০৯৮. দ্রোণ-সাত্যকির তুমুল যুদ্ধ

৯৮তম অধ্যায়

দ্রোণ-সাত্যকির তুমুল যুদ্ধ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! বৃষ্ণিপ্রবীর মহাবীর সাত্যকি দ্রোণনির্ম্মুক্ত শর ছেদনপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নকে মুক্ত করিলে শস্ত্রধারিগণের অগ্রগণ্য মহাধনুর্দ্ধর দ্রোণাচাৰ্য্য সাত্যকির উপর ক্রুদ্ধ হইয়া কি রূপে সংগ্রাম করিলেন?”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! তখন মহাবীর দ্রোণাচার্য্য ক্রোধভরে শরাসন গ্রহণ করিয়া স্বর্ণপুঙ্খ শর ও নারাচ-সমুদায় নিক্ষেপ করিয়া ব্যাদিতাস্য বিকটিতদন্ত, তাম্ৰাক্ষ মহাসর্পের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাত্যকির অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তাঁহার লোহিতবর্ণ অশ্বগণ এরূপ বেগে গমন করিতে লাগিল যে, দর্শন মাত্র বোধ হয় উহারা আকাশ মার্গে গমন বা পর্ব্বতোপরি সমুত্থান করিতেছে। তখন শত্রুজেতা মহাশূর সাত্যকি শক্তি খড়্গধারী অমর্ষ পরায়ণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে বেগশালী রথে আরোহণ পূর্ব্বক কাৰ্ম্মুক আকর্ষণ এবং অসংখ্য শর ও নারাচ নিক্ষেপ করত অশনিনির্ঘোষশালী বারিধারাবর্ষী বায়ুবেগচালিত বিদ্যুদ্দামরঞ্জিত মহামেঘের ন্যায় আগমন করিতে দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করত সারখিকে কহিলেন, হে সূত! তুমি অবিলম্বে এই স্বধর্ম্ম বিবর্জিত দুর্য্যোধনের আশ্রিত রাজপুত্রদিগের আচার্য্য শূরাভিমানী ব্রাহ্মণের অভিমুখে অশ্ব পরিচালন কর। সারথি সাত্যকির বাক্যানুসারে তৎক্ষণাৎ রজতশুভ্র বায়ুবেগসম শীঘ্রগামী অশ্বগণকে দ্রোণাচার্য্যের সমীপে সমানীত করিল।

হে মহারাজ! অনন্তর অরাতিনিপাতন দ্রোণাচাৰ্য্য ও শিনিবংশাবতংস সাত্যকি উভয়ে তুমুল সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া পরস্পরের প্রতি বারিধারার ন্যায় বহু সহস্র শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ঐ মহাবীরদ্বয়ের শরজালে আকাশমার্গ ও দশদিক সমাচ্ছন্ন হইলে প্রভাকরের প্রভাবিনাশ ও সমীরণের গতি রোধ হইল। এইরূপে উভয়ের বাণ-বর্ষণে রণস্থল নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হইলে অন্যান্য বীরগণ উহা নিতান্ত অনিবার্য্য বোধ করিয়া সংগ্রাম পরিত্যাগ পূর্ব্বক অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন নরশ্রেষ্ঠ দ্রোণ ও সাত্যকি অবিশেষে পরস্পরের উপর শর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। ধারাভিঘাতজ তাঁহাদের শরসন্নিপাতের গভীর শব্দ দেবরাজ প্রেরিত অশনিনিস্বনের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। নারাচবিদ্ধ বীরগণের কলেবর আশীবিষবিদষ্ট সর্পের ন্যায় অতি ভীষণ হইয়া উঠিল। যুদ্ধোন্মত্ত মহাবীর দ্রোণ ও সাত্যকির নিরন্তর জ্যানির্ঘোষ বজ্রাহত শৈল শৃঙ্গের শব্দের ন্যায় শ্রবণগোচর হইতে লাগিল। উভয়ের রথ, সারথি ও অশ্ব সমুদায় স্বর্ণপুংঙ্খ শরে বিদ্ধ হইয়া বিচিত্র শোভা ধারণ করিল। অকুটিল নির্ম্মল নারাচ নির্ম্মোকনির্ন্মুক্ত ভুজঙ্গমের ন্যায় নিপতিত হইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁহারা উভয়ে উভয়ের ছত্র ও ধ্বজ ছেদন পূর্ব্বক মদস্রাবী বারণদ্বয়ের ন্যায় শোণিতাক্তকলেবর হইয়া বিজয় বাসনায় পরস্পরের প্রতি জীবিতান্তকর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন।

দ্রোণ কর্ত্তৃক সাত্যকির সমর প্রশংসা

হে মহারাজ! ঐ সময় সেনাগণের গর্জ্জন ও উৎক্রোশ এবং শঙ্খদুন্দুভির নিস্বন এককালে তিরোহিত হইল। সৈন্যসকল তুষ্ণীম্ভূত ও যোদ্ধৃবর্গ যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইয়া কৌতুহলাক্রান্ত চিত্তে দ্রোণ ও সাত্যকির দ্বৈরথ যুদ্ধ অবলোকন করিতে লাগিল। যাবতীয় রথী, গজারোহী, অশ্বারোহী ও পদাতিগণ তাঁহাদের উভয়ের চতুর্দ্দিকে ব্যূহ নির্ম্মাণ পূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইয়া অনিমিষ নয়নে যুদ্ধ দর্শন করিতে আরম্ভ করিল। মুক্তাবিদ্রুম শোভিত মণিকাঞ্চন বিভূষিত ধ্বজ, বিচিত্র আভরণ, হিরন্ময় কবচ, পতাকা, চিত্ৰকম্বল, নির্ম্মল শাণিত শস্ত্র, বাজিগণের চামর এবং গজ সমুদায়ের সুবর্ণ ও রজতনির্মিত কুম্ভমালা ও দন্তবেষ্টনের প্রভা প্রভাবে সেনা নিচয় বকপংক্তিবিরাজিত খদ্যোতসমুদ্যোতিত সৌদামিনী-সম্বলিত বর্ষাকালীন জলপটলের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল। এইরূপে উভয়পক্ষীয় সেনাগণ মহাত্মা সাত্যকি ও দ্রোণাচার্য্যের সেই অপূর্ব্ব যুদ্ধ দর্শন করিতে আরম্ভ করিল। ব্রহ্মা ও চন্দ্র প্রভৃতি দেবতা এবং সমুদায় সিদ্ধ, চারণ, বিদ্যাধর ও মহোরগগণ বিমানাগ্রে অবস্থানপূর্ব্বক সেই বীরদ্বয়ের বিচিত্র গমন প্রত্যাগমন ও আক্ষেপ দর্শন করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। তখন সেই মহাবল পরাক্রান্ত বীরদ্বয় স্ব স্ব লঘু হস্ততা প্রদর্শন পূর্ব্বক পরস্পরকে তীক্ষ্ণবাণে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহাবীর সাত্যকি সুদৃঢ় সায়কনিকরে দ্রোণাচার্য্যের শর সমুদায় ও শরাসন ছেদন করিয়া 
ফেলিলেন। অরাতি নিপাতন দ্রোণ অবিলম্বে অন্য শরাসন জ্যাযুক্ত করিলেন। মহাবীর সাত্যকি তাহাও তৎক্ষণাৎ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে শিনিবংশাবতংস সাত্যকি ষোড়শবার দ্রোণাচার্য্যের শরাসন ছেদন করিলে আচার্য্য তাঁহার অলৌকিক ক্রিয়া ও ইন্দ্রের ন্যায় হস্তলাঘব দর্শন করিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, মহাবীর পরশুরাম, কার্ত্তবীর্য্য ও পুরুষ শ্রেষ্ঠ ভীষ্মের যেরূপ অস্ত্রবল মহাত্মা সাত্যকিরও সেই রূপ অস্ত্রবল দৃষ্ট হইতেছে। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য এইরূপে মনে মনে সাত্যকির ভূয়সী প্রশংসা করিয়া পরম পরিতোষ লাভ করিলেন। ইন্দ্রাদি দেব, গন্ধৰ্ব্ব, সিদ্ধ ও চারণগণ দ্রোণাচার্য্যের হস্তলাঘব অবগত ছিলেন কিন্তু সাত্যকির লঘুহস্ততা অবগত ছিলেন না এক্ষণে তাঁহার অসাধারণ ক্ষমতা সন্দর্শন করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন।

অনন্তর অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ ক্ষত্রিয় মর্দ্দন দ্রোণাচার্য্য অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া অস্ত্র সন্ধান করিলেন। সাত্যকিও অবিলম্বে স্বীয় অস্ত্র দ্বারা তাহার অস্ত্র ছেদন করিয়া তাঁহার উপর তীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। সমরকৌশলাভিজ্ঞ কৌরব পক্ষীয় যোধগণ সাত্যকির সংগ্রাম কৌশল ও অসাধারণ অতিমানুষ কর্ম্ম অবলোকন করিয়া তাঁহাকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য যে যে অস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন, সাত্যকিও সেই সেই অস্ত্র প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। ধনুর্ব্বেদপারদর্শী শত্রুতাপন দ্রোণাচার্য্য তদ্দর্শনে কথঞ্চিৎ সম্ভ্রান্ত হইলেন এবং পরিশেষে যৎপরোনাস্তি ক্রোধান্বিত হইয়া সাত্যকির বিনাশ বাসনায় দিব্য আগ্নেয়াস্ত্র গ্রহণ করিলেন। মহাবীর সাত্যকি দ্রোণকে রিপু ভীষণ আগ্নেয় অস্ত্র গ্রহণ করিতে অবলোকন করিয়া দিব্য বরুণাস্ত্র ধারণ পূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয় দিব্যাস্ত্র গ্রহণ করিলে চতুর্দ্দিকে হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। তৎকালে খেচর প্রাণিগণও আকাশ বিচরণ পরিত্যাগ করিল। ঐ মহাবীরদ্বয়ের শরাসন সমাহিত দিব্যাস্ত্রদ্বয় পরস্পরের প্রভাবে পরস্পর ব্যর্থ হইয়া গেল। হে মহারাজ! ঐ সময় ভগবান্ ভাস্কর অস্তগমনোন্মুখ হইলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব সাত্যকিকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। বিরাটরাজ ও কেকয় নরপতি এবং মৎস্য ও শাল্বদেশীয় বীরগণ ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি বীরগণের সহিত দ্রোণাচার্য্যের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন সহস্র সহস্র রাজপুত্রগণ দুঃশাসনকে অগ্রবর্তী করিয়া অরাতিপরিবেষ্টিত দ্রোণাচাৰ্য্যকে রক্ষা করিবার মানসে তাঁহার নিকট গমন করিলেন। উভয় পক্ষের তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল। পার্থিব-রেণু ও বীরগণের শরজালে সমরস্থল পরিব্যাপ্ত হইলে সকলেই ভয় বিহ্বল হইল এবং কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। তখন সংগ্রামকাৰ্য্য অতি অনিয়মে সম্পাদিত হইতে লাগিল।