২০৪. ইন্দ্রিয়প্রভাব—বাসনাবশে জীবের পুনঃ পুনঃ জন্ম

২০৪তম অধ্যায়

ইন্দ্রিয়প্রভাব—বাসনাবশে জীবের পুনঃ পুনঃ জন্ম

“মনু কহিলেন, ‘হে মহাত্মন্! লোকের স্বপ্নাবস্থায় যেমন তাহার স্থূলদেহ শয্যায় নিপতিত থাকে ও লিঙ্গশরীর [কৰ্ম্মানুসারে গঠিত জীবদেহ] উহা হইতে পৃথক হইয়া সুখদুঃখ ভোগ করে, তদ্রূপ কৰ্মশীল ব্যক্তি নিহত হইলে তাহার স্থূলশরীর ধরাসাৎ হয় ও লিঙ্গশরীর পাপপুণ্যের ফলভোগ করিয়া থাকে। আর যেমন লোকে সুষুপ্তি প্রাপ্ত হইলে তাহার জ্ঞানমাত্র লিঙ্গশরীর হইতে পৃথগ্‌ভূত হয়, তদ্রূপ কৰ্ম্মত্যাগী ব্যক্তির নিধন হইলেও তাহার জ্ঞানমাত্র লিঙ্গশরীর হইতে বহির্গত হইয়া ব্রহ্মানন্দ অনুভব করে। নিৰ্ম্মল জলে যেমন প্রতিবিম্ব নয়নগোচর হয়, তদ্রূপ ইন্দ্রিয়সকল প্রসন্ন হইলে তদ্দ্বারা আত্মার সাক্ষাৎকারলাভ হইয়া থাকে; কিন্তু সলিল কলুষিত হইলে যেমন প্রতিমূর্তি সন্দর্শন করা যায় না, তদ্রূপ ইন্দ্রিয়গ্রাম আকুলিত [চঞ্চল্য] হইলে তদ্দ্বারা আত্মজ্ঞানলাভের সম্ভাবনা নাই। অজ্ঞানপ্রভাবে অবুদ্ধির উৎপত্তি হয়, অবুদ্ধিপ্রভাবে চিত্ত দূষিত হইয়া যায় এবং চিত্ত দূষিত হইলেই শ্ৰোত্রাদি পাঁচ ইন্দ্রিয়ও দূষিত হইয়া ওঠে। মোহান্ধ ব্যক্তি বিষয়ে একান্ত অনুরক্ত হইয়া কোনরূপেই তৃপ্তিলাভ করিতে সমর্থ হয় না। জীবগণ কেবল স্বীয় স্বীয় ধর্ম্ম ও অধৰ্ম্ম অনুষ্ঠাননিবন্ধন বিষয়বাসনা চরিতার্থ করিবার জন্য পুনঃ পুনঃ জন্মপরিগ্রহ করে। পাপসত্ত্বে কখনই বিষয়পিপাসার শান্তি হয় না; যখন পাপের নাশ হয়, তখনই বিষয়তৃষ্ণা তিরোহিত হইয়া থাকে। নিরত বিষয়-সংসর্গ করিলে উত্তরোত্তর আশার বৃদ্ধিই হইয়া থাকে; কখনই মোক্ষলাভ হয় না। পাপের ধ্বংস হইলেই লোকের জ্ঞান সমুৎপন্ন হয়, তখন সুনির্ম্মল আদর্শে যেমন প্রতিবিম্ব দর্শন করা যায়, তদ্রূপ সে স্বীয় বুদ্ধিতে আত্মদর্শন করিতে পারে। ইন্দ্রিয়সমুদয় বিষয়লিপ্ত হইলেই দুঃখে এবং সংযত হইলে সুখে কালযাপন করিতে পারা যায়; অতএব ইন্দ্রিয়নিগ্রহ করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। ইন্দ্রিয় হইতে মন, মন হইতে বুদ্ধি, বুদ্ধি হইতে জীবাত্মা এবং জীবাত্মা হইতে পরমাত্মা শ্রেষ্ঠ। পরমাত্মা হইতে জীবাত্মা, জীবাত্মা হইতে বুদ্ধি এবং বুদ্ধি হইতে মনের উৎপত্তি হইয়াছে। মন শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সংযুক্ত হইলেই শব্দাদি বিষয়ে বিলিপ্ত হয়। যে ব্যক্তি সেই শব্দাদি বিষয় ও স্থূল কারণসমুদয় পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই অমৃতের রসাস্বাদনে সমর্থ হয়েন। দিবাকর যেমন সমুদিত হইয়া স্বীয় কিরণজাল বিস্তারপূৰ্ব্বক পুনৰ্ব্বার তৎসমুদয় প্রতিসংহার করিয়া অস্তগমন করেন, তদ্রূপ অন্তরাত্মা ইন্দ্রিয়গণের কাৰ্য্য সম্পাদনপূৰ্ব্বক পুনরায় উহাদিগকে সঙ্কুচিত করিয়া দেহ হইতে অন্তরিত হয়েন। মানবগণ বার বার স্বীয় কৰ্ম্মানুরূপ গতি প্রাপ্ত হইয়া পুণ্য ও পাপপ্রবৃত্তির অনুসারে সুখদুঃখ ভোগ করে। বিষয়ভোগ পরিত্যাগ করিলে বিষয়বাসনা এককালে দূরীভূত হইয়া যায়; আর যখন আত্মার সহিত সাক্ষাৎকার হয়, তখন বাসনাত্মক রস পৰ্য্যন্ত তিরোহিত হইয়া থাকে। বুদ্ধি বিষয়সংসর্গ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মনের সহিত মিলিত হইলেই লোকের ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে। ব্রহ্ম শ্রবণ, দর্শন, স্পর্শন, আঘ্রাণ, আস্বাদন ও অনুমানের অগোচর। বুদ্ধি কেবল সেই উৎকৃষ্ট পদার্থে প্রবেশ করিতে পারে। ঘটাদি স্থলপদার্থ যেমন মনঃকল্পিত বলিয়া মনোমধ্যে লীন থাকে, তদ্রূপ মন বুদ্ধিতে, বুদ্ধি জীবাত্মাতে এবং জীবাত্মা ব্রহ্মে লীন হয়। ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি ইহারা কেহই স্ব স্ব কারণ অবগত হইতে সমর্থ নহে; কিন্তু সূক্ষ্মস্বরূপ জ্ঞানময় আত্মা উহাদের সকলকেই সন্দর্শন করিতেছেন।”