২২০. ইন্দ্রিয়সংযমের উৎকর্ষে সিদ্ধিলাভ

২২০তম অধ্যায়

ইন্দ্রিয়সংযমের উৎকর্ষে সিদ্ধিলাভ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মনুষ্য কি কাৰ্য্য করিলে সুখ ও কি কাৰ্য্য করিলে দুঃখপ্রাপ্ত হয় এবং কি কাৰ্য্য করিলেই বা সিদ্ধিলাভ করিয়া নির্ভয়ে কালহরণ করিতে পারে, তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! শ্রুতিপরায়ণ বৃদ্ধেরা দমগুণেরই প্রশংসা করিয়া থাকেন। দমগুণ আশ্রয় করা সর্ব্ববর্ণের বিশেষতঃ ব্রাহ্মণের অবশ্য কর্ত্তব্য। লোকে দমগুণান্বিত না হইলে বিধিপূর্ব্বক ক্রিয়া সিদ্ধ করিতে সমর্থ হয় না। ক্রিয়া, তপস্যা ও সত্য সমুদয়ই দমগুণে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। দমগুণদ্বারা লোকের তেজ পরিবর্দ্ধিত হয়। পণ্ডিতেরা ঐ গুণকে পরমপবিত্র বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। দমগুণসম্পন্ন ব্যক্তি পাপবিহীন, নির্ভয় ও উৎকৃষ্ট ফললাভে সমর্থ হয়েন। দান্ত [ইন্দ্রিয়জয়ী] ব্যক্তি নিদ্রিত হউন বা জাগরিত থাকুন, সকল সময়েই সুখানুভব করিতে পারেন এবং তাঁহার মন সৰ্ব্বদা প্রসন্ন থাকে। দান্ত ব্যক্তি দমগুণদ্বারা স্বীয় তেজের বেগ সংবরণ করিতে পারেন, কিন্তু অদান্ত ব্যক্তি উহাতে অসমর্থ হইয়া কামাদি-রিপুগণের বশীভূত হয়। প্রাণীগণ ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তুসমুদয়ের ন্যায় অদান্ত ব্যক্তিগণ হইতে সতত ভীত হইয়া থাকে। এই নিমিত্তই বিধাতা সেই দুর্দান্তদিগের দমনার্থ রাজার সৃষ্টি করিয়াছেন। সমুদয় আশ্রমবাসীর পক্ষে দমগুণ শ্রেয়স্কর। অন্যান্য সমুদয় আশ্রমধর্ম্মদ্বারা যে ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়, দমগুণদ্বারা তদপেক্ষা সমধিক ফললাভ হইয়া থাকে। অদীনতা বিষয়ে অভিনিবেশ, সন্তোষ, শ্রদ্ধা, অক্রোধ, সরলতা, অতিবাদ পরিত্যাগ, অনভিমানিতা, গুরুপূজা, অনসূয়া, প্রাণীগণের প্রতি দয়া, অকপটতা এবং রাজাদির বৃত্তান্তকীৰ্ত্তন, স্তুতি, নিন্দা ও মিথ্যাবাক্য পরিত্যাগ এই সমস্ত গুণ দমগুণ হইতে উৎপন্ন হয়। দান্ত ব্যক্তিরা মোক্ষাথী হইয়া পূর্ব্বতন অদৃষ্টজনিত উপস্থিত সুখ ভোগ করিবেন; ভাবী সুখদুঃখ চিন্তা করিয়া হৃষ্ট বা দুঃখিত হইবেন না। বৈরবিবর্জ্জিত [শত্রুতাচরণে বিমুখ], শঠতাবিহীন, সচ্চরিত্র, বিশুদ্ধচিত্ত, ধৃতিমা, জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরাই ইহলোকে সৎকারলাভ ও পরলোকে স্বৰ্গভোগ করিয়া থাকেন। যাঁহারা দুঃখের সময় প্রাণীগণকে অন্নাদি দান করেন, তাঁহারা পরমসুখে কালযাপনে সমর্থ হয়েন। যে ব্যক্তি প্রাণীগণের হিতানুষ্ঠানে নিরত হয়েন ও দ্বেষভাব পরিত্যাগ করেন, সেই ব্যক্তি অবিচলিত মহাহ্রদের ন্যায় প্রসন্নভাবে অবস্থান করেন। যাহা হইতে কোন প্রাণী ভীত না হয়, কোন প্রাণী হইতেই তাহার কোন ভয় নাই; এই জ্ঞান সৰ্ব্বভূতপূজনীয় দান্ত ব্যক্তিরই হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি প্রভূত অর্থলাভ করিয়াও পরিতুষ্ট এবং অতিশয় বিপন্ন হইয়াও অনুতাপিত না হয়েন, তাঁহাকেই পরিমিতপ্রজ্ঞ [পরিপক্বজ্ঞান] দান্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। বিদ্যাসম্পন্ন দমগুণান্বিত ব্যক্তি সাধুগণাচরিত শুভকাৰ্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া তাহার মহৎ ফল ভোগ করিয়া থাকেন। দুরাত্মারা অনসূয়া, ক্ষমা, শান্তি, সন্তোষ, প্রিয়বাদিতা, সত্য, দান ও অনায়াস এই সমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কাম, ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা ও গর্ব্ব আশ্রয় করিয়া থাকে। ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মচারী, জিতেন্দ্রিয় ও ব্রতপরায়ণ হইয়া কাম-ক্রোধ পরিত্যাগ ও কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক দেহাভিমানশূন্য হইয়াও কাল প্রতীক্ষায় দেহাভিমানীর ন্যায় সমুদয় লোকে বিচরণ করিয়া থাকেন।”