধৰ্ম্মকাৰ্য্য প্রভৃতি সমুদয় কাৰ্য্য প্রকৃতি হইতে সমুৎপন্ন এবং সমুদয় পদার্থ বিনশ্বর বলিয়া অবগত হইয়াছি; আর যখন মমতা, অহঙ্কার, মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা ও বন্দনপরিশূন্য হইয়া পরমসুখে জীবগণের উৎপত্তি ও বিনাশের বিষয় অবলোকন করিতেছি, তখন আর কি নিমিত্ত শোক প্রকাশ করিব? যে ব্যক্তি জ্ঞানসম্পন্ন, দমগুণান্বিত, নিস্পৃহ ও অবিনশ্বর আত্মার সন্দর্শনে সমর্থ হয়েন, তাঁহাকে কখন কোন ক্লেশ ভোগ করিতে হয় না। কি প্রকৃতি, কি বিকৃতি, কিছুতেই আমার অনুরাগ বা বিদ্বেষ নাই। আমি এক্ষণে কাহাকেও শত্রু বা মিত্র বলিয়া জ্ঞান এবং স্বর্গ, মর্ত্ত বা পাতাল কিছুই কামনা করি না। শাস্ত্রীয় জ্ঞান, অনুভব বা জ্ঞানের বিষয়ে আমার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।

‘ইন্দ্র কহিলেন, ‘প্রহ্লাদ! যে উপায় অবলম্বন করিলে এতাদৃশ জ্ঞান ও শান্তি লাভ করিতে পারা যায়, তুমি বিস্তারিতরূপে তাহা, কীৰ্ত্তন কর।’

“প্ৰহ্লাদ কহিলেন, ‘দেবরাজ! সরলতা, অপ্রমাদ, চিত্তশুদ্ধি, জিতেন্দ্রিয়তা ও জ্ঞানবৃদ্ধদিগের সেবা অবলম্বন করিলে মোক্ষ লাভ করিতে পারা যায়। সত্ত্বপ্রধানা প্রকৃতি হইতে তত্ত্বজ্ঞান ও শান্তি এবং রজঃপ্রধানা প্রকৃতি হইতে মায়িকজ্ঞান লাভ হইয়া থাকে।’

“হে ধৰ্ম্মরাজ। দৈত্যপতি প্রহ্লাদ এই কথা কহিলে দেবরাজ বিস্ময়াপন্ন হইয়া প্রীতমনে তাঁহার বাক্যের অভিনন্দনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে পূজা করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।”