১৩৮তম অধ্যায়
সন্ধি-বিগ্রহের সময়—মার্জ্জার-মূষিক বৃত্তান্ত
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি প্রত্যুৎপন্ন ও অনাগত বিপদের প্রতিবিধানকারিণী বুদ্ধিকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং দীর্ঘসূত্রীকে বিনাশের কারণ বলিয়া নির্দেশ করিলেন। এক্ষণে ধর্ম্মশাস্ত্রবিশারদ ধর্ম্মার্থকুশল প্রজারঞ্জক নরপতি কিরূপ বুদ্ধি আশ্রয় করিলে শত্রুকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়াও মুগ্ধ হয়েন না, অনেক শত্রু এক রাজাকে আক্রমণ করিলে তাঁহার কিরূপে অবস্থান করা কর্ত্তব্য, রাজা বিপদগ্রস্ত হইলে তাঁহার বহুসংখ্যক শত্রু পূৰ্ব্বাপকার[পূৰ্ব্বকৃত অপকার] নিবন্ধন ক্রুদ্ধ হইয়া যদি তাঁহাকে সমূলে উন্মূলিত করিতে চেষ্টা করে, তাহা হইলে তখন তিনি কিরূপে একাকী সহায়বিহীন হইয়া সেই গ্রাসোদ্যত শত্রুগণের মধ্যে অবস্থান করিবেন, মিত্র ও শত্রুপক্ষ আশ্রয় করিয়া তাহাদিগের সহিত কিরূপ ব্যবহার করা উচিত? যে রাজার মিত্রগণও শত্রু হইয়া উঠে, তিনি কি উপায় অবলম্বন করিলে সুখলাভে সমর্থ হয়েন, প্রকৃত ও কৃত্রিম মিত্রের মধ্যে কাহার সহিত সন্ধিসংস্থাপন ও কাহার সহিত যুদ্ধ করা কর্ত্তব্য এবং বলবান্ হইলেও শত্রুগণের মধ্যে কিরূপে অবস্থান করা উচিত, এই সমস্ত বিষয় বিধিপূৰ্ব্বক শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। হে শান্তনুনন্দন! আপনি জিতেন্দ্রিয় ও সত্যপ্রতিজ্ঞ, আপনি ব্যতীত এই সমুদয় বিষয়ের বক্তা আর কেহই নাই এবং শ্রোতাও অতি সুদুর্ল্লভ। অতএব এক্ষণে আপনি এই সমস্ত বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! তুমি যেরূপ গুণসম্পন্ন, তোমার প্রশ্নগুলিও তদনুরূপ হইয়াছে। এক্ষণে আপৎকালের অনুষ্ঠানোপযোগী গৃঢ় বিষয়সমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কোন কোন সময় শত্রুও মিত্র হয় এবং কখন কখন মিত্রও শত্রু হইয়া উঠে, কার্য্যের গতিও সৰ্ব্বদা সমান হয় না; অতএব কার্য্যাকাৰ্য্য নিশ্চয় করিতে হইলে দেশকাল বিবেচনা করিয়া বিশ্বাস ও বিগ্রহ করা কর্ত্তব্য। হিতার্থ পণ্ডিতগণের সহিত সন্ধিসংস্থাপন করা নিতান্ত আবশ্যক। প্রাণরক্ষার নিমিত্ত শত্ৰুদিগের সহিতও সন্ধি করিতে হয়। যে মূর্খ বিপক্ষদিগের সহিত কদাপি সন্ধি করিতে সম্মত না হয়, সে কখনই অর্থোপার্জ্জন বা সুখভোগ করিতে পারে না। আর যে ব্যক্তি উপযুক্ত সময়ে মিত্রগণের সহিত বিরোধ ও শত্ৰুদিগের সহিত সন্ধিস্থাপন করে, তাহার বিপুল অর্থ ও মহৎ ফললাভ হয়, সন্দেহ নাই। আমি এই উপলক্ষে মার্জ্জারমূষিক-সংবাদ নামে একটি পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
বিপদকালে কৃত উপকারের উপযোগিতা
“কোন নিবিড় অরণ্যমধ্যে এক লতাজালজড়িত পক্ষিকুলসমাকীর্ণ অতি বৃহৎ বটবৃক্ষ ছিল। পলিতনামে এক মহাপ্রাজ্ঞ মূষিক ঐ বৃক্ষের মূলে শতমুখ বিবর প্রস্তুত করিয়া বাস করিত। লোমশনামে এক পক্ষিসঙ্ঘাতঘাতক মার্জ্জারও বৃক্ষের শাখা আশ্রয় করিয়া ছিল। কিয়দ্দিন পরে এক চণ্ডাল সেই অরণ্যে আগমনপূর্ব্বক গৃহ নির্ম্মাণ করিল। সে প্রতিদিন সায়ংকালে মৃগাদির বন্ধনার্থ ঐ বৃক্ষের অনতিদূরে স্নায়ু[নাড়ী]ময় পাশ বিস্তৃত করিয়া গৃহে গমনপূর্ব্বক সুখে রজনীযাপন করিত এবং প্রাতঃকালে তথায় আগমনপূর্ব্বক রাত্রিযোগে যেসকল মৃগ পাশে বদ্ধ হইয়া থাকিত, তাহাদিগকে লইয়া যাইত। একদা সেই বৃক্ষশাখাসমাশ্রিত মার্জ্জার দৈবাৎ ঐ পাশে বদ্ধ হইল। তখন পলিতনামা মূষিক সেই প্রবল শত্রুকে বদ্ধ দেখিয়া অকুতোভয়ে ভক্ষ্য-বস্তুর অন্বেষণার্থ তথায় পর্য্যটন করিতে লাগিল এবং ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে করিতে সেই পাশোপরি ভক্ষ্যদ্রব্য দেখিতে পাইয়া মার্জ্জারের উপর আরোহণপূৰ্ব্বক মনে মনে হাস্য করিয়া আমিষ ভক্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় উহার অনতিদূরে হরিনামে তাম্রলোচন চঞ্চলস্বভাব নকুল মূষিকের আঘ্রাণ পাইয়া ভক্ষণার্থ সত্বর সৃক্কণী লেহন করিতে করিতে ভূগর্ভ. হইতে মস্তক উত্তোলন করিল এবং চন্দ্রকনামে এক তীক্ষ্ণতুণ্ড[ধারাল ঠোঁট] তরুকোটরবাসী উলূক বৃক্ষশাখায় বিচরণ করিতে লাগিল। মূষিক আমিষভক্ষণে নিতান্ত ব্যগ্র ছিল, অকস্মাৎ সেই শত্রুদ্বয়কে অবলোকনপূৰ্ব্বক নিতান্ত ভীত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিল যে, এইরূপ চতুর্দ্দিকে প্রাণসঙ্কট বিষম আপদ উপস্থিত হইলে আত্মহিতৈষী ব্যক্তিদিগের কি করা কর্ত্তব্য? আপদ উপস্থিত হইলে তাহা নিবারণ করিয়া প্রাণরক্ষা করাই বুদ্ধিমানদিগের উচিত। অতএব যাঁহারা চতুর্দ্দিক হইতে বিপদগ্রস্ত হইয়াও বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারেন, তাহাদিগের জীবন ধন্য। আমি এক্ষণে বিষম বিপদে নিপতিত হইয়াছি। সহসা ভূতলে উপস্থিত হইলে নকুল এবং এই স্থানে অবস্থান করিলে উলূক আমাকে ভক্ষণ করিবে। আর যদি বিড়াল ইতিমধ্যে পাশ হইতে মুক্ত হয়, তাহা হইলে কোনক্রমেই উহার নিকট আমার নিস্তার নাই। যাহা হউক, মাদৃশ প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বিপদ্কালে কখনই বিমুগ্ধ হয় না। এক্ষণে আমি বুদ্ধি আশ্রয় করিয়া জীবনরক্ষাৰ্থ সাধ্যানুসারে যত্ন করিতে ত্রুটি করিব না। নীতিশাস্ত্রবিশারদ বুদ্ধিমান্ পণ্ডিতেরা ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইলেও অবসন্ন হয়েন না। অতঃপর মার্জ্জার ভিন্ন আমার পরিত্রাণের উপায়ান্তর নাই। এক্ষণে এই শত্রু বিপদগ্রস্ত হইয়াছে। আমার দ্বারা ইহার বিশেষ উপকার হইতে পারে; অতএব জীবনরক্ষাৰ্থ এই মার্জ্জারের আশ্রয় গ্রহণ করাই আমার সৰ্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। আমি নীতিবল অবলম্বনপূৰ্ব্বক ইহার হিতসাধন করিয়া শত্রুগণকে বঞ্চিত করিব। এই মার্জ্জার পরম শত্রু; কিন্তু এক্ষণে এ ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইয়া স্বার্থসাধনার্থ আমার সহিত সন্ধি করিতে পারে। বিজ্ঞ ব্যক্তিরা কহিয়া থাকেন যে, বলবান্ ব্যক্তি বিপদগ্রস্ত হইয়া জীবনরক্ষার নিমিত্ত নিকৃষ্ট শত্রুর সহিতও সন্ধি করিতে পারে। মূর্খ মিত্র অপেক্ষা পণ্ডিত শত্রুর আশ্রয়গ্রহণ করা শ্রেয়স্কর। যদি এই বিড়াল পণ্ডিত হয়, তবে উহা হইতে নিশ্চয়ই আমার জীবনরক্ষা হইবে। যাহা হউক, এক্ষণে এই মার্জ্জারদ্বারাই আমার জীবনরক্ষার সম্ভাবনা; অতএব ইহাকে আমার প্রাণরক্ষা করিতে অনুরোধ করিব। সম্প্রতি ন্যায়ানুসারে ইহাকেই পণ্ডিত নির্দেশ করা যাইতে পারে।
“সন্ধিবিগ্রহকালাভিজ্ঞ অর্থতত্ত্বজ্ঞ মূষিক মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া বিনীতবচনে মার্জ্জারকে কহিল, ‘সখে! তুমি ত’ জীবিত আছ? আমি আমাদিগের উভয়ের হিতসাধনার্থ তোমার জীবন রক্ষা করিতে অভিলাষ করিতেছি। অতঃপর তুমি কিছুমাত্র ভীত হইও না। যদি তুমি আমায় হিংসা না কর তাহা হইলে আমি নিশ্চয় তোমাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিব। এক্ষণে আমি একটি উপায় উদ্ভাবন করিয়াছি, সেই উপায় অবলম্বন করিলে তুমি বন্ধনমুক্ত হইবে এবং আমিও বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারিব। ঐ দেখ, দুর্বুদ্ধি নকুল ও উলূক অনতিদূরে অবস্থান করিতেছে। যাহাতে উহারা আমাকে আক্রমণ করিতে না পারে, তুমি তদ্বিষয়ে যত্ন কর। চঞ্চলনেত্ৰ পাপাত্মা উলূককে ন্যগ্রোধবৃক্ষের [বটবৃক্ষের] শাখাগ্র অবলম্বনপূৰ্ব্বক চীৎকার ও আমার প্রতি নেত্রপাত করিতে দেখিয়া আমি যারপরনাই উদ্বিগ্ন হইয়াছি। পরস্পর অকপটচিত্তে বাক্যালাপ হওয়াই সাধুদিগের মিত্রতার মূল। তুমি আমার পরমমিত্র ও পণ্ডিত। যাহা হউক, এক্ষণে তোমার কিছুমাত্র মৃতুর আশঙ্কা নাই। আমি নিশ্চয়ই মিত্রের কাৰ্য্য সম্পাদন করিব। তুমি আমার সাহায্য ব্যতীত কখনই পাশ ছেদন করিতে সমর্থ হইবে না। অতএব এক্ষণে যদি আমায় হিংসা না কর, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই তোমার পাশচ্ছেদন করিয়া দিব। তুমি এই পাদপের উপরিভাগে ও আমি ইহার মূলদেশে বহুদিন অবস্থান করিয়া আসিতেছি; অতএব আমাদের পরস্পর সাহায্যে যত্নবান হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। যাহারা কাহাকেও বিশ্বাস না করে এবং যাহাদিগকে কেহই বিশ্বাস করে না, পণ্ডিতেরা কদাচ তাহাদের প্রশংসা করেন না। অতএব আমাদিগের পরস্পরের প্রতি প্রণয় পরিবর্দ্ধিত ও সন্ধি সংস্থাপিত হউক। কাল অতীত হইলে অর্থসাধনের চেষ্টা করা নিতান্ত নিরর্থক। উহা পণ্ডিতসমাজে কদাচ আদরণীয় হয় না। এক্ষণে আমরা পরস্পর পরস্পরের জীবনরক্ষা করিবার নিমিত্তই উপযুক্ত সময়ে সন্ধিসংস্থাপন করিতেছি। লোকে যেমন কাষ্ঠদ্বারা [জলে ভাসমান কাষ্ঠের আশ্রয়ে] সুগভীর মহানদী উত্তীর্ণ হইতে প্রবৃত্ত হইলে মনুষ্য কাষ্ঠকে, কাষ্ঠ মনুষ্যকে নদীর পরপারে লইয়া যায়, আমরাও তদ্রূপ সন্ধিসংস্থাপনপূর্ব্বক পরস্পরের হিতসাধন করিব; আমি নিশ্চয়ই তোমার উদ্ধারসাধন করিব। কিন্তু অগ্রে তোমাকে আমায় উদ্ধার করিতে হইবে।
“মূষিক-প্রধান পলিত এইরূপ হিতকর হেতুযুক্ত বাক্য কীৰ্ত্তন করিয়া প্রত্যুত্তর শ্রবণ করিবার নিমিত্ত অপেক্ষা করিতে লাগিল। বুদ্ধিমান বিচক্ষণ মার্জ্জার মূষিকের হিতকর বাক্য শ্রবণ ও আপনার দুরবস্থার বিষয় পর্য্যালোচনাপূৰ্ব্বক মনে মনে সিদ্ধ করাই কৰ্ত্তব্য বলিয়া স্থির করিল। তখন সে মূষিকের প্রতি মন্দ মন্দ দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, মহাত্ম! তুমি যে আমার জীবন রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিয়াছ, ইহাতে আমি তোমার প্রতি যারপরনাই সন্তুষ্ট হইলাম। যদি তুমি আমাদিগের পরস্পরের প্রণয় শ্রেয়স্কর বলিয়া বোধ করিয়া থাক, তাহা হইলে আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই। এক্ষণে আমরা উভয়েই ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইয়াছি; অতএব এ সময় শীঘ্রই সন্ধি করা আমাদিগের কর্ত্তব্য। এক্ষণে তুমি সময়োচিত কার্য্যের অনুষ্ঠান কর। আমাকে বন্ধন হইতে মুক্ত করিলে তোমার উপকার কখনই ব্যর্থ হইবে না। অধিক কি, আমি তোমার নিকট আত্মসমর্পণ করিলাম; তুমি আমাকে আপনার শিষ্য, ভৃত্য ও শরণাগত বলিয়া বিবেচনা কর।’ তখন বুদ্ধিমান্ মার্জ্জার এই কথা কহিলে মূষিকশ্রেষ্ঠ পলিত তাহাকে বশীভূত বিবেচনা করিয়া কহিল, ‘সখে! তুমি উদারচিত্তে যেসকল কথা কহিলে, তৎসমুদয় তোমার সাধুতার অনুরূপই হইয়াছে। এক্ষণে আমার হিতসাধনের উপায় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। নকুলকে দেখিয়া আমি যারপরনাই ভীত হইয়াছি; আর ক্ষুদ্রাশয় উলূক আমার প্রাণ সংহার করিতে উদ্যত হইয়াছে; অতএব এক্ষণে আমি তোমার ক্রোড়ে প্রবেশ করিব; তুমি আমাকে বিনষ্ট করিও না। আমি শপথ করিয়া কহিতেছি, তোমার পাশবন্ধন ছেদন করিয়া তোমাকে মুক্ত করিব।’
মার্জ্জার-মূষিকের মিত্ৰতা—মার্জ্জারের পাশকর্ত্তন
“তখন সেই সুহৃদ্ভাবাপন্ন মার্জ্জার মূষিকের যুক্তিসঙ্গত বাক্যশ্রবণে প্রীতমনে তাহার সমুচিত সৎকার করিয়া কহিল, ‘ভদ্র! তুমি অচিরাৎ আমার ক্রোড়ে প্রবেশ কর। তুমি আমার প্রাণতুল্য প্রিয়সখা। তোমার প্রসাদে আমি বন্ধনমুক্ত হইয়া জীবন লাভ করিতে সমর্থ হইব। অতঃপর তুমি আমায় সাধ্যমত যাহা যাহা আজ্ঞা করিবে, আমি তৎসমুদয় প্রতিপালন করিব। এক্ষণে আইস, আমরা উভয়ে সন্ধি স্থাপন করি। আমি এই সঙ্কট হইতে মুক্ত হইয়া বন্ধুবান্ধবের সহিত তোমার সমুদয় হিতকাৰ্য্য-সম্পাদন, প্রীতিসাধন ও যথোচিত সৎকার করিব। লোকে পূৰ্ব্বোপকারীর প্রভূত প্রত্যুপকার করিয়া তাহার তুল্য প্রশংসাভাজন হইতে পারে না। কেন না, প্রত্যুপকারী উপকৃত হইয়াছে বলিয়াই প্রত্যুপকার করে, কিন্তু পূৰ্ব্বোপকারী নিষ্কারণেই উপকার করিয়া থাকে।
“এইরূপে মার্জ্জার স্বার্থসাধনার্থ সন্ধিস্থাপন করিলে মূষিক বিশ্বস্তচিত্তে সেই শত্রুর ক্রোড়মধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক তাহার বচনে আশ্বাসিত হইয়া পিতামাতার ক্রোড়ের ন্যায় তথায় শয়ন করিয়া রহিল। তখন নকুল ও উলূক মার্জ্জার ও মূষিকের প্রতিদর্শনে অতিশয় চমৎকৃত হইয়া ভীতচিত্ত ও মূষিকভক্ষণে নিতান্ত নিরাশ হইল। উহারা বুদ্ধিমান ও বীৰ্য্যসম্পন্ন হইয়াও তৎকালে বিড়াল ও মূষিকের নীতিভঙ্গে সমর্থ হইল না, প্রত্যুত তাহাদিগের স্ব স্ব কাৰ্য্যসাধনার্থ সন্ধিসংস্থাপনে কৃতকার্য্য অবগত হইয়া অবিলম্বে স্ব স্ব আবাসে প্রস্থান করিল।
“অনন্তর সেই দেশকালজ্ঞ মূষিক মার্জ্জারের ক্রোড়ে শয়ন করিয়া সময় প্রতীক্ষা করিয়া ক্রমে ক্রমে তাহার পাশ ছেদন করিতে আরম্ভ করিল। মার্জ্জার বন্ধনদশায় একান্ত ক্লিষ্ট হইয়াছিল, সুতরাং মূষিককে শনৈঃ শনৈঃ পাশ ছেদন করিতে দেখিয়া নিতান্ত ব্যগ্র হইয়া কহিল, ‘ভাই! তুমি ত’ কৃতকার্য্য হইয়াছ, তবে কি নিমিত্ত পাশচ্ছেদনে সত্বর হইতেছ না? ব্যাধ অবিলম্বেই এ স্থানে আগমন করিবে, অতএব শীঘ্র পাশ ছেদন কর।’
‘মার্জ্জার এই কথা কহিবামাত্র বুদ্ধিমান মূষিক তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘মিত্র! তুমি স্থির হও, তোমার ব্যস্ত বা ভীত হইবার কিছুমাত্র আবশ্যকতা নাই। আমি উপযুক্ত সময়, বিলক্ষণ অবগত আছি, উহা কখন উত্তীর্ণ হইবে না। অকালে কাৰ্য্য আরম্ভ করিলে তাহাতে কিছুমাত্র ফলোদয় হয় না। উপযুক্ত সময়ে উহা আরব্ধ হইলেই মহৎ উপকার উৎপাদন করিয়া থাকে। আমি অকালে তোমাকে মুক্ত করিয়া দিলে তোমা হইতেও আমার ভয় উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা; অতএব কাল প্রতীক্ষা কর; বৃথা ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই। চণ্ডালতনয় অস্ত্র ধারণপূর্ব্বক এখানে সমাগত হইলে আমাদিগের উভয়েরই ভয় উপস্থিত হইবে। আমি সেই সময়ই তোমার পাশ ছেদন করিয়া দিব। তাহা হইলে তুমি পাশবিমুক্ত হইয়া ভীতচিত্তে সত্বর বৃক্ষে আরোহণ করিবে, আমিও গর্ত্তমধ্যে প্রবেশ করিব। অতঃপর আমা হইতে তোমার জীবনরক্ষা ব্যতীত আর কিছু লাভের সম্ভাবনা নাই।
“মূষিক এই কথা কহিলে মহামতি মার্জ্জার মূষিককে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘সখে! আমি যেরূপ সত্বর হইয়া তোমাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছি, সাধুব্যক্তিরাও সেরূপে মিত্রকাৰ্য্য সাধন করেন না; অতএব আমার ন্যায় সত্বর হইয়াই আমার হিতসাধন করা তোমার কর্ত্তব্য। বিশেষতঃ বিলম্ব হইলে আমাদের উভয়েরই অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা; অতএব সত্বর আমাকে পাশ হইতে মুক্ত করিতে যত্ন কর। আর যদি তুমি পূৰ্ব্ববৈর স্মরণ করিয়া কালক্ষেপ কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তোমার আয়ুঃশেষ হইবে। যদি আমি অজ্ঞানতানিবন্ধন পূর্ব্বে তোমার কোন অপকার করিয়া থাকি, তাহা চিন্তা করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। এক্ষণে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি প্রসন্ন হও।’
“মার্জ্জার এইরূপ কহিলে, শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন মূষিক তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “মার্জ্জার! আমরা কেবল স্বার্থসাধনের নিমিত্তই পরস্পরের বাক্যে বিশ্বাস করিয়াছি; কিন্তু যে মিত্ৰতাতে ভয়ের বিলক্ষণ সম্ভাবনা, সর্পমুখে নিপতিত করতলের [সাপের মুখে হাত দেওয়ার] ন্যায় তাহা অতি সাবধানে রক্ষা করা আবশ্যক। বলবান্ ব্যক্তির সহিত সন্ধিসংস্থাপন করিয়া যত্নসহকারে আত্মরক্ষা না করিলে উহা অপথ্যসেবার ন্যায় অনর্থপাতের মুলীভূত হইয়া উঠে। এই ভূমণ্ডলে কেহই কাহারও নৈসর্গিক [স্বাভাবিক] শত্রু বা মিত্র নাই, কেবল কার্য্যবশতঃ পরস্পরের সহিত পরস্পরের শত্রুতা বা মিত্রতা জন্মিয়া থাকে। হস্তীদ্বারা যেমন বন্য মাতঙ্গ বদ্ধ হইয়া থাকে তদ্রূপ অর্থদ্বারা অর্থ সঞ্চিত হয়। কার্য্য সুসম্পন্ন হইলে আর কেহ কৰ্ত্তার সম্মান করে না। অতএব সকল কার্য্যেই শেষ রাখিয়া সম্পন্ন করা আবশ্যক। চণ্ডাল এখানে সমুপস্থিত হলে তুমি ভীত হইয়া আমাকে আক্রমণ না করিয়াই পলায়নে প্রবৃত্ত হইবে; অতএব সেই সময়েই আমি তোমাকে পাশ হইতে মুক্ত করিয়া দিব; এক্ষণে আমি প্রায় সমুদয় তন্তুই ছেদন করিয়াছি, একটিমাত্র অবশিষ্ট আছে, অচিরাৎ তাহাও ছেদন করিতেছি, অতএব তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া অবস্থান কর।
“তাহারা উভয়ে এইরূপ কথোপকথন করিতেছে, এমন সময়ে রজনী প্রভাত হইল। রাত্রি প্রভাত হইয়াছে দেখিয়া লোমশের অন্তঃকরণে ভয়ের পরিসীমা রহিল না। কিয়ৎক্ষণ পরে পরিঘনামে এক কৃষ্ণবর্ণ বিকটাকার ব্যাধ অসংখ্য কুক্কুর লইয়া তথায় সমুপস্থিত হইল। উহার নিতম্ব স্থূল, কর্ণ গর্দ্দভ-কর্ণের ন্যায় বিকৃত, বদন অতি ভীষণ ও বেশ যারপরনাই মলিন। মার্জ্জার সাক্ষাৎ যমদুতের ন্যায় সেই ব্যাধকে সদৰ্শন করিয়া অতিচিত্তে মূষিককে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “সখে! এখন কি করিবে?’ তখন মূষিক মার্জ্জারের পাশ ছেদন করিয়া দিল। মার্জ্জার পাশ হইতে বিমুক্ত হইবামাত্র অবিলম্বে বৃক্ষশাখায় আরূঢ় হইল; মূষিকও সেই ভীষণ শত্রুর হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করিয়া গর্ত্তমধ্যে প্রবেশ করিল। ক্ষণকাল পরে দণ্ডধারী ব্যাধ পাশের নিকট আগমনপূৰ্ব্বক চতুর্দ্দিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিল এবং পরিশেষে হতাশ হইয়া পাশ গ্রহণপূৰ্ব্বক গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল।
মার্জ্জার-মূষিকের পরস্পর আলাপ—মিত্রনীতি
“অনন্তর বৃক্ষস্থিত মার্জ্জার আপনাকে ঘোরতর বিপদ হইতে মুক্ত বিবেচনা করিয়া গৰ্ত্তস্থিত মূষিককে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, ‘সখে! তখন আমার সহিত বাক্যালাপ না করিয়া সহসা প্রস্থান করিয়াছ। আমি অকৃতজ্ঞ ও অকৃতবর্ম্মা বলিয়া কেহই আমার প্রতি আশঙ্কা করে না। তুমি তৎকালে আমার প্রতি বিশ্বাস ও আমাকে জীবন দান করিয়া এক্ষণে সুখানুভবসময়ে কি নিমিত্ত আমার নিকট আগমন করিতে পরাঙ্মুখ হইতেছ? যাহারা প্রথমতঃ মিত্ৰতা করিয়া পরিণামে তদনুরূপ কার্য্যানুষ্ঠান না করে, বিপদের সময় কখনই তাহাদিগের মিত্রলাভ হয় না। তুমি সাধ্যানুসারে আমার উপকার করিয়াছ। তুমি আমার পরমবন্ধু; অতএব মিত্ৰতানিবন্ধন আমার নিকট অবস্থানপূর্ব্বক সুখভোগ করা তোমার কর্ত্তব্য। শিষ্যগণ যেমন গুরুর সম্মান করে, তদ্রূপ আমার যাবতীয় বন্ধু বান্ধব তোমাকে পূজা করিবে; আমিও তোমাকে তোমার বন্ধুবান্ধবগণের সহিত যথোচিত সৎকার করিব। কোন্ কৃতজ্ঞ ব্যক্তি প্রাণদাতার সম্মান না করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে? তুমি আমার শরীর, গৃহ ও সমুদয় অর্থের অধিকারী হও এবং অমত্যপদে অভিষিক্ত হইয়া আমাকে পুত্রের ন্যায় শাসন কর। আমি স্বীয় জীবনদ্বারা শপথ করিয়া কহিতেছি যে, আমা হইতে তোমার কিছুমাত্র আশঙ্কা নাই। তুমি মন্ত্রণাবলে আমার জীবন রক্ষা করাতে আমি তোমাকে শুক্রের তুল্য বুদ্ধিমান, বলিয়া বোধ করিতেছি এবং তোমার মন্ত্রবল অসাধারণ বিবেচনা করিয়া তোমারই অধীন হইতে প্রতিজ্ঞারূঢ় [প্রতিজ্ঞা করিতে মনস্থির করা] হইয়াছি।’
“মার্জ্জার এই কথা কহিলে পর মন্ত্রণাবধারণক্ষম [উত্তম মন্ত্রণা নির্ণয়ে পটু] মূষিক আপনার হিতজনক অতি মধুরাক্যে তাহাকে কহিল, ‘সখে লোমশ! আমি তোমার বাক্য শ্রবণ করিয়াছি, তুমি যাহা কহিলে, তৎসমুদয়ই যথার্থ। এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। শত্রু মিত্র উভয়কেই উত্তমরূপে পরীক্ষা করা কর্ত্তব্য। কিন্তু ঐ পরীক্ষা অতি সূক্ষ্মজ্ঞানসাপেক্ষ [উহাতে সূক্ষ্মজ্ঞানের অপেক্ষা আছে—সূক্ষ্মজ্ঞান না থাকিলে ঐরূপ মন্ত্রণা হয় না]। অনেক সময়ে শত্রুগণ মিত্র এবং মিত্রগণও শত্রু বলিয়া প্রতিপন্ন হয় এবং যাহাদের সহিত সন্ধিস্থাপন করা যায়, তাহাদিগকে কামক্রোধের বশীভূত বলিয়া স্থির করা যায় না। এই জগতে কেহ কাহারও মিত্র নাই; কেবল সামর্থ্যনিবন্ধনই পরস্পরের শত্রুতা বা মিত্রতার সংঘটন হইয়া থাকে। যে জীবিত থাকিলে যাহার স্বার্থসিদ্ধি—যে দেহত্যাগ করিলে যাহার বিশেষ ক্ষতি হয়, সেই তাহার পরম মিত্র। চিরস্থায়ী মিত্রতা বা চিরস্থায়ী শত্রুতা প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হয় না। স্বার্থসাধন নিবন্ধন কালসহকারে শত্রু মিত্র এবং মিত্রও শত্রু হইয়া উঠে। অতএব স্বার্থকেই মিত্রতা ও শত্রুতা জন্মাইবার প্রধান কারণ বলিতে হইবে। যে ব্যক্তি মিত্রের প্রতি একান্ত বিশ্বাস ও শত্রুর প্রতি নিতান্ত অবিশ্বাস করে এবং স্বার্থবিষয়ে অনুধাবন না করিয়া মিত্র বা শত্রুর সহিত সন্ধিস্থাপনে প্রবৃত্ত হয়, তাহাকে স্থিরপ্রতিজ্ঞ বলিয়া গণনা করা যায় না। অবিশ্বাসী ব্যক্তির প্রতি কোনক্রমেই বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য নহে। বিশ্বস্ত ব্যক্তির প্রতিও সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করা যুক্তিবিরুদ্ধ। কারণ, বিশ্বাস হইতে যে ভয় উৎপন্ন হয়, তদ্বারা মূল পৰ্য্যন্ত বিনষ্ট হইবার সম্ভাবনা। কি পিতা, কি মাতা, কি শত্রু, কি মাতুল, কি ভাগিনেয়, কি অন্যান্য বন্ধুবান্ধবগণ সকলেই স্বার্থসাধনার্থ বশীভূত হইয়া থাকেন। এই জগতে সমুদয় লোকই আত্মরক্ষায় ব্যর্থ। পিতামাতা অতি প্রিয়পুত্রকেও পতিত বলিয়া অবগত হইলে জনসমাজে আপনাদের সম্ভ্রমরক্ষার্থ অচিরাৎ তাহাকে পরিত্যাগ করেন। অতএব স্বার্থপরতার কি অনিৰ্ব্বচনীয় প্রভাব!
‘এক্ষণে তুমি পাশ হইতে বিমুক্ত হইয়াই অনায়াসে স্বার্থসাধন করিবার চেষ্টা পাইতেছ, সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ তুমি নিতান্ত চঞ্চল। চঞ্চল ব্যক্তি অন্যের রক্ষায় যত্ন করা দূরে থাকুক, আত্মরক্ষায়ও সতর্ক হয় না। তুমি প্রথমে বটবৃক্ষ হইতে অবতীর্ণ হইয়া চপলতানিবন্ধন এখানে যে জাল বিস্তীর্ণ ছিল, তাহা কিছুই অনুধাবন কর নাই। ফলতঃ চঞ্চল ব্যক্তিরা বুদ্ধির অস্থৈর্য্যবশতঃ সৰ্ব্বদা সকল কাৰ্য্য নষ্ট করিয়া থাকে। এক্ষণে তুমি আমাকে যে প্রিয়তম বলিয়া মধুরবাক্যে সম্ভাষণপূর্ব্বক প্রলোভিত করিতেছ, উহা তোমার ভ্ৰমমাত্র। আমি যে কারণে উহা ভ্রম বলিয়া নির্দেশ, করিতেছি, তাহাও শ্রবণ কর। লোকে নিমিত্তবশতঃই অন্যের প্রিয় বা বিদ্বেষভাজন হইয়া থাকে। এই জগতে সমুদয় লোকই স্বার্থপরতার বশীভূত; ইহাতে কেহই কাহার যথার্থ প্রিয়পাত্র নাই। সহোদর ভ্রাতা ও দম্পতিদিগের পরস্পর প্রতিও নিষ্কারণ নহে। যদিও কখন কখন ভাৰ্য্যা ও সহোদর কারণবশতঃ ক্রুদ্ধ হইয়া পুনরায় স্বাভাবিক নিষ্কারণ প্রীতিশৃঙ্খলে সংযত হইয়া থাকে, কিন্তু যাহার সহিত কোন সংস্রব নাই, তাহার সহিত যে প্রীতি হইবে, ইহা নিতান্ত অসম্ভবপর, সন্দেহ নাই। কেহ দান, কেহ প্রিয়বাক্যপ্রয়োগ এবং কেহ বা মন্ত্রপাঠ, হোম ও জপদ্বারা অন্যের প্রিয় হইয়া থাকে। ফলতঃ লোকে যাহার দ্বারা কোন কাৰ্য্যসাধন করিতে পারে, তাহার প্রতিই প্রীতিপ্রদর্শন করে। সুতরাং প্রীতি কারণসাপেক্ষ। কারণের অসদ্ভাব হইলে প্রীতিরও অসদ্ভাব হইয়া থাকে। ইতিপূৰ্ব্বে কারণই আমাদিগের প্রণয়োৎপাদন করিয়াছিল। এক্ষণে তুমি যে আমাকে প্রীতিপ্রদর্শন করিতেছ, ইহার কারণ কি? তোমার অভ্যবহারলাভ ব্যতিরেকে উহার আর কোন কারণই অনুভূত হয় না। কিন্তু তুমি যাহাতে আমাকে ভক্ষণ করিতে না পার, আমিও তদ্বিষয়ে বিলক্ষণ সতর্ক আছি।
‘কাল হেতুকে আবিষ্কৃত [প্রকাশ] করিয়া দেয়। হেতু কখনই স্বার্থশূন্য হইতে পারে না। যিনি সেই স্বার্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন, তিনিই বিজ্ঞ এবং লোকে তাঁহারই অনুবৃত্তি করিয়া থাকে। আমি স্বার্থবিষয়ে বিলক্ষণ অভিজ্ঞ, সুতরাং আমাকে এইরূপ বলা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে না। তুমি অসময়ে আমার প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করিতেছ। অতএব আমি কদাচ স্বস্থান হইতে বিচলিত হইব না। সন্ধি বা বিগ্রহবিষয়ে আমার বিলক্ষণ জ্ঞান আছে। মেঘ যেমন প্রতিক্ষণেই আপনার আকার পরিবর্ত্তন করিয়া থাকে, তোমার ভাব তদ্রূপ পরিবর্ত্তিত হইতেছে। তুমি অদ্যই আমার শত্রু ছিলে, আবার অদ্যই মিত্র হইয়াছ; সুতরাং তোমার যুক্তির কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। যতক্ষণ পর্য্যন্ত আমাদের প্রয়োজন ছিল, ততক্ষণ আমরা উভয়ের সদ্ভাব প্রদর্শন করিয়াছিলাম। কিন্তু এক্ষণে সেই প্রয়োজনের সহিত সদ্ভাবও অন্তর্হিত হইয়াছে। তুমি আমার স্বাভাবিক শত্রু; কাৰ্য্যবশতঃ মিত্র হইয়াছিলে। এক্ষণে সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন হওয়াতে তুমিও পূৰ্ব্ববৎ শত্রু হইয়াছ। অতএব বল দেখি, আমি এইরূপ নীতিশাস্ত্র সম্যক অবগত হইয়া তোমার আহারের নিমিত্ত কি প্রকারে পাশমধ্যে প্রবেশ করিব? আমি তোমার বলবীর্য্যে মুক্তিলাভ করিয়াছি এবং তুমিও আমার প্রভাবে পরিত্রাণ পাইয়াছ। এইরূপে আমরা স্বার্থসাধনের নিমিত্তই পরস্পর পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়াছি। এক্ষণে পুনৰ্ব্বার কিরূপে আমাদিগের সমাগম হইতে পারে? আমার বিলক্ষণ বোধ হইতেছে যে, আমাকে ভক্ষণ করা ব্যতিরেকে তোমার আর কোন অভিসন্ধি নাই।
‘আমি ভোক্ষ্য, তুমি ভোক্তা; আমি দুর্ব্বল, তুমি বলবান; সুতরাং আমাদিগের উভয়ের সন্ধিস্থাপন কি প্রকারে পণ্ডিতদিগের অনুমোদিত হইতে পারে? এক্ষণে তুমি পাশ হইতে বিমুক্ত হইয়া অনায়াসে আমাকে ভক্ষণ করিবার মানসে আমার প্রশংসা করিতেছ। তুমি ক্ষুধাতুর হইয়া ভক্ষণ করিবার নিমিত্তই পাশবদ্ধ হইয়াছিলে, এক্ষণে পাশমুক্ত হইয়া ক্ষুধায় পূৰ্ব্বাপেক্ষা সমধিক কাতর হইয়াছ। তোমার আহারের সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, সুতরাং কৌশলক্রমে আমাকে ভক্ষণ করাই তোমার অভিসন্ধি, সন্দেহ নাই। আর যদিও তোমার আমাকে ভক্ষণ করিতে অভিলাষ না থাকে, তথাপি তোমার সহিত সন্ধিস্থাপন ও তোমার শুশ্রূষাগ্রহণে অনুমোদন করা যুক্তিসঙ্গত নহে। তোমার পুত্র কলত্ৰসমুদয় বিদ্যমান রহিয়াছে। তাহারা সকলেই তোমার নিতান্ত প্রিয়। উহারা আমাকে সমভিব্যাহারী দেখিয়া কি নিমিত্ত ভক্ষণ করিতে বিরত হইবে? অতএব আমি আর তোমার সহিত সংস্রব রাখিব না। সংস্রব রাখিবার কারণ অতিক্রান্ত হইয়াছে। এক্ষণে তুমি যদি কৃতজ্ঞ হও, তাহা হইলে আমার শুভানুধ্যান কর। যে শত্রু অভদ্র এবং যে ক্ষুধায় কাতর হইয়া খাদ্যদ্রব্যের অনুসন্ধান করিতেছে, বিজ্ঞ ব্যক্তি তাহার সন্নিধানে কিরূপে গমন করিবে? এক্ষণে তোমার মঙ্গল হউক; আমি চলিলাম। তোমাকে দূর হইতে দেখিয়াও আমার অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইতেছে। অতএব আমি কিছুতেই তোমার সহিত সংস্রব রাখিব না। তুমি এই অধ্যবসায় হইতে নিবৃত্ত হও। আর যদি তুমি কৃতজ্ঞ হইতে বাসনা কর, তবে আমি অনবহিত [অসাবধান] থাকিলে কদাচ আমার অনুসরণ করিও না। বলবান্ ব্যক্তির সহিত দুৰ্ব্বলের সংস্রব কদাচ প্রশংসনীয় নহে। ভয়ের কারণ অতিক্রম হইলেও বলবান্ ব্যক্তি হইতে সতত ভয় করা কর্ত্তব্য। এক্ষণে যদি আমা হইতে তোমার অন্য কোন হিতসাধনের উদ্দেশ্য থাকে, তবে বল, সাধ্যানুসারে তাহা সম্পাদন করিব। আমি আত্মপ্রদান ব্যতিরেকে আর সমস্ত বস্তুই প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। লোকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত পুত্র, কলত্র, রাজ্য ও ধন প্রভৃতি সমুদয় পরিত্যাগ করিয়া থাকে। অধিক কি, সর্ব্বস্বান্ত করিয়াও আত্মরক্ষা করা উচিত। আত্মরক্ষা করিবার নিমিত্ত শক্তহস্তে যেসমস্ত ধনরত্ন প্রদান করা যায়, জীবিত থাকিলে পুনৰ্ব্বার তৎসমুদয় হস্তগত হইবার সম্ভাবনা। কিন্তু আত্মসমর্পণ করিলে ধনরত্নের ন্যায় উহা পুনরায় ধন দিয়াও হস্তগত হয় না। শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে যে, স্ত্রী ও সমস্ত ধন দিয়াও আত্মরক্ষা করা কৰ্ত্তব্য। যাহারা আত্মরক্ষায় তৎপর ও বিমৃষ্যকারী [বিবেচনাপূৰ্ব্বক কার্য্যকারক], তাহারা কদাচ আত্মদোষজ আপদে আক্রান্ত হয় না। যেসমস্ত দুর্ব্বল ব্যক্তি আপনার শত্রুর বলবত্তা অবগত হইতে পারে, তাহাদিগের শাস্ত্রার্থদর্শিনী [শাস্ত্রের মর্ম্ম প্রদর্শনে সমর্থ] সুদৃঢ় বুদ্ধি কদাচ বিচলিত হয় না।’
‘মূষিক বিড়ালকে এইরূপে ভৎসনা করিলে, বিড়াল যারপরনাই লজ্জিত হইয়া তাহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিতে লাগিল, মূষিক! আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, তোমার কোন অনিষ্ট চিন্তা করি নাই। মিত্রের অনিষ্টাচরণ করা অতিশয় গর্হিত কাৰ্য্য সন্দেহ নাই। তুমি যে আমার হিতানুষ্ঠানে নিরত, তাহা আমি বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম করিতেছি, এরূপ আশঙ্কা করা তোমার উচিত নহে। তুমি আমার প্রাণ দান করিয়াছ বলিয়া তোমার সহিত আমার বন্ধুত্ব জন্মিয়াছে। আমি ধৰ্ম্মপরায়ণ, গুণ, কৃতজ্ঞ, মিত্রবৎসল, বিশেষতঃ এক্ষণে তোমার প্রতি একান্ত অনুরক্ত হইয়াছি। অতএব আমা হইতে তোমার যে অনিষ্ট ঘটিবে, তাহা কি সম্ভবপর হয়? তুমি আজ্ঞা করিলে আমি সবান্ধবে প্রাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে পারি; অতএব আমার সদৃশ মনস্বীর প্রতি বিশ্বাস করা তোমার অতীব কৰ্ত্তব্য। তুমি আমার প্রতি কিছুতেই আশঙ্কা করিও না।’
“মার্জ্জার এইরূপে স্তব করিলেও মূষিক গম্ভীরভাবে তাহাকে কহিল, ‘লোমশ! তুমি সাধু; তুমি যে সমস্ত কথা কহিলে, আমি তাহা সমুদয়ই শ্রবণ করিলাম। কিন্তু পণ্ডিতেরা কহেন, যে ব্যক্তি নিতান্ত প্রিয়, তাহার প্রতিও বিশ্বাস করিবে না। অতএব তুমি আমাকে স্তবই কর আর ধনই দাও, কিছুতেই আমার বিশ্বাস উৎপাদন করিতে সমর্থ হইবে না। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা স্বার্থসাধন ব্যতীত কদাচ শত্রুর বশীভূত হয় না। এই বিষয়ে শত্রুরা যেরূপ অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়াছেন, তুমি তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। বলবান শত্রুর সহিত সন্ধি করিয়া সতত সাবধানে অবস্থান করিবে এবং কৃতকার্য্য হইয়াও তাহাকে বিশ্বাস করিবে না। অবিশ্বস্তের প্রতি ত’ কোনক্রমে বিশ্বাস করিবে না; বিশ্বস্তের প্রতি অতিশয় বিশ্বাস করাও কৰ্ত্তব্য নহে। যত্নসহকারে অন্যের বিশ্বাস উৎপাদন করিবে, কিন্তু অন্যকে কদাচ বিশ্বাস করিবে না। অতএব সকলের প্রতিই সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করিয়া সকল অবস্থায় যত্নসহকারে আত্মরক্ষা করা কর্ত্তব্য। আত্মরক্ষা করিতে পারিলে পরিশেষে ধনপুত্রাদি সমুদয় লাভ হইয়া থাকে। অন্যের প্রতি অবিশ্বাসই নীতিশাস্ত্রকারদিগের সার মত। সুতরাং অন্যের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করিয়া কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলে আপনার যথেষ্ট ইষ্টলাভ হইয়া থাকে। যাহারা কাহারও প্রতি বিশ্বাস না করে, তাহারা দুৰ্ব্বল হইলে শত্রুগণ তাহাদিগকে বিনষ্ট করিতে পারে না। আর যাহারা সকলের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, তাহারা বলবান হইলেও দুর্ব্বল শত্ৰুকর্ত্তৃক নিহত হইতে পারে। হে মার্জ্জার! তুমি আমার অবিশ্বস্ত শত্রু, সুতরাং তোমা হইতে আত্মরক্ষা করা আমার নিতান্ত কর্ত্তব্য। আর তোমারও জাতিসুলভ পাপাচরণ হইতে আত্মরক্ষা করা উচিত।’
“মূষিক এই কথা কহিলে মার্জ্জার চণ্ডালের ভয়ে ভীত হইয়া শাখা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মহাবেগে পলায়ন করিল। তখন মূষিকও স্বীয় শাস্ত্ৰতত্ত্ব অনুযায়ী বুদ্ধিসামর্থ্য প্রদর্শনপূৰ্ব্বক এক বিবরমধ্যে প্রবিষ্ট হইল।
শত্রু-মিত্র ব্যবহারবিষয়ক বিবিধ নীতি
“হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে বুদ্ধিমান মূষিক একান্ত দুর্ব্বল হইয়াও প্রজ্ঞাবলে মহাবলপরাক্রান্ত বহুসংখ্যক শত্রুর হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছিল; অতএব সুচতুর ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত বলবান শত্রুর সহিত সন্ধি করিবে। দেখ, মূষিক ও মার্জ্জার পরস্পরের সাহায্যে পরস্পর অনায়াসে মুক্তিলাভ করিল। আমি দৃষ্টান্ত প্রদর্শনপুৰ্ব্বক সবিস্তর ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে উহা আবার সংক্ষেপে কহিতেছি, শ্রবণ কর। যাহারা একবার বৈরোৎপাদনপূর্ব্বক পুনরায় পরস্পর প্রতিস্থাপন করে, পরস্পরকে প্রতারণা করাই তাহাদিগের উদ্দেশ্য। তন্মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আপনার বুদ্ধিকৌশলে অন্যকে প্রতারণা করিতে সমর্থ হয়; আর নির্ব্বোধ ব্যক্তি আপনার অনবধানতাদোষে প্রতারিত হইয়া থাকে। অতএব ভীত হইলেও নির্ভীকের ন্যায় এবং অন্যের প্রতি অবিশ্বাস থাকিলেও বিশ্বস্তের ন্যায় ব্যবহার করিবে। যে সতত এইরূপে সাবধান হয়, সে কখনই বিচলিত হয় না, বিচলিত হইলেও এককালে বিনষ্ট হয় না। উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইলে শত্রুর সহিত সন্ধি করিবে এবং সময়ানুসারে মিত্রের সহিতও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে। এইরূপ সিদ্ধান্ত সন্ধিবিগ্রহবিৎ পণ্ডিতদিগের অনুমোদিত, সন্দেহ নাই। হে মহারাজ! এইরূপ শাস্ত্ৰাৰ্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়া ভয় উপস্থিত হইবার পূর্বেই প্রসন্নমনে সাবধানে ভীত হইয়া অবস্থান করিবে। ভয় উপস্থিত হইবার পূৰ্ব্বে সভয় ব্যবহার ও অন্যের সহিত সন্ধি করা অবশ্য কর্ত্তব্য। সাবধানতা ও ভয় হইতে সূক্ষ্মবুদ্ধি উৎপন্ন হইয়া থাকে। যাহারা ভয় উপস্থিত না হইতে ভীত হয়, তাহাদিগের কিছুতেই ভয় জন্মে না। আর যাহারা নির্ভীক্চিত্তে সকলের প্রতি বিশ্বাস করে, তাহাদিগের সৰ্ব্বদাই ভয় উপস্থিত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি আপনাকে বিজ্ঞ জানিয়া নির্ভীচিত্তে অবস্থান করে, সে অন্যের মন্ত্রণা কিছুতেই শ্রবণ করে না; আর যে ব্যক্তি ভয়শীল, সে আপনাকে অজ্ঞ বিবেচনা করিয়া বিজ্ঞানদশী পণ্ডিতের নিকট সতত গমন করিয়া থাকে। অতএব বিজ্ঞ ব্যক্তি ভীত হইয়া অতীতের ন্যায় অবস্থান ও অবিশ্বস্তের সমক্ষে বহুতর বিশ্বাস প্রদর্শন করিবে এবং গুরুতর কাৰ্য্যভারে আক্রান্ত হইয়াও লোকের সহিত কিছুতেই মিথ্যা ব্যবহার করিবে না।
“হে যুধিষ্ঠির! এই আমি পূর্ব্বতন নীতিশাস্ত্রবেত্তাদিগের মত এবং মূষিক ও বিড়ালের প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে তুমি ইহা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিয়া ইহার অনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান এবং শত্ৰুমিত্রের প্রভেদ, সন্ধিবিগ্রহের প্রকৃত অবসর ও আপদমুক্তির উপায় অবধারণ কর। বলবান্ শত্রুর সহিত কোন এক কাৰ্য্য সাধন করিতে হইবে জানিতে পারিলে তাহার সহিত সন্ধি করিয়া সাবধানে ব্যবহার করিবে এবং কৃতকাৰ্য্য হইয়াও তাহাকে সম্যক্ বিশ্বাস করিবে না। এই নীতি ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গেরই অবিরুদ্ধ। তুমি ইহা হৃদয়ঙ্গম করিয়া অভ্যুদয়শালী ও পুনরায় প্রজারঞ্জনে প্রবৃত্ত হও। তুমি সতত ব্রাহ্মণগণের সহিত সংস্রব রাখিবে। ব্রাহ্মণেরা ইহলোক ও পরলোকে পরম শেয়োলাভের হেতু। উহারা ধৰ্ম্মবেত্তা, কৃতজ্ঞ, শুভানুধ্যায়ী; অতএব উহাদিগকে সতত সক্কার করিবে। তাহা হইলে তাহাদিগেরই প্রসাদে তোমার রাজ্য, যশ, কীৰ্ত্তি ও সন্ততিলাভ হইবে, সন্দেহ নাই। এক্ষণে আমি যে মার্জ্জারমূষিকের সন্ধিবিগ্রহাত্মক [মিত্ৰতাকারক ও বিবাদবিষয়ক] বুদ্ধিসংস্কারসম্পাদক [বুদ্ধিপরিমার্জ্জক–বুদ্ধির মালিন্যনাশক] সংবাদ কীৰ্ত্তন করিলাম, ধীমান মহীপাল বিপক্ষ-মণ্ডলীমধ্যে ইহার অনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিবেন।”