০৮০. অর্জ্জুনসহ শ্রীকৃষ্ণের মহাদেবের নিকট গমন

৮০তম অধ্যায়

অর্জ্জুনসহ শ্রীকৃষ্ণের মহাদেবের নিকট গমন

সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! এদিকে অচিন্ত্যবিক্রম ধনঞ্জয় আত্মকৃত প্রতিজ্ঞা প্রতিপালনের চিন্তা ও ব্যাস দত্ত মন্ত্র স্মরণ করত নিদ্রাগত হইলে মহাতেজা বাসুদেব স্বপ্নে তাঁহার নিকট আগমন করিলেন। ধর্ম্মাত্মা ধনঞ্জয় কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি ও প্রেম বশত কোন কালে কোন অবস্থাতেই তাঁহাকে দেখিয়া প্রত্যুত্থান করিতে ক্ষান্ত হইতেন না; সুতরাং এক্ষণেও প্রত্যুত্থান করিয়া বাসুদেবকে আসন প্রদান করিলেন; কিন্তু স্বয়ং তৎকালে উপবেশনের অভিলাষ করিলেন না।

মহাতেজা বাসুদেব ধনঞ্জয়ের অভিপ্রায় অবগত ছিলেন; এক্ষণে উপবেশন করিয়া তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, পার্থ কাল অতি দুর্জ্জয়; কাল সকল ভূতকেই অবশ্যম্ভাবি বিষয়ে নিয়োজিত করে, অতএব তুমি বিষণ্ন হইও না। হে পুরুষোত্তম! তুমি কি নিমিত্ত বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইয়াছ? হে পণ্ডিতবর! তোমার শোক করা উচিত নয়; শোকে কাৰ্য্য নাশ হয়, অতএব শোক পরিত্যাগ করিয়া কৰ্তব্য কর্মের অনুষ্ঠান কর। শোক চেষ্টা হীন ব্যক্তির শত্রু। শোককারী ব্যক্তি শত্রুগণকে আনন্দিত ও মিত্রগণকে ক্ষীণ করে এবং স্বয়ং বিনাশ প্রাপ্ত হয়; অতএব শোক পরিত্যাগ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। অপরাজিত অর্জ্জুন কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, হে কেশব! আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, আমার পুত্রহন্তা দুরাত্মা জয়দ্রথকে কালি সংহার করিব; কিন্তু মহারথ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ সকলেই সেই প্রতিজ্ঞাবিঘাতার্থ সিন্ধুরাজকে পৃষ্ঠভাগে সংস্থাপিত করিয়া রক্ষা করিবেন, সন্দেহ নাই। দুরাত্মা জয়দ্রথ একাদশ অক্ষৌহিণীর হতাবশিষ্ট অতি দুর্জ্জয় সৈন্য ও মহারথগণে পরিবৃত হইলে তাহার সহিত সাক্ষাৎকার অতি দুঃসাধ্য হইবে। বিশেষত এক্ষণে দক্ষিণায়ন; দিবাকর অতি শীঘ্র অস্তে গমন করেন, অতএব বোধ হয়, আমি প্রতিজ্ঞা হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারিব না। প্রতিজ্ঞা বিফল হইলে মাদৃশ ব্যক্তি কি প্রকারে জীবিত থাকিতে পারে? এক্ষণে আমার দুঃখ প্রতিকারের আকাঙ্ক্ষা পরিবর্ত্তিত হইতেছে।

বাসুদেব ধনঞ্জয়ের শোক-হেতু শ্রবণ করিয়া তাঁহার মঙ্গল ও জয়দ্রথের বধ সাধনার্থ জলস্পর্শ করিয়া পূৰ্বাভিমুখে অবস্থান পূর্ব্বক কহিলেন, হে ধনঞ্জয়! দেবাদিদেব মহাদেব যাহা দ্বারা সমুদায় দৈত্যগণকে সংহার করিয়াছিলেন, যদি সেই সনাতন পাশুপত অস্ত্র তোমার স্মৃতিপথারূঢ় থাকে, তাহা হইলে কালি নিশ্চয় তাহা দ্বারা জয়দ্রথকে বধ করিতে পারিবে। আর যদি উহা বিস্মৃত হইয়া থাক, তবে মনে মনে সাবধানে মহাদেবের স্মরণ ও ধ্যান কর। তুমি তাহার ভক্ত, অবশ্যই তাঁহার প্রসাদে সেই মহৎ অস্ত্র প্রাপ্ত হইবে ।

মহাত্মা অর্জ্জুন কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর জলস্পর্শ করিয়া একাগ্রচিত্তে ভূমিতলে উপবেশন পূর্ব্বক মহাদেবকে স্মরণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর শুভ লক্ষ্মণ ব্রাহ্মমুহুর্ত্ত সন্নিহিত হইলে ধনঞ্জয় দেখিলেন যে, আপনি কেশবের সহিত গগণমণ্ডলে উপস্থিত হইয়াছেন। তথায় কেশব তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করিলে তিনি জ্যোতিষ্ক মণ্ডলে সমাকীর্ণ, সিদ্ধচারণ সেবিত হিমালয়ের পবিত্র পাদদেশে ও মণিমান্‌ পর্ব্বতে বায়ু বেগে উপস্থিত হইলেন। তথা হইতে উত্তর দিকে শ্বেত পর্ব্বত; কুবেরের বিহার প্রদেশস্থিত প্রফুল্ল সরসিজসম্পন্ন সবোবর এবং পুষ্প ফল সঙ্কীর্ণ, দ্রুমরাজিবিরাজিত, সিংহ ব্যাঘ্র প্রভৃতি নানাবিধ মৃগগণে পরিপূর্ণ, পবিত্র আশ্রম সম্পন্ন, মনোহর বিহগসমূহে উপশোভিত, স্ফটিক সদৃশ অগাধ জল পরিপূর্ণ, নদীশ্রেষ্ঠ গঙ্গা ও কিন্নর গীত ধ্বনিত হেমরৌপ্যময় শৃঙ্গে সুশোভিত কুসুমিত মন্দার বৃক্ষে সুবাসিত নানাবিধ ওষধিতে সন্দীপিত মন্দর পর্ব্বতের প্রদেশ প্রভৃতি অদ্ভুত দর্শন পদার্থ সকল অবলোকন করত সুচিক্কণ অঞ্জনরাশি সন্নিভ কাল পর্ব্বতে গমন করিলেন। তথায় ভ্রমণ করিতে করিতে ব্ৰহ্মতুঙ্গ, বহুসংখ্যক নদী, জনপদ, সুশৃঙ্গ, শতশৃঙ্গ, শর্যাতিবন, পবিত্র অশ্বশিরস্থান, অথৰ্ব্বগণের স্থান, বৃষদংশ পর্ব্বত, অপ্সরা ও কিন্নরগণে সমাকীর্ণ মহামন্দর শৈল এবং মনোহর প্রস্রবণ, সুবর্ণ ও নগর সমূহেশোভিত, চন্দ্ররশ্মির ন্যায় প্রভা সম্পন্ন পৃথিবী ও বহুরত্নের আকর অদ্ভুতাকার সমুদ্র সকল তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল। এই রূপে মহাবাহু ধনঞ্জয় কৃষ্ণের সহিত অন্তরীক্ষ, স্বর্গ, পৃথিবী ও আকাশে পর্য্যটন করত বিস্মিত হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূৰ্য্য ও অগ্নির ন্যায় দীপ্তিমান্ এক পর্ব্বত তাঁহার নয়নগোচর হইল। তখন তিনি সেই পৰ্ব্বতের শিখরদেশে গমন পূর্ব্বক দেখিলেন, মহাত্মা বৃষভধ্বজ তথায় তপশ্চৰ্য্যায় ব্যাপৃত হইয়া অবস্থান করিতেছেন। তাঁহার এরূপ তেজ যে, বোধ হয় সহস্ৰ সূৰ্য্য একত্র দেদীপ্যমান হইতেছে। তাঁহার হস্তে শূল, মস্তকে জটা; পরিধান বল্কল ও অজিন এবং শরীর শ্বেতবর্ণ ও সহস্র লোচনে সুশোভিত। তাঁহার সঙ্গে পার্ব্বতী ও ভাস্বর ভূতগণ অবস্থান করিতেছেন। তিনি কখন গীত, কখন বাদ্য, কখন শব্দ, কখন হাস্য, কখন নৃত্য, কখন হস্ত পদাদির আস্ফালন, কখন আস্ফোটন, কখন বা চীৎকার করিতেছেন। তাঁহার গাত্র পবিত্র গন্ধে সুবাসিত হইয়াছে এবং দিব্য ঋষি ও ব্রহ্মবাদিগণ তাঁহার স্তব করিতেছেন।

ধর্ম্মাত্মা বাসুদেব সেই শরাসনধারী ভূতনাথ ভবানীপতিকে অবলোকন করিয়া সনাতন ব্রহ্মনাম উচ্চারণ পূর্ব্বক পার্থের সহিত ক্ষিতিতলে মস্তকাবনমন করিলেন। যে মহাত্মা সকল লোকের আদি, অজন্মা, ঈশান, অব্যয়, মনের পরম কারণ, আকাশ ও বায়ু স্বরূপ, সমস্ত জ্যোতির আধার, পর প্রকৃতি, দেব দানব যক্ষ ও মানবগণের সাধনীয়, যোগের আধার, পর ব্রহ্ম, ব্রহ্মদিগের আশ্রয়, চরাচরের স্রষ্টা ও প্রতিহর্ত্তা এবং ধীরত্ব ও প্রচণ্ডতার উদয় স্থান; সূক্ষ্ম অধ্যাত্ম পদলাভার্থী জ্ঞানিগণ যাঁহাকে প্রাপ্ত হন এবং সংহারকালে যাঁহার কোপের উদয় হয়; বাসুদেব বাক্য, মন, বুদ্ধি ও কর্ম্ম দ্বারা তাঁহাকে বন্দনা করিলেন। অর্জ্জুনও তাঁহাকে সকল ভূতের আদি এবং ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমানের কারণ জানিয়া ভূয়োভূয়ঃ অভিবাদন করিতে লাগিলেন। এইরূপে উভয়ে সেই কারণ স্বরূপ, আত্ম স্বরূপ, মহাদেবের শরণাপন্ন হইলেন।

তখন দেবাদিদেব মহাদেব নর ও নারায়ণকে সমাগত দেখিয়া প্রসন্নমনে সহাস্য বদনে স্বাগত প্রশ্ন করিয়া কহিলেন, হে নরোত্তম বীরদ্বয়! তোমরা গাত্রোত্থান কর; তোমাদের ক্লেশ দূর হউক। তোমাদের মনের অভিলাষ শীঘ্র ব্যক্ত কর; যে কাৰ্যের অনুরোধে আগমন করিয়াছি, আমি তাহা সম্পাদন করিব। তোমরা আপনাদের কল্যাণ প্রার্থনা কর; আমি তাহা প্রদান করিতেছি।

মহাদেবের স্তব

মহামতি বাসুদেব ও অর্জ্জুন মহাত্মা মহাদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া প্রত্যুত্থান ও অঞ্জলি বন্ধন পূর্ব্বক দিব্য বাক্যে তাঁহার স্তব আরম্ভ করিলেন, ‘হে দেব! তুমি ভব, সৰ্ব্ব, রুদ্র, বরদ, পশুপতি, উগ্র, কপর্দী, মহাদেব, ভীম, ত্র্যম্বক, শান্ত, ঈশান ও মখঘ্ন; তুমি অন্ধকঘাতী, কার্ত্তিকেয়ের পিতা, নীলগ্রীব ও মেধা; তুমি পিণাকী, হবিষ্য, সত্য, বিভু, বিলোহিত, ধুম্র, ব্যাধ ও অপরাজিত; তুমি নিত্য নীল শিখণ্ড, শূলধারী, দিব্য চক্ষু, হর্ত্তা, পিতা, ত্রিনেত্র ও বসুরেতাঃ; তুমি অচিন্ত্য, অম্বিকানাথ, সর্ব্ব দেবস্তুত, বৃষধ্বজ, মুণ্ড, জটিল ও ব্রহ্মচারী; তুমি সলিল মধ্যস্থ তপস্বী, ব্ৰহ্মণ্য, অজিত, বিশ্বাত্মা, বিশ্বস্রষ্টা, ও বিশ্বব্যাপী, তুমি ভূতগণের সেবনীয়, প্রভু, ও বেদমুখ, তুমি সৰ্ব্ব, শঙ্কর ও শিব, তুমি বাক্যের পতি, প্রজা পতি, বিশ্বপতি ও মহতের পতি; তুমি সহস্রশিরা, সহস্র ভুজ, সহস্রনেত্র, সহপাদ ও অসংখ্যেয়কৰ্ম্মা, তুমি সংহর্তা হিরণ্যবর্ণ, হিরণ্য কবচ, ও ভক্তানুকম্পী; তোমারে নমস্কার; হে প্রভো! আমাদিগের বাঞ্ছা পরিপূর্ণ কর।

হে মহারাজ! বাসুদেব ও অর্জ্জুন অস্ত্রলাভের নিমিত্ত এইরূপ স্তব করিয়া মহাদেবকে প্রসন্ন করিতে লাগিলেন।”