২১৪. ইন্দ্রিয়জয়ে গুণজয়

২১৪তম অধ্যায়

ইন্দ্রিয়জয়ে গুণজয়

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে শাস্ত্রচক্ষুদ্বারা যেরূপ ইন্দ্রিয়জয়ের উপায় দৃষ্ট হইতেছে, আমি তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ঐ উপায় অবগত হইয়া জ্ঞানসহকারে শমাদি গুণ আশ্রয় করিতে পারিলেই পরমগতি লাভ হইয়া থাকে। যাবতীয় জন্তুর মধ্যে মনুষ্য, মনুষ্যমধ্যে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণমধ্যে মন্ত্রজ্ঞই শ্ৰেষ্ঠ। সৰ্ব্বভূতের আত্মভূত বেদশাস্ত্রবিশারদ সৰ্ব্বজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ সতত পরমার্থ অবগত হইয়া থাকেন। জ্ঞানবিহীন ব্যক্তি অন্ধ পথিকের ন্যায় নিয়ত ক্লেশভোগ করে, এই নিমিত্ত ব্রহ্মবিদ জ্ঞানবান্ মহাত্মাদিগকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। ধার্ম্মিক পুরুষেরা যথাশাস্ত্র যজ্ঞাদি ধর্ম্মের উপাসনা করেন, কিন্তু তদ্বারা তাঁহাদের মোক্ষলাভের সম্ভাবনা নাই। ধৰ্ম্মাত্মারা বাক্য, দেহ ও মনের পবিত্রতা, ক্ষমা, সত্য, ধূতি ও স্মৃতি এই সমুদয় সদ্‌গুণকে সকল ধর্ম্মের নিদান বলিয়া থাকেন। যজ্ঞানুষ্ঠানাদিদ্বারা কেবল ঐ সমুদয় সদ্‌গুণলাভ হইয়া থাকে। যোগধৰ্ম্ম ব্রহ্মস্বরূপ ও সমুদয় ধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই ধৰ্ম্মদ্বারা মোক্ষলাভ হইয়া থাকে। প্রাণ, মন, বুদ্ধি ও দশ ইন্দ্রিয়ের সহিত ব্রহ্মচর্য্যের সংযোগ নাই। উহা শব্দাদিবিহীন এবং পাপাদির অনুভাবাত্মক। মনুষ্য অধ্যবসায় সহকারে সেই পাপশূন্য ব্রহ্মস্বরূপ ব্রহ্মচর্য্য পরিজ্ঞাত হইবে। যিনি সম্যকরূপে উহার অনুষ্ঠান করেন, তাঁহার সত্যলোক লাভ হয়; আর যিনি নিকৃষ্টরূপ উহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েন, তিনি বিদ্যাসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হইয়া জন্মগ্রহণ করেন।

গুণপ্রবাহবোধের উপায়—ব্রহ্মচর্য্যযুক্ত যোগ

“ব্রহ্মচর্য্য অতি দুষ্কর। এক্ষণে উহার উপায় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ব্রাহ্মণ রজোগুণ উৎপন্ন বা পরিবর্দ্ধিত হইবামাত্র উহা পরিত্যাগ করিবেন। স্ত্রীলোকের বাক্য শ্রবণ বা বিবসনা স্ত্রীকে দর্শন করা ব্রহ্মচর্য্যব্রতধারীদিগের কদাপি বিধেয় নহে। যদি কখন ঐরূপ কামিনীদর্শনে তাঁহাদের মনেও অনুরাগসঞ্চার হয়, তাহা হইলে তাঁহারা তিনদিন কৃচ্ছ্রব্রত অবলম্বন ও সলিলপ্রবেশ করিবেন। আর যদি স্বপ্নাবস্থায় রেতঃপাত হয়, তাহা হইলে জলমগ্ন হইয়া তিনবার অঘমর্ষণমন্ত্র জপ করিবেন। বিচক্ষণ, ব্যক্তিরা জ্ঞানযুক্ত মনদ্বারা অন্তর্গত রজোময় পাপকে নিরন্তর দগ্ধ করিয়া থাকেন। মল নাড়ীর ন্যায় দেহ আত্মার দৃঢ়বন্ধনস্বরূপ; রসসমুদয় শিরাজালদ্বারা মনুষ্যদিগের বাত, পিত্ত, কফ, রক্ত, ত্বক, মাংস, স্নায়ু, মজ্জা ও মেদকে বর্দ্ধিত করে। মনুষ্যদিগের দেহে বাতাদিবাহিনী দশটি নাড়ী আছে। উহারা পাঁচ ইন্দ্রিয়ের গুণদ্বারা পরিচালিত হয়; অন্যান্য সহস্র সহস্র সূক্ষ্ম নাড়ী ঐ দশটি নাড়ীকে আশ্রয় করিয়া শরীরমধ্যে বিস্তৃত রহিয়াছে। নদীসমুদয় যেমন যথাকালে সাগরকে পরিবর্দ্ধিত করে, তদ্রূপ ঐ সমস্ত শিরা দেহের বৃদ্ধিসাধন করিয়া থাকে। মানবগণের হৃদয়মধ্যে, মনোবহানামে যে শিরা আছে, ঐ শিরা তাহাদের সৰ্ব্বগাত্র হইতে সঙ্কল্পজ শুক্র গ্রহণপূর্ব্বক উপস্থের উন্মুখ করিয়া দেয়। সৰ্ব্বগাত্রব্যাপিনী অন্যান্য শিরাসমুদয় ঐ শিরা হইতে বিনির্গত হইয়া তৈজসগুণ বহনপূৰ্ব্বক চক্ষুর দর্শনক্রিয়া সম্পাদন করে। মন্থনদণ্ডদ্বারা যেমন দুগ্ধান্তৰ্গত ঘৃত মথিত হয়, তদ্রূপ সঙ্কল্পজ স্ত্রীদর্শনাদিদ্বারা শুক্র উত্তেজিত হইয়া থাকে। স্বপ্নবস্থায় স্ত্রীসঙ্গের অসত্ত্বেও মনঃ যেমন সঙ্কল্পজ অনুরাগ প্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ ঐ অবস্থায় মনোবহা নাড়ীও দেহ হইতে সঙ্কল্পজ শুক্রকে নির্গত করিয়া দেয়।

“মহর্ষি অত্রি শুক্রবিষয়িণী বিদ্যা সবিশেষ পরিজ্ঞাত আছেন। অন্নরস, মনোবহা নাড়ী ও সঙ্কল্প এই তিনটি শুক্রের বীজভূত। ইন্দ্র শুক্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা; এই নিমিত্ত উহার নাম ইন্দ্রিয়। যাঁহারা শুক্রের উদ্রেক প্রাণীগণের বর্ণসঙ্করের কারণ বলিয়া বিচার করিতে সমর্থ হয়েন, তাঁহারাই বিরাগী ও বাসনাবিহীন হইয়া মোক্ষ লাভ করিতে পারেন। বাহ্যপ্রবৃত্তিশূন্য মহাত্মারা যোগবলে ক্রমে ক্রমে গুণের সাম্য লাভ করিয়া অন্তকালে সত্যলোকপ্রদ সুষুম্নানাড়ীমার্গের প্রতি প্রাণ প্রেরণপূর্ব্বক মোক্ষলাভ করিয়া থাকেন। মনুষ্যের মন বিশ্বাসাত্মক হইলেই জ্ঞানের উদয় হয়। তখন সমুদয় বিষয়, স্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাত হইয়া থাকে এবং মনও প্রকাশশালী, বাসনাবিহীন, মন্ত্রসিদ্ধ ও সৰ্ব্বশক্তিসম্পন্ন হয়। অতএব মনুষ্য মনকে নিগৃহীত করিবার নিমিত্ত রজঃ ও তমোগুণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নিমিত্তরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া পরমগতি লাভ করিবে। মনুষ্যের যৌবনাবস্থায় উপার্জ্জিত জ্ঞান বার্ধক্যে জরাপ্রভাবে দুর্ব্বল হইয়া যায়; কিন্তু বিপক্কবৃদ্ধি ব্যক্তিরা পূর্ব্বভাগ্যপ্রভাবে সঙ্কল্পকে সঙ্কুচিত করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি দুর্গম পথের ন্যায় ইন্দ্রিয়াদিরূপ বন্ধনকে অতিক্রম করিয়া দোষসমুদয় পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই মোক্ষামৃত পান করিতে সমর্থ হয়েন।”