২৪৩. গার্হস্থ্যধৰ্ম্মনির্ণয়

২৪৩তম অধ্যায়

গার্হস্থ্যধৰ্ম্মনির্ণয়

“ব্যাস বলিলেন, ‘পণ্ডিতেরা গৃহীদিগের চারিপ্রকার জীবনোপায় নিরূপিত করিয়া দিয়াছেন। তাঁহারা তদনুসারে কেহ কেহ ত্রৈবার্ষিক ধান্য ও কেহ কেহ একবার্ষিক ধান্য সঞ্চয় করিয়া রাখেন, কেহ কেহ প্রতিদিন ভক্ষ্যবস্তু আহরণ করিয়া ভোজন করেন এবং কেহ কেহ বা উঞ্ছবৃত্তি [অতিকষ্টবৃত্তি-কৃষকেরা জমির ধান্য কাটিয়া লইলে যে দুই-একটা ধানের শীষ আকাটা অবস্থায় পড়িয়া থাকে, তাহার সংগ্রহ] অবলম্বনপূৰ্ব্বক জীবিকানিৰ্ব্বাহে প্রবৃত্ত হয়েন। এই চারিপ্রকার গৃহস্থের মধ্যে প্রথম অপেক্ষা দ্বিতীয়, দ্বিতীয় অপেক্ষা তৃতীয় ও তৃতীয় অপেক্ষা চতুর্থ শ্রেণী শ্রেষ্ঠ। উহাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর যজনাদি ষট্‌কাৰ্য্য, দ্বিতীয় শ্রেণীর অধ্যয়ন, দান ও প্রতিগ্রহ, তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যয়ন ও দান এবং চতুর্থ শ্রেণীর অধ্যয়নমাত্ৰ কৰ্ত্তব্য। গৃহীদিগের ব্রতসমুদয় সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রধান বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। আত্মদরপুরণার্থ [নিজের পেট ভরার জন্য] অন্নপাক ও পশুহত্যা করিতে অনুজ্ঞা করা গৃহস্থের নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। তাঁহারা যজ্ঞানুষ্ঠানের নিমিত্ত যজুৰ্ব্বেদোক্ত মন্ত্র পাঠপূৰ্ব্বক ছাগাদি পশু ও অশ্বত্থাদি বৃক্ষচ্ছেদন করিবেন। দিবাভাগে এবং প্রথমরাত্রি ও শেষরাত্রিতে নিদ্রানুভব করা, দিবারাত্রির মধ্যে দুই বারের অধিক ভোজন করা ও ঋতুকাল ব্যতীত স্ত্রীসম্ভোগ করা গৃহস্থের কখনই কর্ত্তব্য নহে।

‘গৃহী ব্যক্তিরা গৃহাগত ব্রাহ্মণের অর্চ্চনা করিয়া তাঁহাকে ভোজন করাইবেন এবং বেদবিশারদ, স্বধর্ম্মোপজীবী জিতেন্দ্রিয় ক্রিয়াবান, তপস্বী শ্রোত্রিয়গণ অতিথি হইলে, তাঁহাদিগকে যথোচিত সৎকার করিয়া হব্য[দেবোদ্দেশে দেয়]কব্য[পিতৃগণের উদ্দেশে দেয়]দ্বারা পরিতৃপ্ত করিবেন। কি স্বধৰ্ম্মজ্ঞাপনার্থ বৃথা নখলোমধারী, অগ্নিহোত্রপরিত্যাগী, গুরুর অপ্রিয়কারী ব্যক্তি, কি চণ্ডাল, যে হউক না কেন, গৃহে উপস্থিত হইলেই তাঁহাকে ভোজন প্রদান করা গৃহস্থের অবশ্য কর্ত্তব্য। গৃহী ব্যক্তিরা প্রত্যহ ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীদিগকে এবং অন্যান্য প্রাণীগণকে ভক্ষ্যবস্তু প্রদান করিবেন। প্রত্যহ বিঘস ও অমৃত ভোজন করা তাঁহাদিগের কর্ত্তব্য। ঘৃতসংযুক্ত যজ্ঞাবশিষ্ট ভক্ষ্যবস্তুই অমৃতস্বরূপ। যে গৃহস্থ পোয্যবর্গের ভোজনাবসানে ভোজন করেন, তাহাকে বিঘসাশী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। পণ্ডিতেরা পোষ্যবর্গের ভুক্তাবশিষ্ট ভক্ষ্যের নাম বিঘস ও যজ্ঞাবশিষ্ট ভক্ষ্যের নাম অমৃত বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। স্বারনিরত, অসূয়াবিহীন, জিতেন্দ্রিয় গৃহস্থগণ ঋত্বিক্‌, পুরোহিত, আচাৰ্য্য, মাতুল, অতিথি, আশ্রিত, বৃদ্ধ, বালক, আতুর, বৈদ্য, জ্ঞাতি, সম্বন্ধী, বান্ধব, পিতা, মাতা, সগোত্রা স্ত্রী, পুত্র, ভাৰ্য্যা, কন্যা ও দাসবর্গের সহিত বিরোধ পরিত্যাগ করিলে সমুদয় পাপ হইতে মুক্তিলাভ ও সমুদয় লোক জয় করিতে সমর্থ হয়েন, সন্দেহ নাই। পণ্ডিতেরা আচাৰ্য্যকে ব্রহ্মলোকের, পিতাকে প্রজাপতিলোকের, অতিথিকে ইন্দ্রলোকের, ঋত্বিক্‌গণকে দেবলোকের, সগোত্রা স্ত্রীকে অপ্সরালোকের, জ্ঞাতিদিগকে বিশ্বদেবলোকের, সম্বন্ধী ও বান্ধবগণকে দিক্‌সমুদয়ের, মাতা ও মাতুলকে পৃথিবীর এবং বৃদ্ধ, বালক, পীড়িত ও ক্ষীণ ব্যক্তিদিগকে আকাশের অধীশ্বর বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। অতএব গৃহস্থগণ আচাৰ্য্যাদির উপাসনা করিলেই অনায়াসে ব্রহ্মলোকাদি জয় করিতে পারেন।

‘জ্যেষ্ঠভ্রাতা পিতার তুল্য, ভার্য্যা ও পুত্র স্বীয় দেহস্বরূপ, ভৃত্যবর্গ ছায়াস্বরূপ এবং দুহিতা অনুগ্রহের ভাজন। জিতক্লম, ধৰ্ম্মশীল, গৃহধৰ্ম্মনিরত, বিদ্বান্ ব্যক্তিরা জ্যেষ্ঠ সহোদরাদিকর্ত্তৃক তিরস্কৃত হইয়াও অকাতরে উহা সহ্য করিবেন। কলাকাঙ্ক্ষী হইয়া কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হওয়া ধৰ্ম্মপরায়ণ গৃহীদিগের কর্ত্তব্য নহে। যেমন ব্রহ্মচর্য্য অপেক্ষা গাৰ্হস্থ্য, গার্হস্থ্য অপেক্ষা বানপ্রস্থ, বানপ্রস্থ অপেক্ষা ভৈক্ষ্য [সন্ন্যাস] শ্রেষ্ঠ, তদ্রূপ গৃহীদিগের ধান্যসঞ্চয় অপেক্ষা অসঞ্চয় ও অসঞ্চয় অপেক্ষা কপোতবৃত্তি [পায়রার বৃত্তিসঞ্চয়শূন্যতা, যে দিন যাহা পাওয়া যায়, সেই দিন তাহা খাওয়া] উৎকৃষ্ট। গৃহস্থ ব্যক্তির শাস্ত্রোক্ত নিয়মসমুদয় প্রতিপালন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। বর্ষোপযুক্ত [এক বৎসরের উপযোগী] ধান্যসংগ্রহকারী, কপোতবৃত্তিসমাশ্রিত ও উঞ্ছবৃত্তিপরায়ণ গৃহস্থগণ যে রাজ্যে সকৃত হইয়া অবস্থান করেন, সেই রাজ্য উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠে। যাঁহারা অব্যথিতচিত্তে [বেদনাবিহীন হৃদয়ে] এই প্রকারে গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম প্রতিপালন করিতে পারেন, তাঁহারা সম্রাটদিগের গতি লাভ করিতে সমর্থ হয়েন এবং তাঁহাদের ঊর্দ্ধতন দশ ও অধস্তন দশপুরুষ পরম পবিত্র হইয়া থাকেন। জিতেন্দ্রিয় উদারস্বভাব গৃহস্থগণের নিমিত্ত বিমানসংযুক্ত পরম রমণীয় স্বর্গলোক নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। মনুষ্য বিধিনির্দ্দিষ্ট ব্রহ্মচর্য্য অতিক্রম করিয়া গার্হস্থ্যবৃত্তি আশ্ৰয় করিলে স্বর্গসুখ অনুভব করিতে পারে। এই গার্হস্থ্য আশ্রমের পর লোকের তৃতীয় আশ্রম বানপ্রস্থ আশ্রয় করা উচিত। এক্ষণে সেই আশ্রমের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি তোমার নিকট মনীষিনির্দ্দিষ্ট গৃহস্থধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে গার্হস্থ্যব্রতরহিত পবিত্ৰদেশবাসী, সদসদ্বিবেচক, সর্ব্বাশ্ৰমাচারসম্পন্ন বানপ্রস্থীদিগের ধর্ম্ম নির্দ্দেশ করিতেছি, শ্রবণ কর।”