২৪০. যোগজ জ্ঞানবিবরণ—যোগক্রিয়ার কৌশল

২৪০তম অধ্যায়

যোগজ জ্ঞানবিবরণ—যোগক্রিয়ার কৌশল

“ব্যাস কহিলেন, বৎস! এই আমি তোমার নিকট আত্মবিচারের কথা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে যোগকাৰ্য্য বিশেষরূপে কহিতেছি, শ্রবণ কর। পণ্ডিতগণ বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়সমুদয়কে বাহ্যবৃত্তি হইতে নিবৃত্ত করিয়া সর্ব্বব্যাপী পরমাত্মাতে লীন করাকে উৎকৃষ্ট জ্ঞান বলিয়া নির্দ্দেশ করেন; অতএব যোগী ব্যক্তি শান্তপ্রকৃতি, জিতেন্দ্রিয়, ধ্যাননিষ্ঠ, ঈশ্বরে অনুরক্ত, শাস্ত্ৰতত্ত্বজ্ঞ ও পবিত্র হইয়া কাম, ক্রোধ, লোভ, ভয় ও স্বপ্ন এই পঞ্চবিধ যোগদোষ পরিত্যাগপূর্ব্বক আচার্য্য হইতে এইরূপ জ্ঞান পরিজ্ঞাত হইবেন। শান্ত প্রকৃতি হইলেই ক্রোধ, সঙ্কল্পত্যাগী হইলেই কাম ও সদ্গুণসম্পন্ন হইলেই নিদ্রা জয় করা যায়। ধৈৰ্য্যগুণদ্বারা কাম ও বুভুক্ষা, চক্ষুদ্বারা হস্ত-পদ, মনদ্বারা চক্ষু ও শ্রোত্র এবং সৎকাৰ্য্যদ্বারা মন ও বাক্য রক্ষা করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। সতত অপ্রমত্ত হইয়া ভয় এবং জ্ঞানবাদিগের শুশ্রূষাপরতন্ত্র হইয়া দম্ভগুণ পরিত্যাগ করা উচিত। যোগী ব্যক্তি এইরূপে অতন্দ্রিত হইয়া যোগদোষসমুদয় পরিত্যাগ করিবেন। মনোভঙ্গকর হিংসাযুক্তবাক্য পরিত্যাগ, অগ্নি ও ব্রাহ্মণের অর্চ্চনা এবং দেবগণকে প্রণাম করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। তেজোময় ব্রহ্ম স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় লোকের বীজ ও রসস্বরূপ। সমুদয় প্রাণী তাঁহাকেই আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিতেছে।

‘ধ্যান, বেদাধ্যয়ন, দান, সত্য, লজ্জা, সরলতা, ক্ষমা, শৌচ ও ইন্দ্রিয়নিগ্রহদ্বারা তেজোবৃদ্ধি, পাপধ্বংস, অভীষ্টসংসাধন ও বিজ্ঞান লাভ হয়। সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী, যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্ট, পাপবিহীন, তেজস্বী, অল্পাহারনিরত, জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কাম ক্রোধকে বশে আনয়নপূর্ব্বক ব্ৰহ্মপদলাভের বাসনা করিবেন। যোগজিজ্ঞাসু ব্যক্তিরা নিবিষ্ট চিত্তে মন ও ইন্দ্রিয়গণকে বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়া রাত্রির পূর্ব্বভাগ ও শেষভাগে বুদ্ধির সহিত মনকে সংযোজিত করিবেন। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে একমাত্র ইন্দ্রিয়বিষয়ে আসক্ত থাকিলেই মনুষ্যের শাস্ত্রীয় বুদ্ধি সেই ইন্দ্রিয়রূপ একমাত্র দ্বার অবলম্বন করিয়া সচ্ছিদ্র চর্ম্মময় জলাধার সলিলের ন্যায় নিঃসৃত হইয়া যায়; অতএব ধীবর যেমন প্রথমে জালদংশক্ষম [জালকৰ্ত্তনক্ষম—জাল কাটিয়া পথ করিলে সেই পথে অন্যান্য মৎস্য জালের বাহিরে চলিয়া যাইতে পারে] মৎস্যদিগকে রুদ্ধ করিয়া অন্যান্য মৎস্যসমুদয়কে আক্রমণ করে, তদ্রূপ যোগশীল ব্যক্তি প্রথমে মনকে রুদ্ধ করিয়া পশ্চাৎ অন্যান্য ইন্দ্রিয়গণকে সংযমিত করিবেন। যোগবিদ পুরুষ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা ও জিহ্বা এই চারি ইন্দ্রিয়কে বিষয় হইতে আকর্ষণ করিয়া মনে ও মনকে সঙ্কল্প হইতে নিবৃত্ত করিয়া বুদ্ধিতে সন্নিবেশিত করিবেন। মন ইন্দ্রিয়গণের নিকট সমবেত হইয়া বুদ্ধিতে অবস্থানপূৰ্ব্বক প্রসন্ন হইলেই যোগী ব্যক্তি ধূমবিহীন প্রজ্জ্বলিত অনলশিখার ন্যায় সেই তেজঃস্বরূপ সৰ্ব্বব্যাপী পরব্রহ্মকে দীপ্তিমান্ সূর্য্যের ন্যায় ও গগনমণ্ডলস্থ বিদ্যুদগ্নির ন্যায় হৃদয়মধ্যে দর্শন করিয়া থাকেন। সৰ্ব্বভূতহিতৈষী ধৃতিমান্ জ্ঞানসম্পন্ন মহাত্মা ব্রাহ্মণগণই যোগবলে তাঁহার দর্শনলাভে সমর্থ হয়েন। যে ব্যক্তি জনশূন্য প্রদেশে একাকী উপবিষ্ট হইয়া সংযতচিত্তে ছয়মাস পূৰ্ব্বোক্তরূপে যোগানুষ্ঠান করিতে পারেন, তাঁহার ব্রহ্মভাবপ্রাপ্তি হইয়া থাকে।

‘তত্ত্ববিদ ব্যক্তিরা চিত্তের মোহ ও চাঞ্চল্য এবং উপস্থিত ক্রোধাদি পরিত্যাগ করিবেন। যোগপ্রভাবে দিব্যগন্ধ, শব্দ, রূপ, রস, স্পর্শ, সুখকর শীত, তাপ, অন্তর্দ্ধান, আকাশগতি, সৰ্ব্বশাস্ত্রার্থজ্ঞান ও দিব্যাঙ্গনাসঙ্গতি [উত্তম নারীর সহিত সম্বন্ধ] উপস্থিত হইলেও তৎসমুদয়ে অনাদর প্রকাশ করিয়া, সেসকল হইতে নিবৃত্ত হওয়া তাঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য।

এইরূপে প্রাতঃকাল, পূৰ্ব্বরাত্রি ও অপর রাত্রিতে সংযত হইয়া পর্ব্বতশৃঙ্গে, চৈত্যবৃক্ষের [গ্রাম্যদেবতার অধিষ্ঠাননিবন্ধন পূজ্য বৃক্ষের] তলে অথবা অন্য কোন বৃক্ষের সম্মুখে যোগসাধন করা যোগীদিগের আবশ্যক। যোগবিদ ব্যক্তিরা ইন্দ্রিয়সমুদয় সংযমিত করিয়া অর্থচিন্তাপরায়ণ পুরুষের ন্যায় একাগ্রচিত্ত হইয়া সেই অক্ষয়ধন পরব্রহ্মকে ধ্যান করিবেন, কখনই যোগানুষ্ঠানে অমনোযোগ করিবেন না। যে উপায়দ্বারা চঞ্চল চিত্তকে বশীভূত করা যায়, অধ্যবসায়সহকারে সেই উপায় অবলম্বন করিয়া থাকাই তাঁহাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। যোগশীল ব্যক্তি অনন্যমনে বাস করিবার নিমিত্ত শূন্য গিরিগুহা, দেবস্থান অথবা নির্জ্জন গৃহ আশ্রয় করিবেন এবং কায়মনোবাক্যে অন্যসংসর্গ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক উপেক্ষানিরত [উদাসীন—বাধ্যবাধকতা ভাববিবর্জ্জিত], নিয়মিতাহারী ও লাভালাভে সমজ্ঞানসম্পন্ন হইবেন। কোন ব্যক্তির মুখে আপনার নিন্দাবাদ বা প্রশংসাবাক্য শ্রবণ করিয়া তন্নিবন্ধন তাহার অশুভ বা শুভচিন্তা করিবেন না। লাভালাভে হর্ষবিষাদশূন্য, সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী ও সৰ্ব্বস্পর্শী বায়ুর ন্যায় পবিত্র হওয়া তাঁহাদের নিতান্ত আবশ্যক। যে মহাত্মা এইরূপ বিশুদ্ধ চিত্ত ও সৰ্ব্বত্র সমদর্শী হইয়া ছয়মাস ক্রমাগত যোগসাধন করেন, তিনি বেদোক্ত কাৰ্য্য অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়েন। লোষ্ট্র ও কাঞ্চনে সমজ্ঞানবিশিষ্ট ব্যক্তিরা অন্যান্য ব্যক্তিকে অর্থলাভের নিমিত্ত নিতান্ত কাতর দেখিয়া কখনই উপার্জ্জনমার্গে প্রবৃত্ত বা বিমোহিত হইবেন না। শূদ্র বা ধর্ম্মাকাঙ্ক্ষিণী নারীগণও যদি এইরূপ পথ অবলম্বন করে, তাহা হইলে তাঁহাদের পরমগতি লাভ হয়। জিতচিত্ত যোগী ব্যক্তি নিশ্চল ইন্দ্রিয়দ্বারা সেই জন্মবিহীন, নির্ব্বিকার, সূক্ষ্ম হইতেও সূক্ষ্ম, মহৎ হইতেও মহৎ, অনন্ত পরব্রহ্মকে লাভপূৰ্ব্বক প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন। যাঁহারা মহাত্মা মহর্ষির এই সমুদয় বাক্য যুক্তিদ্বারা পৰ্য্যালোচনা করেন, তাঁহারাই ব্রহ্মার তুল্য হইয়া পরমগতি লাভ করিয়া থাকেন। ”