২২৫. ইন্দ্রের প্রতি বলিদেহনির্গতা লক্ষ্মীর উপদেশ

২২৫তম অধ্যায়

ইন্দ্রের প্রতি বলিদেহনির্গতা লক্ষ্মীর উপদেশ

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! দানবরাজ বলি এই কথা কহিবামাত্র রাজলক্ষ্মী স্বীয় উজ্জ্বল রূপ ধারণপূৰ্ব্বক তাঁহার শরীর হইতে নির্গত হইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহাকে অবলোকনপূর্ব্বক বিস্ময়োফুল্ললোচনে বলিকে সম্বোধনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘দানবরাজ! এই যে চূড়া-কেয়ূরধারিণী নারী তোমার দেহ হইতে নিঃসৃত হইয়া স্বীয়, তেজঃপ্রভাবে দেদীপ্যমান হইতেছেন, ইনি কে?’ বলি কহিলেন, ‘দেবরাজ! ইনি দেবী; আসুরী বা মানুষী নহেন। তোমার কিছু জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয়, ইহাকে জিজ্ঞাসা কর।’

“তখন ভগবান পাকশাসন লক্ষ্মীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘আৰ্য্যে! আপনি কে? আর কি নিমিত্তই বা দৈত্যেশ্বরকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমাকে আশ্রয় করিতেছেন? আমি ইহা কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না। আপনি অনুগ্রহ করিয়া উহার বিশেষ বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করুন।’

“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘সুররাজ! পূর্ব্বতন মহারাজ বিরোচন এবং এই বিরোচনপুত্র বলি আমাকে জ্ঞাত হইতে পারে নাই। পণ্ডিতেরা আমাকে দুঃসহা, বিধিৎসা [বিধাত্রী], ভূতি [ঐশ্বৰ্য্য], লক্ষ্মী ও শ্ৰী বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। তুমি ও অন্যান্য দেবগণ তোমরা কেহই আমাকে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ নহে।’

“তখন ইন্দ্র কহিলেন, “আৰ্য্যে! আপনি বহুকাল দৈত্যেশ্বরের শরীরে বাস করিয়াছিলেন, এক্ষণে উঁহার কি দোষ এবং আমার কি গুণ দর্শন করিয়া উঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন, তাহা যথার্থ স্বরূপে কীর্ত্তন করুন।

‘“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবরাজ! ধাতা বা বিধাতা আমাকে এক স্থান হইতে অন্যত্র পরিচালিত করিতে পারেন না; আমি কালপ্রভাবেই এক স্থান হইতে অন্যত্র গমন করিয়া থাকি; অতএব তুমি বলিকে অবজ্ঞা করিও না।’

“ইন্দ্র কহিলেন, ‘আৰ্য্যে! আপনি কি নিমিত্ত দৈত্যেশ্বরকে পরিত্যাগ করিলেন এবং কি নিমিত্তই বা আমাকে পরিত্যাগ করিতেছেন না, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’

লক্ষ্মীমুখে তদীয় অধিষ্ঠানস্থান নির্ণয়

“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবরাজ! যেখানে সত্য, দান, ব্রত, তপস্যা, পরাক্রম ও ধৰ্ম্ম, আমি সেই স্থানেই অবস্থান করিয়া থাকি। এক্ষণে দৈত্যেশ্বর এই সমুদয়ে বিমুখ হইয়াছেন। ইনি সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় ও ব্রাহ্মণের হিতকারী ছিলেন; কিন্তু এক্ষণে ব্রাহ্মণগণের প্রতি ঈর্য্যাপ্রদর্শন ও স্বয়ং উচ্ছিষ্ট হস্তে ধৃত স্পর্শ করিয়াছেন। উনি কালকর্ত্তৃক বঞ্চিত হইয়া “আমিই নিরন্তর লক্ষ্মীর উপাসনা করিয়া থাকি”, এই বাক্য মনুষ্যসমাজে কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন। আমি এই সমস্ত কারণবশতঃ উঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া তোমার নিকট অবস্থান করিতে বাসনা করিয়াছি। তুমি প্রমত্তচিত্তে তপস্যা ও বিক্রমপ্রভাবে আমাকে রক্ষা করিও।’

“ইন্দ্র কহিলেন ‘কমলালয়ে! দেবতা, মনুষ্য ও অন্যান্য প্রাণীগণের মধ্যে এমন কেহই নাই যে, একাকী চিরকাল আপনাকে রক্ষা করিতে পারে।”

“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবরাজ! তুমি যথার্থ কহিয়াছ। কি দেবতা, কি গন্ধৰ্ব্ব, কি অসুর, কি রাক্ষস কেহই একাকী চিরকাল আমাকে ধারণ করিতে সমর্থ হয় না।’

‘ইন্দ্র কহিলেন, ‘দেবি! তবে আমি কি কার্য্য করিলে আপনি চিরকাল আমার নিকট বাস করিতে পারিবেন, তাহা যথার্থরূপে ব্যক্ত করুন।’

“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবেন্দ্র! তুমি যে উপায় অবলম্বন করিলে আমি তোমার নিকট নিত্য বাস করিব, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি বেদদৃষ্ট বিধি-অনুসারে আমাকে চারি অংশে বিভাগ করিয়া চারি স্থানে রাখ, তাহা হইলেই আমি চিরকাল তোমার নিকট অবস্থান করিব। ’

‘ইন্দ্র কহিলেন, “দেবি! আমি স্বীয় শক্তি অনুসারে আপনাকে রক্ষা করিব এবং আপনি আমার কোন অপরাধ গ্রহণ করিবেন না আমার বোধ হইতেছে, এই ভূতভাবিনী ধরিত্রী আপনার প্রথমাংশ ধারণ করিতে সমর্থ হইবেন। লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবরাজ! এই আমি আমার প্রথমাংশ পৃথিবীতে সংস্থাপিত করিলাম। এক্ষণে বল, দ্বিতীয় অংশ কোন্ স্থানে সন্নিবেশিত করিব?’

“ইন্দ্র কহিলেন, ‘দেবি! মনুষ্যের উপকারপরায়ণ সলিল আপনার দ্বিতীয়াংশ ধারণে সমর্থ হইতে পারিবে।’ লক্ষ্মী কহিলেন, ‘এই আমার দ্বিতীয়াংশ সলিলে নিহিত হইল। এক্ষণে বল, তৃতীয়াংশ কোন্ স্থানে সংস্থাপিত করিব?’

“ইন্দ্র কহিলেন, “দেবি! বেদ, যজ্ঞ ও দেবগণ হুতাশনে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছেন; অতএব অনল আপনার তৃতীয়াংশ ধারণ করিবেন।’

“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘এই আমি আমার তৃতীয়াংশ অনলে সংস্থাপন করিলাম। এক্ষণে চতুর্থাংশ কোন্ স্থানে অবস্থাপিত করিব?’

“ইন্দ্র কহিলেন, ‘ইহলোকে যেসমস্ত ব্রাহ্মণ ও হিতকারী, সত্যবাদী সাধুব্যক্তি বাস করিতেছেন, তাঁহারাই আপনার চতুর্থাংশ ধারণ করিতে সমর্থ হইবেন।’ লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবরাজ! এই আমার চতুর্থাংশ সাধুপুরুষে সন্নিবেশিত হইল। আমি এইরূপ অংশচতুষ্টয়ে বিভক্ত হইয়া প্রাণীগণমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইলাম। এক্ষণে তুমি আমাকে সাবধানে রক্ষা কর।’

“ইন্দ্র কহিলেন, ‘দেবি! আমি আপনাকে এইরূপে ভূতগণমধ্যে সংস্থাপিত করিলাম। অতঃপর যে ব্যক্তি আপনার প্রতি আঘাত করিবে, আমি অবশ্যই তাহাকে প্রতিফল প্রদান করিব।’

“এইরূপে লক্ষ্মী বলিকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ইন্দ্রের নিকট গমন করিলে, দৈত্যরাজ সুররাজকে কহিলেন, ‘পুরন্দর! দিবাকর কালসহকারে পূৰ্ব্ব, দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম দিকে তাপ প্রদান করিয়া থাকেন। তাঁহার দর্শন ও অদর্শননিবন্ধন কেহ কেহ সুখী ও কেহ কেহ দুঃখী হয়। যেমন লোকে দিবাকরের দর্শন ও অদর্শননিবন্ধন কখন দুঃখী ও কখন সুখী হইয়া থাকে, তদ্রূপ আমি এক্ষণে তোমার নিকট পরাজয় প্রাপ্ত হইয়া অসুখী হইয়াছি; আবার সময়ক্রমে তোমাকে পরাজয় করিয়া সুখী হইব। যে সময় সূৰ্য্য অনবরত গগনের মধ্যস্থলে অবস্থিত হইয়া ত্রিলোক তাপিত করিবেন, যখন এই বৈবস্বত মন্বন্তরের অবসান হইবে, তৎকালে আমার নিকট তোমাকে পরাজিত হইতে হইবে।’

“দানবরাজ এই কথা কহিলে ইন্দ্র আপনার ভাবী পরাভব শ্রবণে ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “দৈত্যনাথ! লোকপিতামহ ব্রহ্মা তোমাকে বধ করিতে নিষেধ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত আমি তোমার মস্তকে বজ্রাঘাত করিলাম না। তুমি এক্ষণে নির্ব্বিঘ্নে যথা ইচ্ছা হয় প্রস্থান কর। সূৰ্য্য কদাপি গগনের মধ্যস্থলে নিরন্তর অবস্থান করিয়া জগতের উচ্ছেদ করিবেন না। লোকপিতামহ স্বয়ম্ভূ পূৰ্ব্বে ইহার নিয়ম নির্দ্ধারিত করিয়া দিয়াছেন। উনি ন্যায়ানুসারে নিরন্তর লোকসমুদয়কে তাপপ্রদানপূর্ব্বক পরিভ্রমণ করিতেছেন। মাঘ হইতে আষাঢ় পৰ্য্যন্ত ছয়মাস উহার উত্তরায়ণ ও শ্রাবণ হইতে পৌষ পৰ্য্যন্ত ছয়মাস উঁহার দক্ষিণায়ণ হইয়া থাকে। দিবাকরের ঐ অয়নদ্বয়প্রভাবেই সমুদয় লোকের শীত, গ্রীষ্ম অনুভূত হইয়া থাকে।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! দৈত্যেন্দ্র বলি ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তথা হইতে দক্ষিণদিকে গমন করিতে লাগিলেন। সুররাজ পুরন্দরও স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।”