০৭৪. জয়দ্রথের ভীতি – দ্রোণাচার্য্যের অভয়দান

৭৪তম অধ্যায়

জয়দ্রথের ভীতি – দ্রোণাচার্য্যের অভয়দান

চরগণ জয়লোলুপ পাণ্ডবগণের সেই মহাশব্দ শ্রবণ করিয়া সংবাদ প্রদান করিলে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ উত্থান পূর্ব্বক নিতান্ত দুঃখিত, বিমুগ্ধচিত্ত ও শোকসাগরে নিমগ্নপ্রায় হইয়া অনেক বিবেচনা করত ভূপালগণের সভায় গমন করিলেন এবং অর্জ্জুনের ভয়ে নিতান্ত ভীত ও লজ্জিত হইয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, হে ভূপালগণ! পাণ্ডুর ক্ষেত্রে কামপরবশ ইন্দ্রের ঔরসে সমুৎপন্ন দুর্বুদ্ধি ধনঞ্জয় আমাকে শমন ভবনে প্রেরণ করিবার সংকল্প করিতেছে; অতএব আপনাদিগের মঙ্গল হউক; আমি প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত স্বস্থানে প্রস্থান করি, অথবা আপনারা সকল বীর অস্ত্রবলে আমাকে রক্ষা করুন। পার্থ আমাকে নিধন করিতে বাসনা করিয়াছে, আপনারা আমাকে অভয় প্রদান করুন। দ্রোণ, দুৰ্য্যোধন, কৃপ, কর্ণ, শল্য, বাহ্লিক ও দুঃশাসন প্রভৃতি বীরগণ যম-নিপীড়িত ব্যক্তিকেও পরিত্রাণ করিতে সমর্থ, অতএব অর্জ্জুন একাকী আমাকে সংহার করিতে ইচ্ছা করিয়া কৃতকাৰ্য্য হইতে পারে যথার্থ বটে; কিন্তু আমার বোধ হইতেছে, আপনারা সমস্ত ভূপাল একত্র হইয়াও আমাকে পরিত্রাণ করিতে পারিবেন না। আমি পাণ্ডবগণের হর্ষধ্বনি শ্রবণ করিয়া নিতান্ত ভীত হইয়াছি; মুমুর্ষূর ন্যায় আমার গাত্র অবসন্ন হইতেছে। নিশ্চয়ই গাণ্ডীবধন্বা আমাকে বধ করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন; সেই নিমিত্ত পাণ্ডবগণ শোক কালেও হৃষ্ট হইয়া চীৎকার করিতেছে। ভূপালগণের কথা দূরে থাকুক, দেব, গন্ধর্ব্ব, অসুর, ভুজঙ্গ ও রাক্ষসগণও অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞা অন্যথা করিতে সমর্থ নন। অতএব হে ভূপতিগণ! আপনাদিগের মঙ্গল হউক, আপনারা অনুজ্ঞা করুন, আমি পলায়নপূর্ব্বক লুকায়িত হইয়া থাকি; তাহা হইলে পাণ্ডবগণ আমার দর্শন প্রাপ্ত হইবে না।

জয়দ্রথ ভয়ব্যাকুলিত-চিত্তে এইরূপ বিলাপ করিতে আরম্ভ করিলে আত্মকাৰ্য্য-সাধন-তৎপর রাজা দুৰ্য্যোধন তাঁহাকে কহিলেন, সিন্ধুরাজ! ভীত হইও না; তুমি ক্ষত্রিয় বীরগণের মধ্যে অবস্থান করিলে কে তোমার সহিত যুদ্ধ করিতে সাহস করিবে? আমি, কর্ণ, চিত্রসেন, বিবিংশতি, ভূরিশ্রবা, শল, শল্য, দুর্দ্ধর্ষ বৃষসেন, পুরুমিত্র, জয়, ভোজ, কাম্বোজরাজ, সুদক্ষিণ, সত্যব্রত, মহাবাহু বিকর্ণ, দুর্মুখ, দুঃশাসন, সুবাহু, উদ্যতায়ুধ কলিঙ্গ, অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অবিন্দ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, শকুনি ও অন্যান্য অসংখ্য ভূপাল, আমরা সকলে সসৈন্যে তোমার চতুর্দ্দিকে গমন করিব; তুমি দুর্ভাবনা পরিত্যাগ কর। তুমি স্বয়ংও রথীশ্রেষ্ঠ এবং শোর্য্যশালী; তবে পাণ্ডবগণকে ভয় করিতেছ কেন? আমার একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা তোমাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত যত্ন সহকারে যুদ্ধ করিবে। অতএব তুমি ভীত হইও না; তোমার ভয় দূরীভূত হউক।”

হে রাজন্! সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন কর্ত্তৃক এই প্রকার আশ্বাসিত হইয়া সেই রাত্রিতে ততাঁহার সহিত দ্রোণাচার্য্যের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে অভিবাদন পূর্ব্বক উপবিষ্ট হইয়া বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, আচাৰ্য্য! দূরস্থ লক্ষ্যে শরনিপাতন, লঘুত্ব ও দৃঢ়বেধনে অর্জ্জুনের সহিত আমার প্রভেদ কি বলুন। আমি আপনার নিকট অর্জ্জুন ও আমার যুদ্ধ বিদ্যার তারতম্য অবগত হইতে ইচ্ছা করি। আপনি অনুগ্রহ করিয়া অৰ্জ্জুনের ও আমার যথার্থ বিদ্যা ব্যাখ্যা করুন।

দ্রোণ কহিলেন, বৎস! তোমার ও অর্জ্জুনের গুরূপদেশ সমান; কিন্তু অর্জ্জুন যোগ ও দুঃখাবস্থান নিবন্ধন তোমা অপেক্ষা উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে। যাহা হউক, তোমাকে অর্জ্জুনের নিমিত্ত ভীত হইতে হইবে না; আমি তোমাকে ভয় হইতে রক্ষা করিব, সন্দেহ নাই। মদ্ভুজরক্ষিত ব্যক্তির প্রতি অমরগণও প্রভাব প্রকাশ করিতে পারেন না। আমি এমন ব্যূহ ব্যূহিত করিব যে, পার্থ তাহা কদাচ উত্তীর্ণ হইতে পারিবে না। অতএব যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, ভীত হইও না; স্বধর্ম্ম প্রতিপালন পূর্ব্বক পিতৃ পৈতামহ পথে অনুগমন কর। তুমি যথাবিধি বেদাধ্যয়ন, হোম ও যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছ, অতএব মৃত্যু তোমার পক্ষে ভয়ঙ্কর নয়। যদি তুমি অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রামে নিহত হও, তাহা হইলে মূঢ় মনুষ্যগণের দুর্লভ মহাভাগ্য লাভ করিয়া স্বীয় ভুজবীৰ্য্যার্জিত যৎপরোনাস্তি উৎকৃষ্ট দিব্য লোক সকল লাভ করিবে। কৌরব, পাণ্ডব ও বৃষ্ণি এবং আমি অশ্বত্থামা ও অন্যান্য মনুষ্যগণ সকলেই অচিরস্থায়ী। আমরা সকলেই বলবান, কাল কর্ত্তৃক পৰ্যায়ক্রমে নিহত হইয়া স্ব স্ব কর্ম্ম লইয়া পরলোকে গমন করিব। হে সিন্ধুরাজ! তপস্বিগণ তপস্যা করিয়া যে সকল লোক প্রাপ্ত হন; ক্ষত্রিয় বীরগণ ক্ষত্রিয় ধর্মের অনুগত হইয়া সেই সমস্ত লোক লাভ করেন।

সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ মহাবীর দ্রোণাচার্য্য কর্ত্তৃক এইরূপ আশ্বাসিত হইয়া অর্জ্জুনের ভয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। তখন সমুদায় কৌরবসৈন্য হৃষ্টচিত্ত হইয়া সিংহনাদ ও বাদিত্র বাদন করিতে আরম্ভ করিল।