২০৯. কৃষ্ণের প্রভাব—অসুরবধে শান্তিস্থাপন

২০৯তম অধ্যায়

কৃষ্ণের প্রভাব—অসুরবধে শান্তিস্থাপন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আমি অবিনাশী সৰ্বেশ্বর বাসুদেবের অলৌকিক তেজ, পূর্ব্বাচরিত কাৰ্য্য এবং কি নিমিত্তই বা তির্য্যগযোনিতে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন, তৎসমুদয় শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি, আপনি ঐ সমস্ত আনুপূর্বিক কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! পূর্ব্বে আমি একদা মৃগয়াপর্য্যটন করিতে করিতে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়ের আশ্রমে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলাম যে, তথায় অসংখ্য মুনিগণ নিষণ্ন [উপবিষ্ট] রহিয়াছেন। আমি তাঁহাদের সমীপে উপস্থিত হইবামাত্র তাঁহারা মধুপর্কদ্বারা আমার অর্চ্চনা করিলেন; আমিও তাঁহাদিগের প্রদত্ত পূজা প্রতিগ্ৰহ করিয়া তাঁহাদিগকে অভিনন্দন করিলাম। সেই সময় মহর্ষি কশ্যপ আমার নিকট যে মনোহর কথা কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, আমি কহিতেছি, অনন্যমনে শ্রবণ কর।

“পূৰ্ব্বকালে ক্রোবোদ্ধত লোভপরায়ণ বলমদমত্ত [বলমদে মত্ত] নরক প্রভৃতি মহাসুরগণ দেবগণের সুখসমৃদ্ধি সহ্য করিতে না পারিয়া তাঁহাদিগের উপর উপদ্রব করিতে আরম্ভ করিল। দেব ও দেবর্ষিগণ তাঁহাদিগের উপদ্রবে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া অসুস্থচিত্তে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিলেন এবং দেখিলেন যে, বসুন্ধরা নিতান্ত দুঃখিতমনে রসাতলে গমন করিতেছেন। পৃথিবীর দুর্দ্দশা দর্শনে তাঁহাদিগের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তাঁহারা নিতান্ত ভীত হইয়া প্রজাপতি ব্রহ্মার নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘ভগবন্! দানবগণ আমাদের উপর যারপরনাই দৌরাত্ম্য করিতেছে, আমরা কি প্রকারে তাহাদের উপদ্রব সহ্য করিব?’ ব্রহ্মা কহিলেন, ‘দেবগণ! আমি এই বিপদশান্তির উপায় অবধারণ করিয়াছি; অসুরগণ এক্ষণে দলবদ্ধ হইয়া পাতালতলে বাস করিতেছে। উহারা দেবদত্ত বর [ব্রহ্মাদি দেবগণের প্রদত্ত বর] এবং বলবীৰ্য্য ও অহঙ্কারপ্রভাবে নিতান্ত বিমোহিত হইয়া অব্যক্তদর্শন সুরগণের অধৃষ্য [দেবগণের ভয়জনক] ভগবান্ বিষ্ণু যে বরাহরূপ ধারণ করিয়াছেন, তাহা অবধারণ করিতে সমর্থ হইতেছে না। অতঃপর সেই বরাহই মহাবেগে পাতালতলে গমনপূর্ব্বক ঐ দুরাত্মাদিগের বিনাশসাধন করিবেন। ভগবান্ কমলযোনি এই কথা কহিলে দেবগণ দুঃখের অবসান হইল মনে করিয়া নিতান্ত সন্তুষ্ট হইলেন।

ভগবানের বরাহ অবতার—অসুরবধ

“অনন্তর ভগবান্ বরাহমূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া পাতালতলে প্রবেশপূৰ্ব্বক দানবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। দানবেরা সেই বরাহের অমানুষ বল অবলোকনপূৰ্ব্বক দ্রুতবেগে তাঁহাকে গ্রহণ করিয়া ক্রোধভরে চতুর্দ্দিক্‌ হইতে আকর্ষণ করিতে লাগিল; কিন্তু কিছুতেই তাঁহার কোন অপকার করিতে সমর্থ হইল না। তখন তাহারা নিতান্ত ভীত ও বিস্মিত হইয়া আপনাদিগের প্রাণসংশয় উপস্থিত হইয়াছে বিবেচনা করিতে লাগিল।

“তখন দেবাদিদেব ভগবান্ বরাহ যোগবলে দৈত্যদানবগণকে ক্ষুভিত করিয়া ঘোরতর নিনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার ভীষণ ধ্বনিপ্রভাবে তিনলোক ও দশদিক্‌ অনুনাদিত হইতে লাগিল। ইন্দ্রপ্রভৃতি দেবগণ নিতান্ত ভীত হইলেন। পৃথিবীস্থ যাবতীয় স্থাবরজঙ্গম নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। দানবগণ সেই নিনাদে একান্ত ভীত ও বিষ্ণুতেজে বিমোহিত হইয়া ভূতলে নিপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইতে লাগিল; ভূতাধিপতি মহাযোগী ভগবান্ বরাহ খুরদ্বারা উহাদের মাংস, মেদ ও অস্থি সকল বিদলিত করিতে লাগিলেন। ভগবান্ নারায়ণ ঐরূপে বরাহরূপ ধারণপূৰ্ব্বক ভীষণ নাদ পরিত্যাগ [নাদদ্বারা ভক্তহৃদয়ে অভয়বিস্তার] করিয়াছিলেন বলিয়া উহার নাম সনাতন হইয়াছে। অনন্তর সুরগণ সেই বরাহের নিনাদবণে ভীত হইয়া জগৎপতি ব্রহ্মার নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! ও কি শব্দ হইতেছে? আর কোন্ ব্যক্তিই বা ঐ শব্দ করিতেছে? আমরা কিছুই অবগত হইতে পারিতেছি না; ঐ নিনাদদ্বারা সমস্ত জগৎ ভয়বিহুল হইয়াছে এবং সুর ও অসুরগণ বিমোহিত হইয়াছেন।

“দেবগণ ব্রহ্মার নিকট এইরূপ কহিতেছেন, ইত্যবসরে বরাহরূপী ভগবান বিষ্ণু অসুরসংহার সমাপ্ত করিয়া পাতালতল হইতে উথিত হইলেন। মহর্ষিগণ তাঁহাকে অবলোকনপূর্ব্বক ভক্তিভাবে স্তব করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ভগবান্ ব্রহ্মা সেই বরাহকে দূর হইতে নিরীক্ষণপূর্ব্বক দেবগণকে কহিলেন, ‘ঐ দেখ, মহাকায় মহাবল সৰ্ব্ববিঘ্নবিনাশন ভূতভাবন ভগবান্ কৃষ্ণ অসুরবিনাশরূপ অতি দুষ্কর কার্য্য সংসাধন করিয়া আগমন করিতেছেন। তোমাদের আর কোন শঙ্কা নাই, তোমরা ধৈৰ্য্যাবলম্বন কর। শোক, সন্তাপ ও ভয় করিবার আর কোন আবশ্যকতা নাই। ঐ বরাহরূপী কৃষ্ণই বিধি, প্রভাব ও ক্ষয়কারক কাল। উনি লোকসকলের রক্ষাবিধানার্থ ঘোরতর নিনাদ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। সকল লোকই উঁহাকে নমস্কার করিয়া থাকে। উনি সকলের আদি ও সকলের ঈশ্বর।’ ”