১৩১তম অধ্যায়
উশীনর উপাখ্যান
“তখন শ্যেনরূপী ইন্দ্ৰ উশীনরের সমীপবর্ত্তী হইয়া কহিলেন, ‘হে রাজন! সমুদয় ভূপালগণ। আপনাকে ধর্ম্মাত্মা বলিয়া নির্দেশ করেন, অতএব আপনি কি নিমিত্ত ধর্ম্মবিরুদ্ধ কর্ম্ম করিতে অভিলাষী হইলেন? আমি ক্ষুধায় একান্ত কাতর হইয়াছি; আপনি ধর্ম্মলাভলোভে কদাচ আমার চিরবিহিত ভক্ষ্য কপোতকে রক্ষা করিবেন না, তাহা হইলে আপনাকে ক্ষুধার্তের আহারহরণজন্য পাপে অবশ্যই লিপ্ত হইতে হইবে।”
উশীনরের আশ্রিতবাৎসল্য
“রাজা কহিলেন, “হে বিহগরাজ! এই কপোত তোমার ভয়ে ভীত হইয়া জীবিত-প্রত্যাশায় আমার শরণাপন্ন হইয়াছে; অতএব ইহাকে পরিত্যাগ না করাই পরমধর্ম্ম, তাহা কি তুমি জান না? এই কপোত প্রাণভয়ে পলায়ন করিয়া জীবনরক্ষার্থ আমার নিকট উপস্থিত হইয়াছে; এক্ষণে ইহাকে পরিত্যাগ করা অতি গৰ্হিত। ব্ৰহ্মহত্যা ও গোহত্যা করিলে যেরূপ পাপ হয়, শরণাগত ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিলে তদ্রূপ পাপ জন্মে।”
“শ্যেন কহিল, “মহারাজ! সমুদয় জীব আহার হইতে উৎপন্ন হইয়া আহারদ্বারাই পরিবর্দ্ধিত হয় এবং আহার করিয়াই জীবিত থাকে। জীবগণ দুস্ত্যাজ্য অর্থ পরিত্যাগ করিয়াও চিরকাল জীবিত থাকিতে পারে, কিন্তু ভোজন পরিত্যাগ করিলে কদাচি জীবনরক্ষা হয় না; অতএব আহারবিরহে আমার প্রাণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া অকুতোভয়ে প্রস্থান করিবে। আমার মৃত্যু হইলে পুত্ৰকলাত্র প্রভৃতি পরিবারবর্গও বিনষ্ট হইবে। হে মহারাজ! আপনি একটি প্রাণীর প্রাণরক্ষা করিবার নিমিত্ত বহু প্ৰাণীর প্রাণসংহার করিতে উদ্যত হইয়াছেন। হে সত্যবিক্ৰম! যে ধর্ম্ম ধর্ম্মান্তরবিরোধী তাহা কখন ধর্ম্ম নহে, পরস্পর অবিরোধী ধর্ম্মই প্রকৃত ধর্ম্ম, অতএব যাহাতে বাধা নাই, সেই ধর্ম্মেরই অনুষ্ঠান করিবে অথবা উভয় ধর্ম্মের পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হইলে তাহার লাঘব ও গৌরব বিবেচনাপূর্ব্বক যাহাতে অধিকতর লাভের সম্ভাবনা, তাহারই অনুসরণ করিবে।”
“রাজা কহিলেন, ‘হে বিহগবর! তুমি কি অসন্দিহান ধর্ম্মজ্ঞ তুমি যেরূপ কল্যাণকর বাক্য কহিতেছ, ইহাতে বোধ হয়, তোমার কিছুই অবিদিত নাই। হে বিহঙ্গম! তুমি কি প্রকারে শরণার্থীকে পরিত্যাগ করা সাধুধর্ম্ম বলিয়া অঙ্গীকার করিতেছ? ভোজনই তোমার প্রয়োজন, অতএব তুমি অন্য প্রকারে অধিকতর আহার আহরণ করিতে পার; আমিও আজি তোমার নিমিত্ত গো, বৃষ, বরাহ, মৃগ, মহিষ প্রভৃতি পশু আহরণ করিতে পারি অথবা অন্য কোন বস্তুতে অভিলাষ হইলে তাহাও এক্ষণে প্ৰস্তুত হইতে পারে।”
“শ্যেন কহিল, “হে মহীপাল! মৃগ, বরাহ প্রভৃতি কোন জন্তুকেই আমি ভক্ষণ করি না, অতএব অন্য কোন প্ৰাণীতে প্রয়োজন নাই। বিধাতা আমার যে আহার বিধান করিয়াছেন, আমাকে তাহাই প্ৰদান করুন। শ্যেনপক্ষী কপোতকে ভক্ষণ করে, আমাদের এই চিরন্তন বিধি নির্দ্দিষ্ট আছে। হে রাজন! সারাংশ পরীক্ষা না করিয়া কদলীতে আসক্ত হইবেন না।”
“রাজা কহিলেন, “হে পতঙ্গম! তোমাকে শিবিদিগের সুসমৃদ্ধ রাজ্য প্রদান করিতেছি; অথবা আর যাহা কিছু প্রার্থনা কর তৎসমুদয় প্রদান করিতে প্ৰস্তুত আছি, কিন্তু এই শরণাগত ভীত কপোতকে কোনক্রমেই পরিত্যাগ করিব না। যেরূপ কর্ম্ম করিলে তুমি এই পক্ষীকে পরিত্যাগ করিতে সম্মত হও, বল, আমি এক্ষণেই উহা সম্পন্ন করিব, তথাপি এই কপোতকে প্রদান করিব না।
“শ্যেন কহিল, “হে নরাধিপ! যদ্যপি এই কপোত আপনার স্নেহভাজন হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনি আত্মমাংস-কর্ত্তন করিয়া তুলাদ্বারা কপোতের সহিত পরিমাণ করুন। যখন সেই মাংস কপোতভারের সমতুল্য হইবে, তখন তাহা আমাকে প্রদান করিবেন, তাহা হইলেই আমি পরম পরিতুষ্ট হইব।” রাজা কহিলেন, “হে শ্যেন! তুমি আমার নিকটে এই প্রার্থনা করিয়া সাতিশয় অনুগ্রহপ্রকাশ করিলে, আমি এক্ষণেই আপন মাংস কপোতের সহিত তুলাতে পরিমাণ করিয়া তোমাকে প্রদান করিতেছি।”
উশীনরের আত্মমাংসদনে পরপ্রাণরক্ষা
“পরম-ধার্ম্মিক রাজা উশীনর এইরূপ অঙ্গীকার করিয়া আপন মাংস কর্ত্তন করিয়া তুলাযন্ত্রে প্রদানপূর্ব্বক কপোতের বিপরীতভাগে অর্পণ করিলে, কপোত-ভারই গুরুতর হইয়া উঠিল। তখন তিনি পুনর্ব্বার আত্মমাংস-কর্ত্তন করিয়া তাহাতে প্ৰদান করিলেন, তথাপি কপোতের সমান হইল না। সমুদয় মাংস নিঃশেষে কর্ত্তন করিলেও যখন কপোতের সমতুল্য হইল না, তখন স্বয়ং সেই তুলাতে আরোহণ করিলেন।
‘শ্যেন কহিল, “হে ধর্ম্মজ্ঞা! আমি ইন্দ্র এবং এই কপোত হুতাশন। আমরা তোমার ধার্ম্মিকতা পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হইয়াছি। তুমি আপন গাত্র হইতে মাংস-কর্ত্তন করিয়া যে সমুজ্জ্বল কীর্ত্তি সংস্থাপন করিলে, উহা সমুদয় লোকে প্রথিত হইবে। যাবৎ মনুষ্যকুল তোমার নাম কীর্ত্তন করিবে, তাবৎ তোমার কীর্ত্তিও পুণ্যলোকে অক্ষয় হইয়া থাকিবে।” দেবরাজ পাকশাসন ও হুতাশন এই কথা কহিয়া সুরলোকে প্রস্থান করিলেন। রাজা উৰ্শণীনরও ধর্ম্ম-প্রভাবে স্বৰ্গ-মর্ত্য উজ্জ্বল করিয়া দেদীপ্যমানকলেবর হইয়া স্বৰ্গে আরোহণ করিলেন।
“হে রাজন! এই সেই মহাত্মা উশীনরের নিকেতন অবলোকন করুন। এই স্থান অতিপবিত্র ও কলুষনাশন। পুণ্যবান মহোদয়েরা এই স্থানে দেব ও সনাতন ঋষিগণকে দর্শন করিয়া থাকেন।”