০৮৮. উভয়পক্ষীয় বীরগণের যুদ্ধোদ্যোগ

৮৮তম অধ্যায়

উভয়পক্ষীয় বীরগণের যুদ্ধোদ্যোগ

সঞ্জয় কহিলেন, হে মহারাজ! এইরূপে সৈন্য সমুদায় যথা স্থানে সংস্থাপিত হইলে সংগ্রাম স্থলে ভেরী মৃদঙ্গ প্রভৃতি বহুবিধ বাদ্যোদ্যম হইতে লাগিল। সেনাগণের গভীর গর্জ্জন বাদিত্রের নিস্বন ও শঙ্খের ভীষণ শব্দে সমরক্ষেত্র পরিপূর্ণ হইল এবং ভরতবংশীয় বীরগণ ক্রমে ক্রমে সমরস্থল আচ্ছাদিত করিলেন। হে মহারাজ! সেই ভীষণ সমরে সব্যসাচী অর্জ্জুন রণক্ষেত্রে লক্ষিত হইলেন। তাঁহার সম্মুখে অসংখ্য কৃষ্ণবর্ণ বায়স ক্রীড়া করিতে লাগিল। আমাদের সেনাগণের দক্ষিণপার্শ্বে অশিবদর্শন শিবা ও ঘোর দর্শন অন্যান্য পশুগণ ভয়ঙ্কর স্বরে চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। সেই ভয়াবহ সময়ে সহস্র সহস্র নির্ঘাত ধ্বনিও উত্থিত হইতে লাগিল। সসাগরা পৃথিবী কম্পিত হইল, সনির্ঘাত রুক্ষ বায়ু মহাবেগে কর্কর সমুদায় সঞ্চালন করিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল।

তখন নকুল পুত্র সুবিজ্ঞ শতানীক ও ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডব সৈন্যের ব্যূহ রচনায় প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় আপনার পুত্র দুর্ম্মর্ষণ সহস্র রথ, শত হস্তী, ত্রিসহস্র অশ্ব ও দশসহস্র পদাতি দ্বারা সার্দ্ধ সহস্র ধনু পরিমিত ভূমি সমাচ্ছন্ন করিয়া সৰ্ব্ব সৈন্যের অগ্রভাগে অবস্থান করিতে ছিলেন। তিনি গর্বিত বাক্যে কহিলেন, হে বীরগণ! বেলা যেমন সমুদ্রবেগ নিবারণ করে, সেইরূপ অদ্য আমি গাণ্ডীবধারী যুদ্ধদুর্ম্মদ প্রতাপশালী অর্জ্জুনকে নিবারণ করিব। আজি তোমরা সংগ্রামে অমর্ষশীল ধনঞ্জয়কে প্রস্তরে সংলগ্ন পর্ব্বত শৃঙ্গের ন্যায় অবলোকন করিবে। হে যুদ্ধাভিলাষী রখিগণ! তোমাদের কাহারও যুদ্ধ করিবার প্রয়োজন নাই। আমি একাকী পাণ্ডব পক্ষীয় সমুদায় বীরগণের সহিত সংগ্রাম করিয়া স্বীয় যশ ও মান বর্দ্ধন করিব। ধনুর্ধারী মহামতি দুর্ম্মর্ষণ এই বলিয়া ধনুর্দ্ধরগণে পরিবৃত হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন বিচিত্র কবচ সুবর্ণময় কিরীট, শুভ্র মাল্য, শুভ্র বসন, উত্তম অঙ্গদ ও মনোহর কুণ্ডলে বিভূষিত, খড়্গধারী, উত্তম রথারূঢ় নারায়ণ-সহায় নিবাত-কবচনিহন্তা মহাবীর ধনঞ্জয় দুর্ম্মর্ষণের বাক্যে ক্রুদ্ধ হইয়া গাণ্ডীব বিধূনন করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহাকে অমর্ষণ অন্তকের ন্যায়, বজ্রধারী বাসবের ন্যায়, কালপ্রেরিত দণ্ডপাণি যমের ন্যায়, অক্ষোভ্য শূলপাণির ন্যায়, পাশধারী বরুণের ন্যায়, প্রজাসংজিহীর্ষু যুগান্তকালীন হুতাশনের ন্যায় ও সমুদিত দিনকরের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তিনি কৌরব সৈন্যের সম্মুখে রথ সংস্থাপন পূর্ব্বক শঙ্খধ্বনি করিলেন। তখন মহাত্মা মধুসূদনও অশঙ্কিত চিত্তে শঙ্খপ্রধান পাঞ্চজন্য প্রাধ্মাপিত করিতে লাগিলেন। কৃষ্ণার্জ্জুনের শঙ্খ নিনাদে সেনাগণ রোমাঞ্চিতগাত্র, কম্পিত কলেবর ও বিচেতন প্রায় হইল। যেমন অশনি নিস্বনে সমুদায় প্রাণ শঙ্কিত হয়, সেইরূপ কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের শঙ্খনাদে সমস্ত সৈন্য ভীত হইয়া উঠিল।.বাহন সকল মলমূত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে সেই দারুণ শঙ্খনাদে সমুদায় বাহন ও সৈন্যগণ উদ্বিগ্ন হইল। কেহ কেহ ভয়ে সংজ্ঞাহীন হইল এবং অনেকে পলায়ন করিতে লাগিল। হে রাজন! তখন অর্জ্জুনের ধ্বজস্থিত কপি তত্ৰত্য অন্যান্য জন্তুগণের সহিত মুখব্যাদানপূর্ব্বক কৌরব সৈন্যগণের ত্ৰাসোৎপাদন করিয়া মহাশব্দ করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় কৌরব পক্ষীয় সেনাগণের মধ্যে পুনরায় শঙ্খ, ভেরী, মৃদঙ্গ ও আনক প্রভৃতি নানা প্রকার হর্ষজনক বাদিত্র বাদিত হইতে লাগিল। বাদিত্রনিস্বন, সিংহনাদ, আস্ফোট ও মহারথগণের চীৎকারে সংগ্রামস্থল পরিপূর্ণ হইল। হে রাজন! ইন্দ্রপুত্র অর্জ্জুন সেই ভীরুগণের ভয়বর্দ্ধন তুমুল শব্দ শ্রবণে পরমাহ্লাদিত হইয়া কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন।