০৭৩. যুধিষ্ঠীর কর্ত্তৃক অভিমন্যুর নিধনবৃত্তান্ত বর্ণন

৭৩তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠীর কর্ত্তৃক অভিমন্যুর নিধনবৃত্তান্ত বর্ণন

“হে মহাবাহু! তুমি সংশপ্তক সৈন্যগণের সহিত সংগ্রাম করিতে গমন করিলে দ্রোণাচার্য্য সৈন্যগণকে সংব্যূহিত করিয়া আমাকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত দৃঢ়তর যত্ন করিতে লাগিলেন। তখন আমরা রথ সৈন্য প্রতিব্যূহিত করিয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিবারণ করিতে সমুদ্যত হইলাম। বহু সংখ্যক বীরপুরুষ আমাকে রক্ষা করত দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন দ্রোণাচার্য্য আমাদিগকে নিশিত শরনিকরে নিতান্ত উৎপীড়ন করিয়া আঘাত করিতে আরম্ভ করিলেন। আমরা দ্রোণকর্ত্তৃক এরূপ নিপীড়িত হইলাম যে, তাঁহার সৈন্য ভেদ করা দূরে থাকুক, তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেও পারিলাম না। তখন অপ্রতিমবীৰ্য্য-সম্পন্ন সুভদ্রাকুমারকে কহিলাম, বৎস! দ্রোণাচার্য্যের সৈন্য ভেদ কর। বীর্য্যবান অভিমন্যু আমাদের নিয়োগানুসারে উৎকৃষ্ট অশ্বের ন্যায় সেই অসহ্য ভার বহনের উপক্ৰম করিল। গরুড় যেমন সমুদ্র মধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই বালক দ্রোণসৈন্যের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইল। আমরা তাঁহার অনুগমন করিলাম এবং সে যেরূপ সৈন্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, সেই রূপে প্রবেশ করিতে চেষ্টা করিলাম; কিন্তু ক্ষুদ্র জয়দ্রথ রুদ্রের বরদান প্রভাবে আমাদিগের সকলকেই নিবারণ করিল। তখন মহাবীর দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, কোশলরাজ, বৃহদ্বল ও কৃতবর্ম্মা এই ছয় জন রথী সেই অসহায় বালককে বেষ্টন করিলেন। মহাবীর অভিমন্যু সাধ্যানুসারে যত্ন করিয়াও তাঁহাদের শরে বিরথ হইল। তখন দুঃশাসনের পুত্র অবিলম্বে তাহার সমীপে গমন পূর্ব্বক স্বয়ং সংশয়াপন্ন হইয়া তাহার প্রাণ সংহার করিল। পরম ধার্মিক মহাবীর অভিমন্যু প্রথমত সহস্র মনুষ্য, অশ্ব, রথ ও মাতঙ্গ, এবং তৎপরে পুনরায় আট সহস্র রথ, নয় শত হস্তী, দুই সহস্র রাজপুত্র এবং অলক্ষিত বহু বীর ও রাজা বৃহদ্বলকে সংহার পূর্ব্বক স্বয়ং স্বর্গে গমন করিয়াছেন। হে ধনঞ্জয়! আমাদিগের এই শোক জনক ব্যাপার এইরূপে সমুৎপন্ন হইয়াছে।

জয়দ্রথ-বধে অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞা

তখন পুত্রবৎসল ধনঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া হা পুত্র! বলিয়া নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক ধরাতলে নিপতিত হইলেন। সকলে বিষণ্ন বদন হইয়া অর্জ্জুনকে বেষ্টন পূর্ব্বক অনিমিষ নয়নে পরস্পর অবলোকন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহাবীর ধনঞ্জয় সংজ্ঞা লাভ পূর্ব্বক ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন এবং জ্বরগ্রস্তের ন্যায় কম্পিত হইয়া মুহুর্মুহু নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তাঁহার নেত্র হইতে অশ্রুধারা বিগলিত হইতে লাগিল। তখন তিনি করে কর নিপীড়ন ও উন্মত্তের ন্যায় দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, কালি জয়দ্রথকে বিনাশ করিব। যদি জয়দ্রথ মৃত্যুভয়ে ভীত হইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে পরিত্যাগ না করে, যদি আমাদিগের পুরুষোত্তম কৃষ্ণের বা আপনার শরণাপন্ন না হয়, নিশ্চয়ই কল্য আমার শরে বিনষ্ট হইবে। সেই পাপাত্মা আমার সৌহৃদ্য বিস্মৃত হইয়া দুর্য্যোধনের প্রিয় কাৰ্য্য করিতেছে এবং সেই পাপাত্মাই অভিমন্যুবধের হেতু হইয়াছে। অতএব কালি তাঁহাকে সংহার করিব। দ্রোণই হউন, আর কৃপই হউন, যে কেহ তাঁহার রক্ষার্থে আমার সহিত যুদ্ধ করিবেন, তাঁহাদিগকে আমার শরনিকরে আচ্ছাদিত হইতে হইবে। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ গণ! আমি যাহা কহিলাম, যদি সংগ্রামে সেই প্রকার কার্য্য করি, তাহা হইলে যেন আমার পুণ্যলব্ধ লোক সকল লাভ না হয়। যদি জয়দ্রথ বধ না করি, তাহা হইলে মাতৃহন্তা, পিতৃঘাতী, গুরুদাররত, খল, সাধুগণের প্রতি অসূয়াপরবশ, তাঁহাদিগের পরিবাদদাতা, গচ্ছিত ধনের অপহরক, বিশ্বাসঘাতী, ভুক্তপূর্ব্বা স্ত্রীর নিন্দক, অযশস্বী, ব্ৰহ্মঘাতী, গোঘাতী, বৃথা-যবান্ন-ভোজী, বৃথা-শাকভোজী, বৃথা-তিলান্ন-ভোজী, বৃথা-পিষ্টক-ভোজী, বৃথা-মাংস-ভোজী এবং বেদাধ্যায়ী, প্রশংসিত ব্রাহ্মণ, বৃদ্ধ ও গুরুর অবমস্তা যে লোকে গমন করে, আমিও যেন সেই লোক প্রাপ্ত হই। যদি জয়দ্রথকে বধ না করি, তাহা হইলে যে ব্যক্তি পাদ দ্বারা ব্রাহ্মণ, গো ও অগ্নি স্পর্শ করে এবং যে ব্যক্তি জলে শ্লেষ্ম, পুরীষ ও মূত্র পরিত্যাগ করে, আমি যেন তাহাদিগের কষ্টকর গতি প্রাপ্ত হই। যদি জয়দ্রথকে বধ না করি, তাহা হইলে যে ব্যক্তি নগ্ন হইয়া স্নান করে, যাহার নিকট অতিথি বিমুখ হয়, যে ব্যক্তি উৎকোচ গ্রহণ, মিথ্যা বাক্য প্রয়োগ ও প্রবঞ্চনা করে এবং যে নীচাশয় ভৃত্য, পুত্র, স্ত্রী ও আশ্রিতগণকে প্রদান না করিয়া তাহাদের সমক্ষে স্বয়ং মিষ্টান্ন ভক্ষণ করে, আমি যেন তাহাদিগের ভয়ানক গতি প্রাপ্ত হই। যদি জয়দ্রথকে বধ না করি, তাহা হইলে যে নৃশংসাত্মা আশ্রিত, সাধু ও বাক্যানুবর্তী ব্যক্তিকে প্রতিপালন না করিয়া পরিত্যাগ করে, যে পাপাত্মা উপকারকের নিন্দা করে, যে পূজনীয় প্রতিবেশ্যকে শ্রাদ্ধীয় দ্রব্য দান না করিয়া অযোগ্য ব্যক্তিকে দান করে, যে ব্যক্তি মদ্য পান করে, যে মৰ্যাদা ভেদ করে, যে বৃষলী গমন করে, যে ব্যক্তি কৃতঘ্ন এবং ভ্রাতৃ নিন্দক, আমি অবিলম্বে যেন তাহাদিগের গতি প্রাপ্ত হই। যদি কল্য জয়দ্রথকে বধ না করি, তাহা হইলে এ স্থলে যে সকল অধার্মিকের নাম কীৰ্ত্তন করিলাম এবং যে সকল অধার্মিকের নাম কীৰ্তিত হইল না আমি যেন তাহাদিগের গতি প্রাপ্ত হই।

আমি পুনরায় অন্য প্রতিজ্ঞা করিতেছি শ্রবণ করুন। যদি কল্য পাপাত্মা জয়দ্রথ জীবিত থাকিতে দিবাকর অস্তগত হন, তাহা হইলে আমি এই স্থানেই প্রজ্বলিত হুতাশনে প্রবিষ্ট হইব। অসুর, সুর, মনুষ্য, পক্ষী, সর্প, পিতৃলোক, রাক্ষস, ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি এবং স্থাবর জঙ্গমাত্মক অন্যান্য প্রাণিগণ কেহই আমার শত্রুকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন না। অভিমন্যুর শত্রু যদি পৃথিবী, আকাশ, দেবপুর, দৈত্যপুর বা রসাতলে প্রবিষ্ট হয়, তথাপি আমি শর শত দ্বারা তাহার মস্তক ছেদন করিব।

মহাবীর ধনঞ্জয় এই কথা বলিয়া বামে ও দক্ষিণে গাণ্ডীব-শরাসন নিক্ষেপ করিলেন। শরাসনের শব্দ ধনঞ্জয়ের শব্দ অতিক্রম করিয়া নভোমণ্ডল স্পর্শ করিল। মহাবীর অর্জ্জুন এই রূপ প্রতিজ্ঞা করিলে বাসুদেব পাঞ্চজন্য শঙ্খের ধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন। অর্জ্জুনও দেবদত্ত শঙ্খ বাদিত করিতে লাগিলেন। পাঞ্চজন্য শঙ্খ কেশবের মুখ বায়ুতে পরিপূর্ণ হইলে তাহার ছিদ্র হইতে নির্ঘোষ নিঃসৃত হইয়া জগতীতল পাতাল আকাশ ও দিপালগণকে বিকম্পিত করিল। তখন পাণ্ডবগণের সহস্র সহস্র বাদ্য ধ্বনি ও সিংহনাদ প্রাদুর্ভূত হইতে লাগিল।