০৬৯. প্রখ্যাত নৃপ পৃথুর পুণ্যকথা

৬৯তম অধ্যায়

প্রখ্যাত নৃপ পৃথুর পুণ্যকথা

নারদ কহিলেন, হে সৃঞ্জয়! বেণরাজতনয় পৃথুও কাল গ্রাসে নিপতিত হইয়াছেন। মহর্ষিগণ তাঁহার রাজসূয় যজ্ঞে তাঁহাকে সাম্রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন। মহাপ্রভাবশালী বেণতনয় স্বীয় বাহু বল প্রভাবে পৃথিবীস্থ সমুদায় বীরগণকে পরাজয় করেন। তাহা দ্বারা পৃথিবীমণ্ডল প্রোথিত হইয়াছিল এই নিমিত্ত তিনি পৃথু নামে বিখ্যাত হইয়াছেন। তিনি প্রাণিগণকে ক্ষত হইতে পরিত্রাণ করিয়া স্বীয় ক্ষত্রিয়ত্ব সার্থক করিয়াছেন। প্রজা সকল পৃথুকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিয়াছিল, আমরা সকলেই ইহার প্রতি অনুরক্ত হইয়াছি; এই নিমিত্ত তিনি প্রজাগণের অনুরাগ ভাজন হইয়া রাজা এই উপাধি প্রাপ্ত হন। তাঁহার রাজ্যশাসন সময়ে ভূমি সকল কৃষ্ট না হইয়াও অভীষ্ট ফল উৎপাদন করিত। ধেনু সকল কামদুঘা হইয়াছিল। কমল সকল মধু পরিপূর্ণ থাকিত। কুশা সমুদায় সুবৰ্ণময় ও সুখাবহ ছিল। প্রজাগণ সেই সমস্ত কুশের চীর পরিধান ও কুশাস্তরণে শয়ন করিত। তাহার কেহই নিরাহার থাকিত না; সকলেই অমৃত কল্প স্বাদু ও মৃদু ফল সকল আহার করিত এবং সকলেই রোগ শূন্য, সফল কাম ও নির্ভয়চিত্ত হইয়া স্বেচ্ছানুসারে বৃক্ষ ও গিরিগুহায় বাস করিত।

তৎকালে রাজ্য ও পুরের বিভাগ ছিল না। প্রজাগণ হৃষ্টমনে সুখ স্বচ্ছন্দে স্ব স্ব অভিলাষানুরূপ কাল যাপন করিত। যখন পৃথুরাজা সমুদ্র যাত্রা করিতেন, তৎকালে সলিল রাশি স্তম্ভিত হইয়া থাকিত। পর্ব্বত সকল তাহার গমন কালে পথ প্রদান করিত। তোরণাদি দ্বারা তাঁহার রথধ্বজ ভগ্ন হইত না।

একদা সমুদায় শৈল, বনস্পতি, দেবতা, অসুর, নর, উরগ, যক্ষ, গন্ধৰ্ব্ব, অপ্সরা, সপ্তর্ষি ও পিতৃগণ সুখাসীন পৃথু রাজার সন্নিধানে গমন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! তুমি আমাদের সম্রাট, ক্ষত্রিয়, রাজা, রক্ষক, প্রভু ও পিতা; এক্ষণে আমরা যদ্বারা নিরন্তর তৃপ্তি লাভ করিতে সমর্থ হই, আমাদিগকে এইরূপ অভিলষিত বর প্রদান কর।

তখন মহারাজ পৃথু তাঁহাদিগকে তথাস্তু বলিয়া আজগর শরাসন ও ভয়ঙ্কর শর গ্রহণ পূর্ব্বক মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া পৃথিবীকে কহিলেন, হে বসুন্ধরে! তোমার মঙ্গল হউক; তুমি ইহাদিগের নিমিত্ত অভিলষিত দুগ্ধ ক্ষরণ কর, তাহা হইলে আমি ইহাদিগকে অভিলাষানুসারে অন্ন প্রদান করিব। পৃথিবী কহিলেন, মহারাজ! আপনি আমাকে দুহিতা বলিয়া জ্ঞান করিলেন। পৃথুরাজ তথাস্তু বলিয়া দোহনের সমস্ত উদ্যোগ করিলেন। তখন ভূত সমুদায় তাঁহাকে দোহন করিতে লাগিল।

বনস্পতিগণ দোহনের অভিলাষে সর্ব্বাগ্রে সমুত্থিত হইল। বৎসলা বসুন্ধরা বৎস, দোগ্ধা ও পাত্র লাভের অভিলাষে উত্থিত হইলেন। তখন পুষ্পিত শাল বৃক্ষ বৎস, বট বৃক্ষ দোগ্ধা, ছিন্ন অঙ্কুর দুগ্ধ ও উদুম্বর পবিত্র পাত্র হইল। পর্ব্বতগণের দোহন সময়ে উদয় পর্ব্বত বৎস, মহাগিরি সুমেরু দোগ্ধা, রত্ন ও ওষধি সকল দুগ্ধ ও পাত্র প্রস্তরময় হইয়াছিল। তৎপরে দেবগণ দোগ্ধা ও তেজস্কর প্রিয়বস্তু সকল দুগ্ধ হইল। তদনন্তর অসুরগণ আম পাত্রে মদ্য দোহন করিলেন, ঐ সময় দ্বিমূৰ্দ্ধা দোগ্ধা ও বিরোচন বৎস হইয়াছিলেন। মনুষ্যগণ কৃষি ও শস্য দোহন করিলেন। ঐ সময়ে স্বায়ম্ভুব মুনি বৎস ও পৃথু দোগ্ধা হইয়াছিলেন। নাগগণ অলাবুপাত্রে বিষ দোহন করিলেন; তৎকালে ধৃতরাষ্ট্র দোগ্ধা ও তক্ষক বৎস হইয়াছিলেন। সপ্তর্ষিগণ বেদদোহন করিলেন। তৎকালে বৃহস্পতি দোগ্ধা, ছন্দ পাত্র ও সোমরাজ বংস হইয়াছিলেন। যক্ষের আমপাত্রে অন্তর্ধান দোহন করিল; তৎকালে কুবের দোগ্ধাও বৃষধ্বজ বৎস হইয়াছিলেন। অষ্পরা ও গন্ধৰ্ব্বগণ পদ্মপাত্রে পবিত্র গন্ধ দোহন করিলেন; তৎকালে চিত্ররথ বৎস ও বিশ্বরুচি দোগ্ধা হইয়াছিলেন। পিতৃগণ রজত পাত্রে স্বধা দোহন করিলেন; তৎকালে বৈবস্বত বৎস ও অন্তক দোগ্ধা হইয়াছিলেন। হে শ্বিত্যনন্দন! বনস্পতি প্রভৃতি দোগ্ধারা যে সমস্ত পাত্র ও বৎস দ্বারা অভিলষিত দুগ্ধ দোহন করিয়াছিলেন, ঐ সকল পাত্র ও বৎস অদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছে।

প্রবল প্রতাপশালী মহারাজ পৃথু বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া সমুদায় প্রাণিগণকে অভিলষিত দ্রব্য প্রদান পূর্ব্বক পরিতুষ্ট করিয়াছিলেন। ঐ মহাত্মা অশ্বমেধ যজ্ঞে পৃথিবীস্থ সমুদায় বস্তুর সুবৰ্ণময়ী প্রতিমূর্ত্তি প্রস্তুত করিয়া বিপ্রসাৎ করেন। তিনি ষষ্টি সহস্র ও যষ্টি শত সুবর্ণময় হস্তী এবং মণিরত্নে সমলঙ্কৃত সুবর্ণময়, পৃথিবী নির্ম্মাণ করিয়া দ্বিজাতিদিগকে প্রদান করিয়াছিলেন। হে সৃঞ্জয়! রাজা পৃথু তোমা অপেক্ষা সমধিক সত্য, তপ, দয়া ও দানশীল, এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা সমধিক পুণ্যবান; সেই পৃথু নৃপতিও কাল কবলে কবলিত হইয়াছেন; অতএব তুমি সেই অযাজ্ঞিক ও অধ্যয়নাদি শূন্য পুত্রের নিমিত্ত অনুতাপ করিও না।