২১০. মুক্তিবিবরণ—গুরুশিষ্যসংবাদ

২১০তম অধ্যায়

মুক্তিবিবরণ—গুরুশিষ্যসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে পিতামহ! আপনি এক্ষণে উৎকৃষ্ট মোক্ষলাভের নিদান যোগের বিষয় কীৰ্ত্তন করুন, উহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত অভিলাষ হইতেছে।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই স্থলে গুরুশিষ্যসংবাদ নামক মুক্তিবিষয়ক এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, শ্রবণ কর। একদা এক মেধাবী শিষ্য মঙ্গললাভার্থী হইয়া তেজঃপুঞ্জকলেবর [ঘনতেজোযুক্ত দেহ] সত্যপ্রতিজ্ঞ জিতেন্দ্রিয় আচার্য্যের চরণবন্দনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, ‘গুরো! যদি আপনি আমার শুশ্রূষায় প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার যে সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, তাহা অপনোদন করুন। আমার ও আপনার সৃষ্টিকর্ত্তা কে? সকল লোকের শরীরনির্ম্মাণোপযোগী উপাদানসকল একরূপ হইলেও কি নিমিত্ত একজনের উন্নতি ও অন্যের অবনতি হইয়া থাকে, আপনি এই দুই বিষয় এবং বেদমধ্যে লৌকিক ও বর্ণাশ্রমসাধারণ যে বাক্য বিন্যস্ত আছে, তাহার বিষয় কীৰ্ত্তন করুন।

“আচার্য্য কহিলেন, ‘বৎস! যাহা বেচতূষ্টয়েরও গুহ্য এবং সকল শাস্ত্রের সার সেই অধ্যাত্মযোগ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বাসুদেব বিশ্বসংসার ও বেদের আদি। বেদবিৎ পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন যে, ঐ বিশ্বব্যাপী সনাতন পুরুষ সত্য, জ্ঞান, তিতিক্ষা, যজ্ঞ ও ঋতুতাস্বরূপ। তাহা হইতে এই জগতের সৃষ্টি স্থিতি-প্রলয় হইয়া থাকে। তিনিই অব্যক্ত শাশ্বত ব্ৰহ্ম। ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণকে, ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়কে, বৈশ্য বৈশ্যকে ও শূদ্র শূদ্রকে বাসুদেবের মাহাত্ম্য শ্রবণ করাইবেন, সুতরাং তুমি আমার নিকট ঐ মাহাত্ম শ্রবণ করিবার উপযুক্ত পাত্র। এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, অবিহিতচিত্তে তাহা শ্রবণ কর।

বিষ্ণুর বিশ্বরক্ষাব্যবস্থা

বাসুদেব সাক্ষাৎ কালচক্র, অনাদি ও অনন্ত। এই ত্রৈলোক্য তাঁহাতেই চক্রের ন্যায় পরিবর্তিত হইতেছে। লোকে তাঁহাকেই অবিনাশী, অব্যক্ত ও নিত্য বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। সেই মহাত্মা হইতেই পিতৃগণ, দেব, ঋষি, যক্ষ, রাক্ষস, নাগ, অসুর ও মনুষ্যগণের সৃষ্টি হইতেছে। উনিই যুগপ্রারম্ভে [সত্যাদি যুগের আরম্ভে] বেদশাস্ত্র, শাশ্বত লোকধৰ্ম্ম ও প্রকৃতির সৃষ্টি করিয়া থাকেন। যেমন বসন্তাদি ঋতুকালে বৃক্ষসকল পৰ্য্যায়ক্রমে পুষ্পিত হয়, সেইরূপ প্রতিকল্পে [বিশেষ সময়ে—যে সময়ে কোন বিশেষ পরিবর্ত্তনে বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হয়] ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্ত্তৃত্বে [সৃষ্টি, পালন ও সংহার-কার্য্যের জন্য], আবির্ভূত হইয়া থাকেন। যুগপ্রারম্ভে কালযোগে যেসমস্ত বস্তু প্রাদুর্ভূত হয়, সেই সেই বস্তুতেই লোকযাত্রাবিধানজ জ্ঞান [সংসারযাত্রাবিধান হইতে জাত—বস্তুর ব্যবহারে অভিজ্ঞতা] উৎপন্ন হইয়া থাকে।

‘মহর্ষিগণ ভগবান্ স্বয়ম্ভূর আদেশানুসারে যুগান্তকালে অন্তর্হিত [প্রলয়কালে নষ্ট] বেদ ও ইতিহাসসকল তপোবলে লাভ করিয়াছিলেন। ভগবান্ ব্রহ্মা বেদ [ঋক, সাম, যজু, অথৰ্ব্ব], বৃহস্পতি বেদাঙ্গ [শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরূক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ], শুক্রাচার্য্য জগতের হিতজনক নীতিশাস্ত্র, দেবর্ষি নারদ সঙ্গীতশাস্ত্র, ভরদ্বাজ ধনুর্ব্বিদ্যা, গার্গ্য দেবর্ষিগণের চরিত্র, কৃষ্ণাত্রেয় চিকিৎসাশাস্ত্র এবং অন্যান্য মহর্ষি ন্যায় ও তন্ত্র অবগত হইয়াছিলেন। এই সমস্ত মহর্ষিরা যুক্তি, বেদ ও প্রত্যক্ষ প্রমাণদ্বারা যে ব্রহ্ম নিরূপিত করিয়াছেন, তাঁহারই উপাসনা কর। দেবতা ও ঋষিগণ সেই অনাদি সূক্ষ্মস্বরূপ ব্রহ্মকে নিরূপণ করিতে সমর্থ হয়েন নাই। একমাত্র লোকবিধাতা ভগবান নারায়ণই তাঁহাকে বিদিত ছিলেন। পরে নারায়ণ হইতেই মহর্ষি ও সুরগণ এবং পূর্ব্বতন রাজর্ষিসকল সেই দুঃখনাশের ঔষধস্বরূপ ব্রহ্মকে অবগত হইয়াছিলেন।

জীবাত্মা–প্রকৃতি-পুরুষসম্বন্ধ

‘প্রকৃতি পুরুষকর্ত্তৃক আলোচিত ভাবসমুদয় প্রকাশ করিয়া থাকে। প্রকৃতি হইতেই ধৰ্ম্মাধর্ম্মযুক্ত সমস্ত জগৎ প্রসূত হইয়াছে। যেমন একটি দীপ হইতে অসংখ্য দীপ প্রজ্বালিত হয়, সেইরূপ একমাত্র প্রকৃতি হইতে সমুদয় পদার্থ উৎপন্ন হইতেছে। অনন্তর নিবন্ধন প্রকৃতির নাশ হইতেছে না। সূক্ষ্মস্বরূপ ঈশ্বর হইতে কৰ্ম্মজ বুদ্ধি, ঐ বুদ্ধি হইতে অহঙ্কার, অহঙ্কার হইতে আকাশ, আকাশ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে তেজ, তেজ হইতে জল ও জল হইতে পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে। এই অহঙ্কার প্রভৃতি আটটি পদার্থ সকলের মূলপ্রকৃতি; জগৎ এই সমস্ত পদার্থেই অবস্থিত রহিয়াছে। ঐ আট প্রকৃতি হইতে পাঁচ জ্ঞানেপ্রিয়, পাঁচ কৰ্ম্মেন্দ্রিয়, পাঁচ বিষয় ও মন উৎপন্ন হইয়াছে। শ্রোত্র, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও ঘ্রাণ এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়। পাদ, পায়ু, উপস্থ, হস্ত ও বাক্য এই পাঁচটি কৰ্ম্মেন্দ্রিয়। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পাঁচটি বিষয়। এই সমস্ত ইন্দ্রিয় ও বিষয়ে মন ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে। মনই জিহ্বার দ্বারা আস্বাদন ও বাগিন্দ্রিয়দ্বারা, শব্দ প্রয়োগ করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয়যুক্ত মনই বুদ্ধাদি আন্তরিক, আকাশাদি বাহ্য ও মন্বাদি ব্যক্ত পদার্থমধ্যে পরিগণিত হয়। এই ষোড়শ ইন্দ্রিয় দেবতাত্মক। ইহারা দেহমধ্যে, দেহের সৃষ্টিকর্ত্তা জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মার উপাসনা করিতেছে। রস সলিলের, গন্ধ পৃথিবীর, শ্রোত্র আকাশের, চক্ষু তেজের, স্পর্শ বায়ুর, মন সত্ত্বের ও সত্ত্ব প্রধানের [প্রকৃতির] গুণ বলিয়া অভিহিত হয়। সত্ত্ব সৰ্ব্বভূতের আত্মভূত ঈশ্বরে অবস্থান করিতেছে। এই সত্ত্বাদি ভাবসমুদয় প্রকৃতির পরবর্তী প্রবৃত্তিশূন্য ঈশ্বরকে আশ্রয় করিয়া স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগতের কাৰ্য্য নির্ব্বাহ করিতেছে।

মহান্ আত্মা নবদ্বার[চক্ষুর ২, নাসিকার ২, কর্ণের ২, মুখ ১, গুহ্য ১, লিঙ্গ]সম্পন্ন সত্ত্বাদিভাবপরিপূর্ণ অতিপবিত্র দেহরূপ পুর আশ্রয় করিয়া শয়ান রহিয়াছেন; এই নিমিত্ত উঁহাকে পুরুষ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। তিনি অজর [বাৰ্দ্ধকাদি অবস্থাবর্জ্জিত] ও অমর; তিনি ব্যক্ত ও অব্যক্তরূপে উপদেশ প্রদান করিতেছেন; তিনি সৰ্ব্বব্যাপী, গুণসম্পন্ন ও সূক্ষ্ম এবং তিনিই সকল প্রাণীর গুণকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছেন। প্রদীপ যেমন হ্রস্ব বা দীর্ঘই হউক, সমস্ত বস্তু প্রকাশ করে, সেইরূপ পুরুষ উপাধিভেদে মহৎই হউন আর হীনই হউন, সকল প্রাণীতেই জ্ঞানস্বরূপে অবস্থান করিয়া বস্তুসকল উদ্ভাবন করিতেছেন। তিনি শ্রোত্র ও নেত্রকে আপনার জ্ঞাতব্য বিষয়ে প্রবর্তিত করিয়া স্বয়ংই শ্রবণ ও দর্শন করিতেছেন। এই দেহই তাঁহার শব্দাদি বিষয়লাভের কারণ। কিন্তু তিনি সকল কার্য্যের কর্ত্তা। কাষ্ঠ ভেদ করিলে সেই কাষ্ঠগত বহ্নি যেমন পরিদৃশ্যমান হয় না, সেইরূপ শরীরচ্ছেদন করিলে উহাতে আত্মদর্শনলাভ হইবার সম্ভাবনা নাই। আর কৌশলক্রমে কাষ্ঠ ঘর্ষণ করিলে যেরূপ তন্মধ্যস্থিত অগ্নি নিষ্কাশিত ও নিরীক্ষিত হয়, সেইরূপ যোগবল আশ্রয় করিলেই দেহমধ্যস্থ আত্মাকে প্রত্যক্ষ করা যাইতে পারে। দেহের অনন্তরনিবন্ধন আত্মার দেহসম্বন্ধ নিরন্তর নিবদ্ধই [দৃঢ়রূপে ব্যাপ্ত] রহিয়াছে। যোগ ব্যতিরেকে উহার দেহসম্বন্ধচ্ছেদনের উপায়ান্তর নাই। লোকের স্বপ্নযোগে যেমন তাহার আত্মা দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ইন্দ্রিয়সম্পন্ন হইয়া অন্যত্র গমন করে, তদ্রূপ তাহার মরণান্তেও তাহার দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্য দেহকে আশ্রয় করে। আত্মা স্বকৃত কৰ্ম্মবলেই পূৰ্ব্বশরীর পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয় না; আবার স্বকৰ্ম্ম প্রভাবেই অন্য শরীরে আবির্ভূত হইয়া থাকে। সেই আত্মা যেরূপে এক দেহ পরিত্যাগ করিয়া অন্য দেহে গমন করে, তাহা পরে কীৰ্ত্তন করিতেছি।’ ”