০৮২. যধিষ্ঠিরের প্রসাধনক্রিয়া

৮২তম অধ্যায়

যধিষ্ঠিরের প্রসাধনক্রিয়া

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর কৃষ্ণ ও দারুকের পর স্পর কথোপকথনে সেই রাত্রি অতিবাহিত হইল। রাজা যুধিষ্ঠির জাগরিত হইলেন। পাণিস্বনিক, মাগধ, মধুপর্কিক, বৈতালিক ও সূতগণ স্তবপাঠ, নর্ত্তকগণ নৃত্য, সুস্বর গায়কগণ কুরুবংশের স্তুতি যুক্ত মধুর সংগীত এবং সুনিপুণ সুশিক্ষিত হৃষ্টস্বভাব বাদ্যকরগণ মৃদঙ্গ, ঝর্ঝর, ভেরী, পণব, আনক, গোমুখ, শঙ্খ ও দুন্দুভি প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্য যন্ত্র বাদন করিতে লাগিল। মহামূল্য শয্যায় শয়ান মহারাজ যুধিষ্ঠির সেই মেঘনির্ঘোষ সদৃশ গগনস্পর্শী মহাশব্দে প্রতিবোধিত হইয়া গাত্রোত্থান পূর্ব্বক অবশ্য কর্ত্তব্য কার্য্যানুষ্ঠানের নিমিত্ত স্নানগৃহে গমন করিলেন। তখন স্নাত শ্বেতাম্বরধারী তরুণ বয়স্ক অষ্টাধিকশত স্নাপক পরিপূর্ণ কাঞ্চন কুম্ভ সমুদায় লইয়া তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইল। রাজা যুধিষ্ঠির লঘুবস্ত্র পরিধান পূর্ব্বক নৃপাসনে উপবেশন করিয়া মন্ত্রপূত চন্দন জলে স্নান করিলেন। সুশিক্ষিত বলবান্ ভৃত্যগণ কষায়দ্রব্যে তাঁহার গাত্র মার্জিত ও পরিশেষে অধিবাসিত সুগন্ধি জলে ধৌত করিয়া দিল। তিনি জলশোষণের নিমিত্ত মস্তকে রাজহংসসন্নিভ শুভ উষ্ণীষ বেষ্টন করিলেন। তৎপরে অঙ্গে মনোহর চন্দন লেপন, মাল্য ধারণ ও বস্ত্র পরিধান পূর্ব্বক পূৰ্বাভিমুখে কৃতাঞ্জলিপুটে অবস্থান করত সাধুগণের পদ্ধতি অনুসারে জপ সমাপন করিয়া বিনীতভাবে প্রদীপ্ত অগ্নিগৃহে প্রবিষ্ট হইলেন এবং পবিত্রসমেত সমিধ ও মন্ত্রপূত আহুতি দ্বারা অগ্নির অর্চনা করিয়া তথা হইতে বহির্গত হইয়া দ্বিতীয় কক্ষায় প্রবেশ করিলেন। তথায় বেদজ্ঞ, বেদব্রত, স্নাত, দীক্ষান্ত স্নাত, অনুচরসহস্র সমবেত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণগণ ও আট সহস্র গৌরী গর্ব্বজাত তনয়কে নিরীক্ষণ করিয়া মধু, ঘৃত, ফল, পুষ্প ও দূর্ব্বা প্রভৃতি মাঙ্গল্য দ্রব্য দ্বারা তাঁহাদিগের স্বস্তিবাচন পূর্ব্বক এক এক ব্রাহ্মণকে এক এক কাঞ্চন নিষ্ক, অলঙ্কৃত এক শত অশ্ব, বস্ত্র, অভিলষিত দক্ষিণ ও দোহনশীল সবৎস হেমশৃঙ্গ রৌপ্যখুর কপিলা ধেনু প্রদান এবং প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন। তৎপরে স্বস্তিক, বর্দ্ধমান ও কাঞ্চনময় নন্দ্যাবৰ্ত্ত গৃহ, মাল্য, জলকুম্ভ, প্রজ্বলিত হুতাশন, পরিপূর্ণ অক্ষত পাত্র, মঙ্গল্য দ্রব্য, রোচনা, অলঙ্কৃত সুলক্ষ্মণ কামিনীগণ, দধি, ঘৃত, মধু, জল ও মাঙ্গল্য পক্ষী প্রভৃতি পূজিত দ্রব্য সকল দর্শন ও স্পর্শ করিয়া বাহ্য কক্ষায় আগমন করিলেন। তথায় তাঁহার পরিচারকগণ সুবর্ণময়, মুক্তা ও বৈদূৰ্য্য মণি মণ্ডিত, মনোহর আস্তরণে আস্তীর্ণ, উত্তরচ্ছদসমেত, বিশ্বকর্ম্ম নির্মিত, সৰ্ব্বতোভদ্র অসিন আনয়ন করিল। মহাত্মা যুধিষ্ঠির সেই আসনে উপবেশন করিলে তাঁহার শুভ্র বর্ণ মহামূল্য ভূষণ সমুদায় সমানীত হইল। তিনি মুক্তাভরণে সুসজ্জিত হইলে তাঁহার রূপ শত্রুগণের শোকবর্দ্ধন হইয়া উঠিল। ভৃত্যগণ শশধরের ন্যায় পাণ্ডুর সুবর্ণ দগুমণ্ডিত চামর গ্রহণপূর্ব্বক তাহার চতুর্দ্দিকে বীজন করিতে আরম্ভ করিলে তিনি চপলাবিলসিত জলধরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তাঁহার সম্মুখে স্তাবকগণ স্তব, বন্দিগণ বন্দনা ও গন্ধৰ্ব্বগণ গান করিতে আরম্ভ করিল। ঐসময় বন্দিগণের ঘোরতর শব্দ, রথসমূহের নেমি শব্দ ও অশ্বগণের খুর শব্দ প্রাদুর্ভূত হইল এবং গজঘণ্টা নিনাদ, শঙ্খ-নিস্বন ও মানবগণের পদ শব্দে পৃথিবী যেন কম্পিত হইতে লাগিল।

ক্ষণকালের মধ্যে সমুদায় শব্দ তিরোহিত হইলে কুণ্ডলধারী বদ্ধখড়্গ সন্নদ্ধকবচ তরুণবয়স্ক দ্বারবান্ অভ্যন্তরে আগমন পূর্ব্বক জানু দ্বারা ভূতলে অবস্থান ও মস্তকদ্বারা যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করিয়া হৃষীকেশের আগমন সংবাদ নিবেদন করিল। তখন পুরুষশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির পরম পূজিত মাধবের নিমিত্ত আসন ও অর্ঘ্য আনয়ন করিতে আজ্ঞা প্রদান পূর্ব্বক তাঁহাকে প্রবেশিত ও বরাসনে উপবেশিত করিয়া স্বাগতপ্রশ্ন ও বিধিবৎ পূজা করিতে লাগিলেন।”