২২৯. প্রজ্ঞায় পরমপদপ্রাপ্তি—জৈগীষব্য-দেবলসংবাদ

২২৯তম অধ্যায়

প্রজ্ঞায় পরমপদপ্রাপ্তি—জৈগীষব্য-দেবলসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! লোকে কিরূপ চরিত্র, আচার, বিদ্যা ও পরাক্রমসম্পন্ন হইলে ব্রহ্মপদ লাভ করিতে সমর্থ হয়?”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! মোক্ষধর্ম্মপরায়ণ অল্পাহারনিরত জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরাই মায়াপ্রপঞ্চাতীত [মায়াকল্পিত সংসারের অতীত] ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। আমি এই উপলক্ষে মহাত্মা জৈগীষব্য-দেবলসংবাদ নামক এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা মহর্ষি অসিতদেবল হর্ষক্রোধবিবর্জ্জিত ভগবান্ জৈগীষব্যকে কহিলেন, ‘মহর্য্যে! আপনি স্তুতিবাদদ্বারা পরিতুষ্ট ও নিন্দাবাক্যদ্বারা ক্রুদ্ধ হয়েন না। অতএব জিজ্ঞাসা করি, আপনার প্রজ্ঞা কিরূপ? আর কোথা হইতে উহা প্রাপ্ত হইলেন এবং উহার ফলই বা কি?’

“মহাত্মা দেবল এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে মহর্ষি জৈগীষব্য মহার্থসংযুক্ত [গাম্ভীর্য্যযুক্ত] অসন্দিগ্ধ পবিত্রবাক্যে তাঁহাকে কহিলেন, ‘মহর্ষে! বিশুদ্ধকৰ্ম্মা ব্যক্তিরা যে প্রজ্ঞাপ্রভাবে পরমগতি ও শান্তি লাভ করিয়া থাকেন, আমি তোমার নিকট সেই প্রজ্ঞার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যাঁহারা স্তুতি ও নিন্দা সমান জ্ঞান করেন, তাঁহারা অন্যকৃত স্তুতিনিন্দা কাহারও নিকট কীৰ্ত্তন করেন না। জ্ঞানবান ব্যক্তিরাই শত্রুকর্ত্তৃক নিন্দিত হইয়াও তাহার নিন্দায় প্রবৃত্ত হয়েন না এবং বধোদ্যত ব্যক্তিকেও বিনাশ করিতে ইচ্ছা করেন না। অনাগত ও অতীত বিষয়ের নিমিত্ত শোক না করিয়া উপস্থিত কার্য্যেরই অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। কখনই প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ হয়েন না। পূজাকাল সমুপস্থিত হইলে ব্রতনিরত হইয়া যথাসাধ্য অর্থ ব্যয় করেন। সতত জিতক্রোধ ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া থাকেন। কায়মনোবাক্যে কখন অপকার বা সমকক্ষের প্রতি ঈর্ষা করেন না এবং অন্যের সমৃদ্ধি দেখিয়া কখনই অনুতাপিত হয়েন না। যাহারা অন্যের নিন্দা ও প্রশংসা না করেন, তাহাদিগকে কখনই অন্যকৃত নিন্দা ও প্রশংসা শ্রবণ করিতে হয় না। সৰ্ব্বপ্রাণীর হিতকারী প্রশান্তবুদ্ধি ব্যক্তিরাই হর্ষ, ক্রোধ ও পরোপকার পরিত্যাগপূর্ব্বক জীবকে দেহ হইতে পৃথক বিবেচনা করিয়া পরমসুখে বিচরণ করিতে পারেন। যাঁহাদিগের একজনও বান্ধব বা শত্ৰু নাই এবং যাঁহারা কাহারও বন্ধু বা শত্রু নহেন, তাঁহারা সৰ্ব্বদা পরমসুখে কালযাপন করিতে সমর্থ হয়েন। যাঁহারা সৰ্ব্বজ্ঞ হইয়া ধর্ম্মপথ আশ্রয় করেন, তাঁহারা সতত সন্তুষ্ট থাকেন; আর যাহারা ধর্ম্মপথ পরিত্যাগ করে, তাহারা সততই বিষাদ প্রাপ্ত হয়। আমি এক্ষণে ধৰ্ম্মপথ অবলম্বন করিয়াছি; অতএব কি নিমিত্ত নিন্দিত হইয়া নিন্দুক ব্যক্তির উপর ঈর্ষান্বিত ও প্রশংসিত হইয়া প্রশংসাকারীর প্রতি পরিতুষ্ট হইব? যে ব্যক্তি যাহা হইতে যে বস্তুর বাঞ্ছা করে, সেই ব্যক্তি তাহা হইতে তাহাই লাভ করুক; তাহাতে আমার কিছুমাত্র ঈর্ষা নাই। প্রশংসা বা নিন্দাদ্বারা কিছুমাত্র লাভালাভ হইবে না। তত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা অপমানিত হইলে অপমানকে অমৃতের ন্যায় জ্ঞান করিয়া পরিতুষ্ট ও সম্মানিত হইলে সম্মানকে বিষতুল্য বিবেচনা করিয়া উদ্বেলিত হইয়া থাকেন। সৰ্ব্বদোষবিমুক্ত মহাত্মা অন্যকর্ত্তৃক অপমানিত হইয়া সুখে নিদ্রিত হয়েন, কিন্তু যে ব্যক্তি তাঁহাকে অবজ্ঞা করে, তাহার নিদ্রা হয় না। যে মহাত্মার পরমগতিলাভ করিতে প্রার্থনা করেন, এইরূপ অবলম্বন করিলেই তাঁহাদিগের বাসনা পরিপূর্ণ হয়! জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা নিষ্কাম হইয়া শাস্ত্রানুসারে সমুদয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলে মায়াপ্রপঞ্চাতীত পরমপদ ব্ৰহ্মপদ লাভ করিয়া থাকেন। কি দেবতা, কি গন্ধৰ্ব্ব, কি পিশাচ, কি রাক্ষস কেহই তাঁহার পদ গ্রহণ করিতে সমর্থ হয়েন না।”