২১২. গুণপ্রবাহে ভাসমান জীব

২১২তম অধ্যায়

গুণপ্রবাহে ভাসমান জীব

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! কৰ্ম্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরা যেমন কৰ্ম্মানুষ্ঠানই প্রধান বলিয়া উহা আশ্রয় করেন, তদ্রূপ বিজ্ঞাননিষ্ঠ মহাত্মারা বিজ্ঞানতত্ত্বই অবলম্বন করিয়া থাকেন। বিজ্ঞান ভিন্ন, আর কিছুতেই তাহাদের প্রবৃত্তি থাকে না। বেদোক্ত কার্য্যে অনুরক্ত বেদবিদ দুর্ল্লভ পুরুষেরাই স্বীয় মহানুভবতা নিবন্ধন মোক্ষমার্গ আশ্রয় করিতে ইচ্ছা করেন। কর্ম্মত্যাগ সাধু ব্যক্তিদিগের আচরিত বলিয়াই জনসমাজে প্রশংসনীয় হইয়াছে। নিবৃত্তাত্মিকা বুদ্ধিদ্বারাই মোক্ষলাভে সমর্থ হওয়া যায়। দেহাভিমানসম্পন্ন ক্রোধলোভ পরতন্ত্র মূঢ় ব্যক্তিরা রাজস ও তামসগুণে আক্রান্ত হইয়া সংসারে অনুরক্ত হয়; অতএব মোক্ষার্থী পুরুষ কাৰ্য্যদ্বারা আত্মজ্ঞানের দ্বার প্রস্তুত করিবেন, কিন্তু কৰ্ম্মফলভূত স্বর্গাদিলাভের বাসনা কখনই করিবেন না। লৌহমিশ্রিত সুবর্ণের ন্যায় রাগাদি দোষদূষিত বিজ্ঞান ভদ্রসমাজে হেয় বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি কাম, ক্রোধ ও লোভের অনুবর্তী হইয়া ধৰ্ম্মপথ উল্লঙ্ঘনপূর্ব্বক অধর্ম্মাচরণ করে, তাহাকে নিশ্চয়ই বিপন্ন ও বিনাশ প্রাপ্ত হইতে হয়; অতএব রাগাধিক্যবশতঃ শব্দাদি বিষয়ের অনুসরণ করা কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। যে ব্যক্তি উহার অনুগমন করে, তাহাকে ক্রোধ, হর্ষ ও বিপদে আক্রান্ত হইতে হয়। যখন সকল লোকের দেহই পঞ্চভূতাত্মক এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণবিশিষ্ট, তখন অন্যকে স্তুতি বা নিন্দা করা নিতান্ত নিষ্ফল। মূঢ়েরাই অজ্ঞানতানিবন্ধন স্পর্শ, রূপ ও রসাদি বিষয়ে আসক্ত হয়। উহারা আপনাদের দেহকে পার্থিব বলিয়া জ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। মৃন্ময় গৃহ যেমন মৃত্তিকাদ্বারা লেপিত হয়, তদ্রূপ এই মৃন্ময় দেহ ও মৃত্তিকার দ্বারা পুষ্ট হইয়া থাকে। মধু, তৈল, দুগ্ধ, ঘৃত, মাংস, লবণ, গুড়, ধান্য ও ফলমূলাদিসমুদয় দ্রব্য সলিল ও মৃত্তিকা হইতে উৎপন্ন হয়।

“অরণ্যবাসী সন্ন্যাসীরা যেমন মিষ্টান্নাদি-ভোজনের ঔৎসুক্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক শরীররক্ষাৰ্থ অতি সামান্য অন্ন ভোজন করিয়া থাকেন, তদ্রূপ গৃহীদিগেরও জীবনরক্ষাৰ্থ পীড়িত ব্যক্তির ঔষধসেবনের ন্যায় যৎসামান্য আহার করা কর্ত্তব্য। উদারচিত্ত পুরুষেরা সত্যবাদিতা, বাহ্য ও আন্তরিক শৌচ, সরলতা, বৈরাগ্য অধ্যয়নাদিজনিত তেজ, বিক্রম, ক্ষমা, ধৈৰ্য্য, বুদ্ধি, মান ও তপস্যাপ্রভাবে বিষয়াত্মক ভাব সমুদয় পর্য্যবেক্ষণপূর্ব্বক শান্তিলাভের ইচ্ছা করিয়া ইন্দ্রিয় দমন করিবেন। প্রাণীগণ স্ব স্ব অনভিজ্ঞতাদোষেই সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণে মোহিত হইয়া ইহলোকে চক্রের ন্যায় বারংবার পরিভ্রমণ করে। অতএব অজ্ঞানসম্ভূত দোষসমুদয় সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষা করিয়া অজ্ঞানজনিত অহঙ্কার পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। মহাভূত, ইন্দ্রিয়, সত্ত্বাদি গুণত্রয় এবং ঈশ্বরসমন্বিত ত্রিভুবন ও কর্ম্মসমুদয়ই অহঙ্কারকল্পিত। কাল যেমন যত্নশীল হইয়া ইহলোকে ঋতুসমুদয়ের গুণ প্রদর্শন করে, তদ্রূপ অহঙ্কার প্রাণীগণের কৰ্ম্ম উৎপন্ন করিয়া দেয়। অন্ধকারসদৃশ মোহাত্মক তমোগুণ অজ্ঞান হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে। সত্ত্বাদি গুণত্রয়েই লোকের সুখদুঃখ নিবদ্ধ রহিয়াছে। ঐ গুণত্রয় হইতে যে সমস্ত গুণ উৎপন্ন হয়, কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রীতি, অসন্দেহ, ধৃতি ও স্মৃতি সত্ত্বগুণ হইতে; কাম, ক্রোধ, প্রমাদ, লোভ, মোহ, ভয় ও আয়াস রজোগুণ হইতে এবং বিষাদ, শোক, মান, দর্প ও অনাৰ্য্যতা তমোগুণ হইতে সমুদ্ভূত হইয়া থাকে। মনুষ্য প্রতিনিয়ত এই সমুদয় আত্মস্থিত দোষের প্রত্যেকের গৌরব ও লাঘব পরীক্ষা করিবে।”

মুক্তিকামীর গুণত্যাগ—উপদেশ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মুমুক্ষু ব্যক্তিরা কি কি দোষ পরিত্যাগ ও কি কি দোষ শিথিল করেন? কোন্ কোন্ দোষ অপরিহার্য্য, কোন্ কোন্ দোষকে মোহবশতঃ দুর্ব্বল বলিয়া বোধ হয় এবং পণ্ডিতেরা বুদ্ধি ও হেতুদ্বারা কোন্ কোন্ দোষের বলাবল বিবেচনা করেন, এই সমস্ত বিষয়ে আমার নিকট ঐ সমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি দোষসমুদয়ের মূলচ্ছেদন করিয়া মুক্তিলাভ করেন। লৌহময় কুঠার যেমন লৌহ হইতে উৎপন্ন নিগড়কে [শিকলকে] বিনষ্ট করিয়া স্বয়ং ভগ্ন হয়, তদ্রূপ ধ্যানসংস্কৃতবুদ্ধি মহাত্মারা রজোগুণসম্ভূত স্বাভাবিক। দোষসমুদয়ের বিনাশপূৰ্ব্বক শান্তি লাভ করিয়া থাকেন। গুণত্রয় দেহপ্রাপ্তির বীজস্বরূপ, কিন্তু জিতচিত্ত ব্যক্তির সত্ত্বগুণই ব্রহ্মলাভের একমাত্র উপায়। অতএব আত্মজ্ঞানবিশিষ্ট ব্যক্তির রজঃ ও তমোগুণ পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। মনুষ্যের রজঃ ও তমোগুণ তিরোহিত হইলে সত্ত্বগুণ সমধিক নিৰ্ম্মল হইয়া উঠে। কেহ কেহ চিত্তশুদ্ধির নিদানভূত মন্ত্রযুক্ত যজ্ঞাদি কাৰ্য্যকে দুষ্কৃত বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন, কিন্তু বস্তুতঃ কার্য্য বৈরাগ্য উৎপাদন ও শমগুণাদিরক্ষার নিদান। রজোগুণপ্রভাবে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামাত্মক কাৰ্য্যসমুদয়ের ফললাভ হয়। হিংসাবিহারপরতন্ত্র আলস্য ও নিদ্ৰাপরায়ণ অনভিজ্ঞ লোকেরাই তমোগুণপ্রভাবে লোভ ও ক্রোধযুক্ত কার্য্যের ফলভোগ করে। ধর্ম্মশাস্ত্রবিশারদ নিষ্পাপ ব্যক্তিরা সত্ত্বগুণাবলম্বনপূৰ্ব্বক বিশুদ্ধ সাত্ত্বিকভাব অনুভব করিতে সমর্থ হয়েন।”