০৯৫. দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের যুদ্ধ

৯৫তম অধ্যায়

দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের যুদ্ধ

হে মহারাজ! এইরূপে রাজা দুৰ্য্যোধন সমর প্রবিষ্ট কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের পশ্চাৎ ধাবমান হইলে পাণ্ডবেরা সোমকগণ-সমভিব্যাহারে ঘোরতর গভীর নিনাদ করিয়া প্রবল বেগে মহাবীর, দ্রোণাচাৰ্য্যকে আক্রমণ করিলেন। তখন ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। হে রাজন্! তৎকালে ভগবান্ মরীচিমালী গগনমণ্ডলের মধ্যভাগে অবস্থান করিতেছিলেন। ঐ সময় ব্যূহের অগ্রভাগে কৌরব ও পাণ্ডবদিগের যেরূপ লোমহর্ষণ অদ্ভুত তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল, তদ্রূপ সমর পূর্ব্বে আর কখন আমরা দর্শন বা শ্রবণ করি নাই। অসংখ্য সৈন্য সমবেত পাণ্ডবেরা ধৃষ্টদ্যুম্নকে অগ্রসর করিয়া শরবর্ষণ দ্বারা দ্রোণ সৈন্য সমাচ্ছন্ন করিলেন। কৌরবগণও দ্রোণাচাৰ্য্যকে পুরস্কৃত করিয়া সুতীক্ষ্ণ সায়কনিকরে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রমুখ পাণ্ডবগণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।

উভয় পক্ষীয় সৈন্যগণ গ্রীষ্মকালীন বায়ুতাড়িত উদ্ধত মহামেঘদ্বয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়া বর্ষাকালীন সলিল পরিপূর্ণ জাহ্নবী ও যমুনার ন্যায় মহাবেগে ধাবমান হইল। বায়ুবেগ সঞ্চালিত মেঘ যেমন বারিধারা বর্ষণ করিয়া অগ্নি প্রশমিত করে, তদ্রূপ সেই সংগ্রামে অসংখ্য অশ্ব, হস্তী ও রথে পরিবৃত মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য শরবর্ষণ দ্বারা পাণ্ডব সৈন্যগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। বর্ষাকালে প্রবল সমীরণ সাগর মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া যেমন জলরাশি ক্ষুব্ধ করে, তদ্রূপ দ্বিজশ্রেষ্ঠ দ্ৰোণ পাণ্ডব সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাদিগকে সংক্ষুব্ধ করিলেন। তখন পাণ্ডব সৈন্যগণ যেমন সলিলরাশি প্রবল বেগে মহাসেতু ভেদ করিতে ধাবমান হয়, তদ্রূপ, দ্রোণাচাৰ্য্যকে ভেদ করিবার নিমিত্ত পরম যত্ন সহকারে তাহার প্রতি ধাবমান হইল। মহাবীর দ্রোণাচার্য্যও অচল যেমন জলবেগ নিবারণ করে, তদ্রূপ সংক্রূদ্ধ পাণ্ডব, পাঞ্চাল কেকয়দিগকে নিবারিত করিতে লাগিলেন। প্রবল-প্রতাপ নরপতিগণ চতুর্দ্দিক্‌ হইতে পাঞ্চালগণকে আক্রমণ করিলেন। তখন নরশ্রেষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন শত্রুসৈন্যগণকে ভেদ করিবার মানসে পাণ্ডবদিগের সাহায্যে মহাবীর দ্রোণকে বারংবার আঘাত করিতে লাগিলেন। মহাবীর দ্রোণাচার্য্য ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর যেরূপ শর নিক্ষেপ করিলেন, ধৃষ্টদ্যুম্নও তাঁহার উপর তদ্রূপ শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। হে রাজন্‌! শক্তি, প্রাস ও ঋষ্টিসম্পন্ন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তৎকালে সংগ্রামক্ষেত্রে মহামেঘের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। তাঁহার তরবারি পুরোবর্ত্তী বায়ুর ন্যায়, মৌর্ব্বী বিদ্যুতের ন্যায় শাণিত শরনিকরস্বন অশনি-নির্ঘোষের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। ঐ মহাবীর ‍উপলখণ্ডের ন্যায় শাণিত শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া দশদিক্‌ সমাচ্ছন্ন, অসংখ্য রথী ও অশ্ব-সমুদয় ছেদন করিয়া সেনাগণকে প্লাবিত করিলেন। মহাবীর দ্রোণ বাণবর্ষণ করিয়া পাণ।ডবদিগের যে যে রথমার্গে গমন করিতে লাগিলেন, মহাতেজাঃ ধৃষ্টদ্যুম্ন স্বীয় শরপ্রভাবে সেই সেই স্থান হইতে তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে লাগিলেন।

হে মহারাজ! এইরূপে মহাত্মা দ্রোণাচার্য্য রণস্থলে অসাধারণ যত্ন করিলেও তাঁহার সৈন্যগণ তিন ভাগে বিভক্ত হইল। কতকগুলি সৈন্য ভোজরাজের নিকট গমন করিল, কতকগুলি জলসন্ধের শরণাপন্ন হইল এবং অবশিষ্ট দ্রোণের নিকট অবস্থানপূর্ব্বক পাণ্ডবগণ কর্ত্তৃক নিহত হইতে লাগিল। রথিশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্য্য যতবার সৈন্যগণকে সংযোজিত করিলেন, মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন ততবারই তাহাদিগকে ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া ফেলিলেন। অরণ্যে রক্ষকবিহীন পশুসকল যেমন ক্রূদ্ধ শপদগণ কর্ত্তৃক নিহত হয়, সেইরূপ কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য সৈন্য পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। তৎকালে সকলেরই মনে এইরূপ উদয় হইল যে, সেই তুমুল সংগ্রামে সাক্ষাৎ কাল ধৃষ্টদ্যুম্ন শরবিমোহিত যোদ্ধৃবর্গকে গ্রাস করিতেছে। হে মহারাজ! কুনৃপের রাজ্য যেমন দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি ও তস্কর দ্বারা উৎসন্ন হয়, সেইরুপ আপনার সেনাগণ পাণ্ডবগণের শরপ্রভাবে ধ্বংস হইতে লাগিল। ঐ সময় অর্ককিরণমিশ্রিত অস্ত্র ও বৰ্ম্ম সমুদয় এবং সেনাগণের চরণসমুত্থিত ধূলিপটল দ্বারা রণভূমিস্থ ব্যক্তিগণের চক্ষুপীড়া সমুৎপন্ন হইতেছিল।

এইরূপে পাণ্ডবেরা সেই ত্রিধাভূত কৌরবসৈন্যগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলে বীরবরাগ্রগণ্য দ্রোণাচার্য্য ক্রোধে কম্পিতকলেবর হইয়া শরবর্ষণ দ্বারা পাঞ্চালদিগকে সমাচ্ছন্ন করিলেন এবং সায়ক দ্বারা সৈন্যগণকে বিদ্ধ ও নিপাতিত করিয়া সমরক্ষেত্রে দেদীপ্যমান কালাগ্নির ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তিনি মাতঙ্গ, তুরঙ্গ, রথ ও পদাতিগণকে এক এক বাণে ভেদ করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎকালে দ্রোণ-শরাসন-বিমুক্ত শরনিকর সহ্য করিতে সমর্থ হয়, পাণ্ডবদিগের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তিকেই দৃষ্টিগোচর হইল না। পাণ্ডবসৈন্যগণ দ্রোণসায়ক ও সূর্য্যকিরণে করিতে লাগিল। যেমন হুতাশন শুষ্ক বন উৎসন্ন করে, তদ্রূপ মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নও কৌরব সৈন্যগণকে বিনষ্ট করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন উভয় পক্ষীয় সেনাগণ এইরূপে দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সায়কে নিতান্ত বিদ্ধ হইয়া জীবিতাশা পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাধ্যানুসারে যুদ্ধ করিতে লাগিল; কেহই প্রাণভয়ে সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিল না। হে মহারাজ! আপনার তিন পুত্র মহারথ বিবিংশতি, চিত্রসেন ও বিকর্ণ কুন্তী পুত্র ভীমসেনকে অবরোধ করিলেন। অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ এবং বীৰ্য্যবান ক্ষেমধুৰ্ত্তি এই তিনজন আপনার তিন পুত্রের অনুগমন করিলেন। সৎকুল সম্ভূত মহাতেজস্বী মহারথ বাহ্লীক নৃপতি অমাত্য ও সেনাগণ সমভিব্যাহারে দ্রৌপদী তনয়দিগের অবরোধ করিতে লাগিলেন। মহারাজ শৈল্য সহস্র সৈন্যে পরিবৃত হইয়া কাশিরাজের মহাবল পরাক্রান্ত পুত্রকে আক্রমণ করিলেন। মদ্র দেশাধিপতি শল্য জ্বলন্ত পাবক সদৃশ অজাত শত্ৰু যুধিষ্ঠিরকে অবরোধ করিতে লাগিলেন। অমর্ষ পরায়ণ কবচাবৃত মহাবীর দুঃশাসন স্বসৈন্য সংস্থাপন পূর্ব্বক মহারথ সাত্যকির অভিমুখে ধাবমান হই লেন এবং চারিশত মহাধনুৰ্ধর সৈন্য লইয়া চেকিতানকে আক্রমণ করিলেন। গান্ধাররাজ শকুনি চাপ, শক্তি ও খড়ঙ্গধারী সপ্তশত গান্ধার দেশীয় সৈন্য লইয়া মাদ্রী পুত্র নকুলকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। অবন্তি দেশীয় বিন্দ ও অবিন্দ বান্ধবের বিজয় বাসনায় ধনুর্ব্বাণ ধারণ করিয়া প্রাণ পণে বিরাট রাজের সহিত সংগ্রাম করিতে আরম্ভ করিলেন। বাহ্লীক নৃপতি সমরে অপরাজিত মহাবল পরাক্রান্ত দ্রুপদ তনয় শিখণ্ডীকে পরাভূত করিতে সমুদ্যত হইলেন। অবন্তি নগরাধিপতি সৌবীর সৈন্য সমভিব্যাহারে ক্রোধ পরিপূর্ণ প্রভদ্রকগণ সমবেত মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অলায়ুধ, ক্রুরকৰ্ম্মা ক্রোধপরায়ণ রাক্ষস ঘটোৎকচের প্রাণ সংহার করিবার নিমিত্ত দ্রুতবেগে সংগ্রাম ক্ষেত্রে ধাবমান হইলেন। মহারথ কুন্তিভোজ অসংখ্য সৈন্য সমভিব্যাহারে ভীষণ প্রকৃতি রাক্ষসেন্দ্র অলম্বুষকে নিবারণ করিতে লাগিলেন।

হে মহারাজ! ঐ সময় সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ কৃপ প্রভৃতি মহাধনুর্দ্ধর মহারথগণে পরিবৃত হইয়া সমুদায় সেনার পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান করিতেছিলেন। দ্রোণ পুত্র অশ্বত্থামা তাঁহার দক্ষিণ ভাগে ও সূত পুত্র কর্ণ বাম ভাগে অবস্থান পূর্ব্বক তাঁহার চক্র রক্ষা করিতে লাগিলেন। সৌমদত্তি প্রভৃতি বীরগণ তাঁহার পৃষ্ঠ রক্ষায় নিযুক্ত হইলেন। যুদ্ধ বিশারদ, নীতিজ্ঞ, মহাধনুর্দ্ধর কৃপ, বৃষসেন, শল ও শল্য প্রভৃতি বীরগণ এই রূপে সিন্ধুরাজের রক্ষার উপায় বিধান করিয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন।”